Logo
×

Follow Us

ফিচার

জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল সোনাদিয়া দ্বীপ বাঁচাতে হবে

Icon

সাইয়্যিদ মঞ্জু

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৫, ১৪:১৬

জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল সোনাদিয়া দ্বীপ বাঁচাতে হবে

মহেশখালী দ্বীপে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে আবারও প্যারাবন নিধন করে চিংড়িঘের তৈরি করা হচ্ছে। এমনিতে হাজার হাজার একর বনভূমি ধ্বংস করায় সোনাদিয়া দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে। কুতুবজোম ইউনিয়নের ঘটিভাঙা ও সোনাদিয়ার আশপাশে রাত হলে দেখা যায় প্যারাবনে দাউ দাউ আগুন জ্বলার দৃশ্য। স্থানীয়দের অভিযোগ রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে বাইন ও কেওড়া গাছ কেটে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে প্যারাবন। কর্তৃপক্ষের লোকদেখানো অভিযান নাটকের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে অর্ধশতাদিক চিংড়িঘের।

২০২৪ সালে প্রায় তিন হাজার একরের বেশি প্যারাবন কেটে ৩৭টি ঘের নির্মাণ করা হয় কুতুবজোম ইউনিয়নের ঘটিভাঙা ও সোনাদিয়া দ্বীপের আশপাশ। উচ্চ আদালত কুতুবজোমের সোনাদিয়া, ঘটিভাঙা, তাজিয়াকাটা, হামিদর দিয়ায় বিস্তৃত প্যারাবন ধ্বংসের কার্যক্রম বন্ধ করে অবৈধ চিংড়িঘের উচ্ছেদের নির্দেশ ও বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেয় ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর। অর্ধবছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও তা কার্যকর হয়নি। এখন আবার নতুন করে প্যারাবন ধ্বংসে মেতে উঠেছে প্রভাবশালীরা।

গত সরকার বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) এক হাজার এক টাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া মৌজার দুই হাজার ৭১২ একর, প্রস্তাবিত সমুদ্র বিলাস মৌজার চার হাজার ৮৩৯ একর এবং প্রস্তাবিত চর মকবুল মৌজার এক হাজার ৯১৮ একরসহ মোট ৯ হাজার ৪৬৭ একর ভূমি ইকো-ট্যুরিজমের জন্য বরাদ্দ দেয়।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) উপকূলীয় বন বিভাগের কাছ থেকে তা অধিগ্রহণ করে। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো কাজ শুরু করতে পারেনি (বেজা)। তাদের নমনীয়তার কারণে প্রকাশ্যে ভূমিদস্যুরা নির্বিচারে প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়িঘের নির্মাণ করে দখল করে নিয়েছে সরকারি বন। ইকোপার্কের জন্য জমি দেওয়ার পর প্যারাবন কাটা, চিংড়ির ঘের নির্মাণসহ বিভিন্ন পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম বেড়ে যায়, যার ফলে দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের বসবাস এখন মারাত্মক হুমকির মুখে।

প্যারাবন ধ্বংসের বিষয়ে মহেশখালীর গোরকঘাটা বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আয়ুব আলীর বক্তব্য, সোনাদিয়া, ঘটিভাঙা, কুতুবজোমের আশপাশে প্যারাবন কেটে যেসব চিংড়িঘের তৈরি করা হয়েছে তা বেজার অধীনে ছিল। আর ভূমিদস্যুরা প্রকাশ্যে নির্বিচারে প্যারাবন কেটে তা দখল করে চিংড়িঘের নির্মাণ করলেও লোকবল সংকটের কারণে বনকর্মীরা অসহায়। তার পরও বন বিভাগ অভিযান চালিয়ে কিছু ঘেরের বাঁধ কেটে দিয়েছে। দখলদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হেদায়েত উল্ল্যাহর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, মহেশখালী থানা পুলিশ এবং বন বিভাগের কর্মকর্তারা যৌথভাবে অভিযানে অংশগ্রহণ করে। তিনটি অবৈধ চিংড়িঘেরের বাঁধ ও সুইচগেট গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রশাসনের উপস্থিতি টের পেয়ে অবৈধ দখলদাররা পালিয়ে যায়। অভিযানকালে ঘেরের নির্মাণকাজে ব্যবহৃত একটি গানবোট, একটি মোটরসাইকেল, একটি সোলার প্যানেল এবং বেশ কিছু দা ও নির্মাণ সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। 

প্যারাবন ধ্বংস করে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে চিংড়িঘের তৈরি; এই অমানবিক কর্মকাণ্ড শুধু জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে না, বরং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জন্য এক বড় পরিবেশগত হুমকির সৃষ্টি করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেতে প্যারাবন প্রাকৃতিক ঢাল। সোনাদিয়া শুধুই একটি দ্বীপ বা ভূখণ্ড নয়, এটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল। এখানে রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের আবাস, হাজারো পরিযায়ী পাখির আশ্রয় এবং লবণাক্ত বনভূমি। অবশিষ্ট বনভূমি রক্ষায় কর্তৃপক্ষ ও জনগণ সচেতন না হলে ভবিষ্যতে মহেশখালী দ্বীপের মানুষ হারাবে এক অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ।

এরই মধ্যে পরিবেশ প্রকৃতির এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্যের চিন্তা করে ৫ মে, ২০২৫ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) দেওয়া কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের ভূমির বন্দোবস্ত বাতিল করেছে সরকার। ফলে ৯ হাজার ৪৬৭ একর ভূমি ফিরে পাবে বন বিভাগ।

স্থানীয়দের অভিমত, সোনাদিয়া দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। যেমন-অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে বনের জমি দখলমুক্ত করা, খালের মুখ ও শাখা-প্রশাখার বাঁধ অপসারণ করে জোয়ারের পানি প্রবাহ সুগম করা। বালিয়াড়ি পুনরুদ্ধার এবং সৈকত সংরক্ষণ করা। ম্যানগ্রোভ ও নন-ম্যানগ্রোভ গাছের চারা রোপণ করা, যেমন সাগরলতা, কেওড়া, বাইন, কেয়া, নিশিন্দা, নারকেলগাছ ইত্যাদি। এ ছাড়া দ্বীপের পরিবেশ পুনরুদ্ধারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যা পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়তা করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নিয়ে যেন বেঁচে থাকে সোনাদিয়া দ্বীপ। আর স্থানীয় প্রশাসন, বনবিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, আন্তরিক হলে সোনাদিয়ার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা সম্ভব হবে। 

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫