Logo
×

Follow Us

ফিচার

নিশ্চিহ্নের পথে : কাঙাল হরিনাথের ‘এমএন প্রেস’

Icon

সঞ্জয় সরকার

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৫:১০

নিশ্চিহ্নের পথে : কাঙাল হরিনাথের ‘এমএন প্রেস’

গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ও বাউল কাঙাল হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার কথা অনেকেই জানেন। ১৬২ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়া নামক এক অখ্যাত অজগ্রাম থেকে শুরু করেছিলেন পত্রিকাটির প্রকাশনা। সেই কুণ্ডুপাড়ার দিন অনেকখানি বদলেছে। অনেক আগেই তা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পৌর এলাকায়। হয়েছে পাকা রাস্তাঘাট। আবার হরিনাথের স্মৃতিকে ধারণ করে অদূরেই নির্মিত হয়েছে ‘কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর’। কিন্তু বদলায়নি শুধু ‘কাঙ্গাল কুটির’ নামক হরিনাথের বাড়িটি, আর তার বিখ্যাত ‘এমএন প্রেস’, যেখান থেকে ছাপা হতো পত্রিকাটি। গেলেই চোখে পড়ে ভাঙতে ভাঙতে নিশ্চিহ্ন হতে চলা একটি আধা পাকা টিনশেড ভবন। চারপাশে ঝোপঝাড়। যেন নিদারুণ অযত্ন-অবহেলার ছাপ।

জানা যায়, বাল্যকালে মা-বাবা মারা যাওয়ায় হরিনাথের প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি। অল্প বয়সেই কাজ নিতে হয় ব্রিটিশ মালিকানাধীন নীল উৎপাদন কারখানায়। কিন্তু অত্যাচারী নীলকরদের জুলুম-নিষ্পেষণ তাকে পীড়িত করে। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঈশর চন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় শুরু করেন লেখালেখি ও সাংবাদিকতা। পরবর্তী সময়ে ১৮৬৩ সালে নিজেই প্রকাশ করেন মাসিক ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’, যা পরে পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। 

শুরুতে ‘গ্রামবার্র্তা প্রকাশিকা’ ছাপা হতো কলকাতার ‘গিরিস বিদ্যারত্ন প্রেস’-এ। পরে হরিনাথের বন্ধু, ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র পিতা মথুরা নাথ মৈত্রেয় তাকে একটি মুদ্রণযন্ত্র দান করেন। মথুরা নাথের নামেই ছাপাখানাটির নামকরণ হয় ‘এমএন প্রেস’, যা এখনো ‘কাঙ্গাল কুটির’-এর দেওয়ালে খোদাই করে লেখা আছে। এই ছাপাখানা থেকেই দীর্ঘ ১৮ বছর প্রকাশিত হয় ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’। সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনার পাশাপাশি পত্রিকাটিতে ছাপা হতো নীলকরদের অত্যাচার-নিপীড়নের খবর। তাতে নীলকরদের বাধাও ছিল অনেক। কিন্তু সেসব বাধা-প্রলোভনে কখনো থামেননি হরিনাথ। এদিকে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’য় নিয়মিত সংবাদের পাশাপাশি দর্শন ও সাহিত্যবিষয়ক লেখাও প্রকাশ করা হতো। বিভিন্ন সময়ে লালন ফকিরেরও অনেক গান প্রকাশ করা হয়েছে পত্রিকাটিতে। লালন নিজেও আসতেন হরিনাথের কাঙ্গাল কুটিরে। মীর মশাররফ হোসেন, জলধর সেনের মতো লেখকদেরও লেখালেখির সূত্রপাত হয়েছিল এই পত্রিকায়। শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, প্রসন্ন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়সহ আরো অনেক বিখ্যাতজন জড়িত ছিলেন গ্রামবার্তা প্রকাশিকার সঙ্গে। কাজেই কাঙাল হরিনাথের এই ঐতিহাসিক ছাপাখানাটিও এখন ইতিহাসের অংশ। মীর মশাররফ হোসেনের কালজয়ী উপন্যাস ‘বিষাদসিন্ধু’ও প্রথম ছাপা হয় এই ছাপাখানা থেকেই। এখান থেকেই মুদ্রিত হয় তৎকালীন ইংরেজবিরোধী অনেক পুস্তিকা বা প্রচারপত্র।

কাঙাল হরিনাথ ১৮৯৬ সালে মারা যান। এর ১১৭ বছর পর ২০১৩ সালে গ্রামটিতে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ‘কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ২০২৩ সালে হরিনাথের মুদ্রণযন্ত্রটি জাদুঘরে নেওয়া হয়। এর আগ পর্যন্ত যন্ত্রটি তার জরাজীর্ণ বাড়িতেই পড়ে ছিল। কাঙাল হরিনাথের নামে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটি দেখলে যে কারো ভালো লাগবে। কিন্তু মন খারাপ হবে হরিনাথের বাড়িটিতে গেলে। বাড়িটির সামনের অংশেই তার ঐতিহাসিক ‘কাঙ্গাল কুটির’ বা ‘এমএন প্রেস’-এর ভবন। পরের অংশে তার সমাধি ও বংশধরদের বসতঘর। বর্তমানে তার চতুর্থ ও পঞ্চম বংশধরেরা বসবাস করছে বাড়িটিতে। মন খারাপ হবে এই কারণে যে, কাঙ্গাল কুটির নামক ছাপাখানাটির প্রতি কারো যত্নের ছোঁয়া নেই। সর্বত্র অযত্ন আর অবহেলার ছাপ যেন স্পষ্ট। আধাপাকা ভবনটির পলেস্তারা উঠে গেছে। ইট-কাঠ একে একে খসে পড়ছে। দরজা-জানালা ভেঙে গেছে। টিনের ছউনি নষ্ট হয়ে গেছে। লতাগুল্মে ঢাকা পড়ছে চারপাশ। আর কয়েক বছর গেলে হয়তো এটির কোনো চিহ্নই থাকবে না। এটি দেখার পর দূর-দূরান্ত থেকে আসা আগন্তুকরা রীতিমতো আশাহত হন।

হরিনাথের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়েই কথা হয় চট্টগ্রাম থেকে আসা লেখক শামসুল আরেফীন ও নেত্রকোনার সংস্কৃতিকর্মী মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। দুজনই বলেন, ‘হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরটি দেখে যতখানি ভালো লেগেছিল, তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগল ছাপাখানাটির জীর্ণদশা দেখে। এটির অযত্ন-অবহেলা ও ভগ্নদশা কাম্য নয়। জরুরি ভিত্তিতে ছাপাখানার ভবনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’ হরিনাথের চতুর্থ বংশধরের স্ত্রী গীতা মজুমদার বলেন, ‘ঘরটি সংস্কার করা দরকার। কিন্তু আমাদের সাধ্য নেই। কেউ করতে চাইলে আমরা সহযোগিতা করব। আমরাও চাই হরিনাথের স্মৃতি রক্ষা হোক।’ তিনি আরো বলেন, ‘মুদ্রণ যন্ত্রটি আমরা অনেক কষ্ট করে সংরক্ষণ করেছিলাম। অনেকে চড়া দামে কিনে নিতে চেয়েছিল। আমরা বেচিনি। জাদুঘরের জন্য যখন চেয়েছে, দিয়ে দিয়েছি।’ কুমারখালীর স্থানীয় বাসিন্দারাও মনে করেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জাদুঘর কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন বা স্থানীয় সরকারের যেকোনো কর্তৃপক্ষ চাইলে খুব সামান্য খরচেই এটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে পারে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫