Logo
×

Follow Us

ফিচার

মশা কি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী

Icon

তুষার ইশতিয়াক

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৫, ১৪:৫৫

মশা কি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী

রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে হঠাৎ কানের কাছে একটুখানি গুঞ্জন। চিৎকার করে ওঠার মতো আওয়াজ নয়, বরং মৃদু রহস্যময় এক শব্দ। আপনি বাতি জ্বালান, বিছানার চাদর ভালো করে গুজে দেন, তবুও সে রেহাই দেয় না। সে লুকিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে। একটুখানি সুযোগ পেলেই তার সুচালো মুখ গেঁথে দেয় আপনার শরীরে। কখনো কখনো সেই একটি কামড়ই কাউকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

আমরা জানি, পৃথিবীতে মানুষই একে অন্যের সবচেয়ে বড় হুমকি। যুদ্ধ, সহিংসতা, বৈষম্য সবই আমাদের হাতে গড়া। কিন্তু আজকের আলোচনায় মানুষ নেই। কোনো বাঘ, সিংহ কিংবা হাঙরও নয়। একটি ছোট্ট উড়ন্ত ‘মশা’।

একটি কামড়ের গল্প

প্রতি বছর সাত লাখ মানুষের মৃত্যুর পেছনে আছে একটি সরু সুচের মতো মুখ। আপনি তাকে ভয় পান না, কারণ সে হঠাৎ হুংকার দিয়ে হামলা করে না। অথচ তার এক কামড়েই আপনি হাসপাতালে অথবা কফিনেও যেতে পারেন। ২০২৩ সালে ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন ৫.৯৭ লাখ মানুষ। ডেঙ্গুকে অনেকেই আগে ‘বাড়ির অসুখ’ বলে জানত। কিন্তু এখন শহরের অলিগলিতে ডেঙ্গু অতি পরিচিত রোগ। একটি ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী মশার কামড়ে যখন আপনি আক্রান্ত হনÑশুরুতে হালকা জ্বর, মাথাব্যথা অনুভব করবেন, এরপর শরীরে ব্যথা এমনভাবে ছড়িয়ে যায় যেন হাড়ভাঙা যন্ত্রণা। তাই ডেঙ্গুর আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’।

শুধু বাংলাদেশেই ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে তিন লাখেরও বেশি মানুষ, মারা গেছে এক হাজার ৪৬৮ জন-এটাই দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড।

ডব্লিউএইচও জানায়, প্রতিবছর বিশ্বে ৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। সবচেয়ে বিপজ্জনক, কারণ এই রোগের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সীমিত, নির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর চারটি স্ট্রেইনের মধ্যে একবার সংক্রমণ হলে পরেরবার আরো ভয়াবহভাবে আঘাত হানতে পারে। 

ইতিহাস যাকে ভয় পায়

মশা শুধু আধুনিক শহরের গলিতে নয়, ইতিহাসের পাতায় পাতায় রক্তের দাগ এঁকে গেছে।

হাইতিতে নেপোলিয়নের ২০ হাজার সেনা মশাবাহিত রোগে মারা যাওয়ায় ফরাসিরা পুরো কলোনি ছেড়ে চলে যায়।

১৯০৫ সালে পানামা খাল নির্মাণ প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, কারণ ম্যালেরিয়ার কবলে পড়েছিলেন হাজারো শ্রমিক। পরবর্তী সময়ে এক মার্কিন চিকিৎসক উইলিয়াম গারগাস প্রথমবার মশার প্রজননস্থল শনাক্ত করেন এবং তা ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। তার পর থেকেই শুরু হয় আধুনিক মশা নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ও জার্মানি মশাকে জৈব অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল। তারা ইনফেক্টেড মশা ছড়িয়ে দিয়ে শত্রুপক্ষকে দুর্বল করতে চেয়েছিল। এই পদ্ধতিকে বলে এটমোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার।

পাহাড়েও যে ভয় লুকিয়ে

অনেকে ভাবেন, পাহাড়ি অঞ্চলে মশা থাকে না। ঠান্ডা আবহাওয়া ও উচ্চতা হয়তো তাদের প্রজননে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু কথাটা মোটেই সত্য নয়। ভারতের দার্জিলিং বা নেপালের পোখারায় এখন নিয়মিতই ডেঙ্গুর খবর আসে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন ও অতিরিক্ত নগরায়ণের কারণে মশা তার স্বাভাবিক প্রজনন-সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, দুই হাজার মিটার উচ্চতাতেও এখন ডেঙ্গুবাহী মশা দেখা যাচ্ছে, যা আগে ভাবা হতো অসম্ভব। এমনকি গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যানোফিলিস প্রজাতির মশা হিমালয়ের উপত্যকাতেও টিকে থাকতে পারছে। আমাদের দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে হরহামেশা ম্যালেরিয়ার খবর মেলে। 

বিজ্ঞানের বিরুদ্ধযাত্রা

আমাদের নিঃশ্বাস থেকে বের হওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইড, শরীরের উষ্ণতা আর ঘামের গন্ধ মশাকে আকর্ষণ করে। তাই গরম শরীর ও ঘামে ভেজা মানুষ মশার কাছে এক প্রিয় বস্তু।

এই সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানীরা অভিনব পন্থা নিচ্ছেন। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এমন মশা তৈরি করা হচ্ছে যারা বংশবিস্তার করতে পারে না। ঙঢ৫১৩অ নামে এক ধরনের ‘সেলফ লিমিটিং’ মশা ব্যবহার করে ব্রাজিলে মশার সংখ্যা ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

তবে একে ‘সিলভার বুলেট’ বলা হচ্ছে না, কারণ এই জেনেটিক পরিবর্তনের প্রভাব পুরো পরিবেশে কি হবে, তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন আছে। আবার কিছু বিজ্ঞানী ডড়ষনধপযরধ নামের এক ব্যাকটেরিয়া মশার দেহে প্রবেশ করিয়ে তাদের রোগবাহী ক্ষমতা কমিয়ে আনছেন। ইতালিতে চালানো এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এতে ডেঙ্গু সংক্রমণ ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।

অন্যদিকে ওষুধের দিক থেকেও কাজ হচ্ছে। ডঐঙ অনুমোদিত ভ্যাকসিন গড়ংয়ঁরৎরী এখন আফ্রিকার বহু দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০২৫ সালে ঘোষণা এসেছে, ২০২৮ সালের মধ্যে এর দাম পাঁচ ডলারের নিচে নামিয়ে আনা হবে।

তুলনায় কে কতটা ভয়ংকর?

সাপের বিষ, বাঘের থাবা বা হাঙরের চোয়াল সবই ভয়ংকর। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা: সাপ প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার মানুষকে মেরে ফেলে।

হাঙর বছরে ৫ থেকে ১০ জন মানুষ মারে।

বাঘ মারে বছরে গড়ে ৫০ থেকে ১০০ জন।

হাতির আক্রমণে নিহতের সংখ্যা বছরে ৫০০।

কিন্তু মশা? বছরে সাত লাখ!

স্রেফ সংখ্যার দিকেই নয়, ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা, অদৃশ্যতা এবং প্রতিরোধহীনতার দিক থেকেও মশা সব প্রাণীকে ছাড়িয়ে গেছে। একটি সিংহের দৌড় আপনি হয়তো দেখতে পাবেন, কিন্তু একটি মশার কামড় আপনি টেরই পান না, এটিই সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার। 

আগামী দিনের ভয়

জলবায়ু পরিবর্তন মশার বিস্তারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আগে যেসব অঞ্চলে মশা টিকত না, এখন সেসব এলাকায়ও তাদের দাপট দেখা যাচ্ছে। ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল, আমেরিকার কিছু অংশ এমনকি হিমালয়সংলগ্ন এলাকায়ও এখন ডেঙ্গুর উপস্থিতি।

দিনকে দিন তাপমাত্রা বাড়ছে, আর তাপমাত্রা বাড়া মানেই মশার প্রজননের জন্য এটি আদর্শ পরিবেশ। কিছু মশা ৮-১০ দিনেই ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হয়ে যায়। তাদের এই চক্র দ্রুত ঘুরতে থাকলে কোনো প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপই কার্যকর হয় না।

কিছু চমকপ্রদ তথ্য

*পৃথিবীতে মোট তিন হাজার ৫০০ প্রজাতির মশা আছে।

*কেবল মেয়ে মশা রক্ত খায়, তাও ডিম পাড়ার জন্য।

*একটি মশা একবারে ১০০ থেকে ২০০টি ডিম দিতে পারে।

*মশা মানুষের রক্তের গ্রুপও চিনে ফেলতে পারে। তারা সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয় ‘ও’ গ্রুপের রক্তের প্রতি।

*গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী, একটি মশা তার শরীরের ওজনের তিন গুণ রক্ত শুষে নিতে পারে।

*মশা উড়ে যেতে পারে ঘণ্টায় প্রায় দেড় থেকে আড়াই কিলোমিটার এবং একজোড়া ডানা প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ থেকে ৬০০ বার ঝাপটায়!

মশা কি সত্যিই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী? যদি মানুষকে এই গণনায় না ধরি, তবে নিঃসন্দেহে উত্তর ‘হ্যাঁ’। সিংহ বা হাঙরের ভয়ংকর রূপ আমরা গল্পে এবং টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পাই। এমনই এক ভয়ংকর প্রাণী চুপচাপ সারা ঘরে ঘুরে বেড়ায় সবার দৃষ্টি এড়িয়ে, সুযোগ পেলেই নিজের ভয়ংকর রূপটি নিয়ে বেরিয়ে আসে, কিন্তু সেই রূপটিও দেখা যায় না নির্দিষ্ট সময়ের আগে! 

সূত্র : ওয়ার্ল্ড হেথ অর্গানাইজেশন, সিডিসি ডেঙ্গু ফ্যাক্টস, নেচার ডট কম, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস, বিবিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, উইকিপিডিয়া

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫