
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন নিজেকে যাচাই করে দেখে এই প্রজন্ম। কারো পেট একটু বাইরে, কারো গাল একটু মোটা, কারো আবার শরীর স্লিম নয় বলে সারাক্ষণ মানসিক চাপে ভুগতে থাকে। সেই চাপে একসময় অনেকেই সিদ্ধান্ত নেয়, ওজন কমাতে হবে। অথচ এই ওজন কমানোর চেষ্টার মধ্যেই শুরু হয় এক ধরনের নিঃশব্দ সহিংসতা, যেটা চলে নিজের শরীরের বিরুদ্ধেই।
আজকাল খাদ্যাভ্যাসের অনেক পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু পেছনের কারণটা বেশির ভাগ সময়েই স্বাস্থ্য নয়; বরং চেহারা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকা ‘আইডিয়াল’ বা তথাকথিত আদর্শ শরীরের ছবিগুলো মানুষকে যেন প্রতিদিন বোঝাচ্ছে-‘তুমি যথেষ্ট ভালো নও, তোমাকে বদলাতে হবে।’ এই চাপ থেকে মুক্তি পেতে অনেকে ডায়েট শুরু করে, কিন্তু সেটা যদি না হয় সচেতনভাবে, বরং হয় আত্ম-অবিশ্বাস ও সামাজিক তুলনার জায়গা থেকে, তখন সেটি আর স্বাস্থ্যচর্চা থাকে না, হয়ে ওঠে আত্মনিগ্রহ।
অল্প সময়ে ওজন কমানোর উপায় হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নানা রকম খাদ্যবর্জনমূলক ডায়েট-কার্বোহাইড্রেট বাদ, চিনি বাদ, এমনকি দিনে একবার খাওয়া-এসব নিয়মে শরীর সাময়িকভাবে ওজন কমাতে পারে ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে শরীরের প্রাকৃতিক চাহিদা উপেক্ষিত হয়। বহু মানুষ এই ডায়েট করতে গিয়ে শারীরিক দুর্বলতা, মনমরা ভাব ও অবসাদে আক্রান্ত হচ্ছেন, যা তারা নিজেরাও অনেক সময় বুঝতে পারছেন না।
এখানে প্রশ্ন আসে-পুষ্টি কি কেবল শরীরের ব্যাপার? না কি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মনের স্বাস্থ্যের বিষয়টিও? চিকিৎসকরা বলছেন, খাদ্যাভ্যাস কেবল পেট নয়, প্রভাব ফেলে মস্তিষ্কে, মানসিক অবস্থায়, এমনকি আত্মসম্মানবোধেও। যখন কেউ প্রতিদিন নিজের খাওয়া নিয়ে অপরাধবোধে ভোগেন, যখন প্রতিবার খাওয়ার পর ভাবেন ‘আজও ঠিক করলাম না’, তখন সেটা কেবল খাদ্যনিয়ন্ত্রণ নয়, আত্মতাড়নার এক নিঃশব্দ চর্চা।
এই অবস্থার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, কেউ যখন নিজের শরীরকে শত্রু মনে করতে শুরু করে। শরীর যেন এক এমন সত্তা, যাকে পাল্টে ফেলতেই হবে, না হলে সমাজে টিকে থাকা যাবে না। অথচ শরীর প্রতিদিন আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে-ঘুম থেকে জাগানো, পথে হাঁটানো, কাজ করার শক্তি দেওয়ার মাধ্যমে। সেই শরীরের সঙ্গে যদি সহানুভূতিশীল না হই, তবে সুস্থতা আসবে কোন পথে?
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মানে শুধু ওজন কমানো নয়। এর মানে শরীর যা চায় তা বোঝা-সময়মতো খাওয়া, ঘুম ও মানসিক প্রশান্তির সঙ্গে খাদ্য গ্রহণ। কেউ যদি নিজেকে ভালোবেসে, নিজের দেহের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে খেতে শেখে, তবে ওজন নয়, আসে স্থিতি। আর সেই স্থিতিই তো আসল সুস্থতা।
আজকের তরুণ সমাজের অনেকেই শরীর নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতায় ভুগছে। অথচ প্রয়োজন হলো আত্মবিশ্বাস, নিজের সঙ্গে সহানুভূতি ও বাস্তববোধ। ডায়েট যদি হয়ে ওঠে সামাজিক চাপ থেকে পালানোর রাস্তা, তবে সেটা মুক্তি নয়, বরং এক নতুন কারাগার।