
১৯৫০-এর দশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ তুঙ্গে। তখন দুই দেশই নিজেদের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রদর্শনে মরিয়া হয়ে ওঠে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন (ইউএসএসআর) একের পর এক প্রযুক্তি ও মহাকাশ জয়ের সাফল্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই সময়, ১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী গোপনে তৈরি করেছিলেন এক ভয়ংকর পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের বুকে একটি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পুটনিক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাদের শক্তি প্রদর্শন করতেই এই পরিকল্পনা হাতে নেয়। গোপন এই পরিকল্পনার নাম ছিল ‘প্রজেক্ট অ১১৯’। এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের চন্দ্র বিজয়ের প্রথম ‘সিক্রেট স্টান্ট’ বলেই ধরা হয়।
প্রজেক্ট A119-এর গবেষণা প্রতিবেদনটির নাম ছিল Lunar Research Flight Volume-1। প্রথমবার পড়লে মনে হতে পারে এটি হয়তো চাঁদে বৈজ্ঞানিক গবেষণাসংক্রান্ত সাধারণ কোনো নথি। কিন্তু এর প্রচ্ছদের দিকে তাকালেই বোঝা যায় ভিন্ন কিছু। প্রচ্ছদের কেন্দ্রে এক ঢালের ছবি, যার ওপর পরমাণু প্রতীক, বোমা ও মাশরুম মেঘের প্রতীক খচিত। এটি নিউ মেক্সিকোর কির্টল্যান্ড বিমানঘাঁটির মার্কিন বিমানবাহিনীর বিশেষ অস্ত্রাগারের চিহ্ন। এই ঘাঁটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
এই প্রকল্পের জন্য শিকাগোর ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ১০ সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়। এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. লিওনার্ড রেইফেল, যিনি শিকাগোর আরমার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (পরবর্তী সময়ে ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি রিসার্চ ইনস্টিটিউট) পরিচালক ছিলেন। তিনি বিখ্যাত পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মির সঙ্গেও কাজ করেছেন। তার দলে ছিলেন তরুণ কার্ল সাগানও, যিনি পরবর্তী সময়ে একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রচারক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সাগানের কাজ ছিল মহাকাশে পারমাণবিক বিস্ফোরণের সম্ভাব্য আচরণ এবং এর দৃশ্যমানতা নিয়ে গবেষণা করা। তাদের দায়িত্ব ছিল বিস্ফোরণের দৃশ্যমানতা, এর বৈজ্ঞানিক সুবিধা ও চন্দ্রপৃষ্ঠের উপর এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা।
প্রকল্পটি ছিল চাঁদে একটি হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা। এই বোমা হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়েও বহু গুণ বেশি বিধ্বংসী। বিস্ফোরণটি চাঁদের টার্মিনেটর লাইন, অর্থাৎ আলোর ও অন্ধকার অংশের সীমারেখায় ঘটানোর পরিকল্পনা ছিল, যেন পৃথিবী থেকে সেটি স্পষ্ট দেখা যায়। মূল লক্ষ্য ছিল একটাই-সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর মানসিক ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা।
যেহেতু চাঁদে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই, তাই প্রচলিত অর্থে ‘মাশরুম ক্লাউড’ তৈরি হতো না, তবে বিস্ফোরণের উজ্জ্বলতা পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যেত। এতে এক ধরনের ‘পাওয়ার ডিসপ্লে’ দেখানো সম্ভব হতো। ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্র হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষায় সাফল্য পেলেও ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নও সফলভাবে তা করে তাক লাগায়। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েতরা উৎক্ষেপণ করে বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১। এতে মহাকাশ প্রতিযোগিতায় মার্কিনিদের পিছিয়ে পড়া স্পষ্ট হয়ে যায়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রকেট ‘ভ্যানগার্ড’ উৎক্ষেপণে ব্যর্থ হয়, যা ছিল তাদের জন্য বিশ্বের সামনে চরম অপমানজনক। এসব ব্যর্থতা যুক্তরাষ্ট্রকে পরমাণু বিস্ফোরণের মাধ্যমে ‘মহাকাশে শক্তির প্রতীক’ তৈরি করার দিকে ঠেলে দেয়।
এ সময়ে মার্কিন সংবাদপত্রগুলোতে খবর ছড়ায় যে সোভিয়েতরা তাদের বিপ্লব বার্ষিকী উপলক্ষে চাঁদে হাইড্রোজেন বোমা ফেলবে। যদিও এমন গুজবের সত্যতা পাওয়া যায়নি, তবুও এটি যুক্তরাষ্ট্রে আতঙ্ক ছড়ায়।
অদ্ভুতভাবে, এই গুজব সোভিয়েত ইউনিয়নের লোকজনকে অনুপ্রাণিত করে। তারা Project E-4 নামের একটি মিলিটারি পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যা প্রকৃতপক্ষে মার্কিনিদের পরিকল্পনার অনুকরণে তৈরি। পরে উৎক্ষেপণ ব্যর্থ হলে সোভিয়েত ভূখণ্ডেই বিস্ফোরণের ঝুঁকির কথা চিন্তা করে তারা এটি বাতিল করে।
২০০০ সালে ড. রেইফেল জানান, এই পরিকল্পনা প্রযুক্তিগতভাবে সম্পূর্ণ সম্ভব ছিল এবং এর বিস্ফোরণ পৃথিবী থেকেও দেখা যেত। ইতিহাসবিদ অ্যালেক্স ওয়েলারস্টেইন বলেন, “এই প্রকল্পটি ছিল এক ধরনের ‘স্টান্ট’। জনগণকে চমকে দেওয়া এবং প্রতিপক্ষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাপে ফেলার জন্য।”
প্রজেক্ট A119 শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। এর প্রধান কারণ ছিল, একটি ব্যর্থ উৎক্ষেপণের সম্ভাব্য রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিপর্যয়। এটি বাস্তবায়িত হলে মহাকাশের সামরিকীকরণের পথ খুলে যেত এবং এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারত। প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা এর সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো তুলে ধরেন। এর মধ্যে ছিল চাঁদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি, পারমাণবিক বর্জ্য পৃথিবীতে ফিরে আসার আশঙ্কা এবং আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। এই ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে এবং চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা তুলনামূলকভাবে বেশি জনপ্রিয় হওয়ায় ১৯৫৯ সালে এই প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
বিশ্লেষক ব্লেডিন বাওয়েন বলেন, “প্রজেক্ট A119 আমার কাছে ‘দ্য সিম্পসন্স’-এর সেই পর্বের মতো, যেখানে একজন চরিত্র দেওয়ালে শত্রুপক্ষের পোস্টার দেখে বলে, ‘আমাকেও কিছু একটা করতে হবে।’ এটি ছিল প্রতিযোগিতার তাড়নায় জন্ম নেওয়া এক চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া।”
প্রজেক্টটি প্রায় ৪৫ বছর ধরে গোপন ছিল। ২০০০ সালে এই প্রকল্পের প্রধান লিওনার্ড রেইফেল প্রথম এর অস্তিত্ব প্রকাশ করেন। অনেক নথি এরই মধ্যে ধ্বংসও করা হয়েছে। যদিও মার্কিন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পের কথা স্বীকার করেনি। যদিও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি, তবে এটি মানবজাতির ইতিহাসে এক অদ্ভুত অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে, যেখানে চাঁদের বুকে একটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, শুধু নিজেদের শক্তির জানান দিতে।