Logo
×

Follow Us

ফিচার

কেমন আছে সমুদ্রের যাযাবর বাজাউরা

Icon

ইশতিয়াক হাসান

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৫, ১১:৫৮

কেমন আছে সমুদ্রের যাযাবর বাজাউরা

এক যে ছিল জলঘর-লেপা

‘আমার বাবা যেমন সমুদ্রে শুয়ে আকাশ দেখতেন, আমিও তেমনই শিখেছি বাতাসের গন্ধে বুঝি কবে ঝড় আসবে, জোয়ারের ছন্দে জানি কখন ডুব দেব’, বলছিলেন বিলকুইন জিমি সালিহ। তিনি বাজাউ লাউত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক রহস্যময় জলজ জাতিগোষ্ঠী, যাদের জীবন সমুদ্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।

বাজাউদের অনেকে জন্মান কাঠের তৈরি নৌকায়, ‘লেপা’ নামে পরিচিত এই ভাসমান ঘরই তাদের জীবনের সূচনা ও সমাপ্তির স্থান। মাছ ধরা, ঝিনুক সংগ্রহ, মুক্তা শিকার, সবই এই লেপা থেকেই।

তাদের বলা হয় ‘সী নোম্যাড’, অর্থাৎ ‘সমুদ্র যাযাবর’। 

বিশ্বের শেষ কয়েকটি জলচর জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম বাজাউরা।

সাগরের মানুষ : বাজাউ ইতিহাসের জলছবি

বাজাউদের ইতিহাস হাজার বছরেরও পুরোনো। গবেষকদের মতে, তারা সম্ভবত দক্ষিণ ফিলিপাইনের টাওসুগ বা ইন্দোনেশিয়ার বুগিস জাতিগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত। যুগের পর যুগ ধরে সুলু সাগর, সেলেবস সাগর এবং বর্নিও উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে মাছ, মুক্তা ও খাবারের খোঁজে।

১৮৮৫ সালের ‘মাদ্রিদ প্রটোকল’ যখন তিনটি উপকূলবর্তী দেশের সীমান্ত নির্ধারণ করে, তখন বাজাউরা পড়ে যায় ‘কোনো দেশের নয়’-এমন এক অদৃশ্য ফাঁদে। তাদের যাযাবর জীবনধারার জন্য কোনো দেশের সরকারই তাদের নাগরিকত্ব দিতে আগ্রহী হয়নি।

১৯৭০-এর দশকে মিন্দানাও গৃহযুদ্ধের সময় ফিলিপাইন থেকে হাজারো বাজাউ পালিয়ে আসে মালয়েশিয়ার সাবাহ রাজ্যে। কিন্তু সেখানেও তারা নাগরিক না হওয়ায় বঞ্চিত হয় মৌলিক অধিকার থেকে।

জলের নিচে ১০ মিনিট : জৈবিক রহস্যের নাম বাজাউ

বাজাউদের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, তাদের ডুবুরির দক্ষতা। তারা আধুনিক কোনো অক্সিজেন ট্যাংক ছাড়াই ৬০ মিটার (প্রায় ২০০ ফুট) গভীরতায় ডুব দিতে পারে এবং ৯-১০ মিনিট পর্যন্ত থাকতে পারে পানির নিচে।

২০১৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় জানা যায়, তাদের প্লীহা সাধারণ মানুষের তুলনায় গড়ে ৫০ শতাংশ বড়। বড় প্লীহা রক্তে অতিরিক্ত অক্সিজেন সংরক্ষণ করে, যা ডুবের সময় কাজে লাগে। এটা হলো জিনগত অভিযোজন, শুধু প্রশিক্ষণ বা পরিবেশ নয়, বরং জন্মগত পরিবর্তন।

গবেষণায় দেখা গেছে, এই অভিযোজন একটি নির্দিষ্ট জিন-PDE10A-এর পরিবর্তনের কারণে হয়েছে। অর্থাৎ বাজাউদের শরীর সত্যিই ‘সমুদ্রের জন্য তৈরি’।

বাজাউদের দুই জগৎ : ‘লাউত’ বনাম ‘দারাত’

বাজাউ জনগোষ্ঠীর মাঝেও রয়েছে এক অভ্যন্তরীণ বিভাজন, একদল বাস করে নোনা জলের বুকে, অন্যদল স্থলভাগে। যারা সমুদ্রকে ঘর বানিয়ে নিয়েছে, তাদের বলা হয় বাজাউ লাউত, আর যারা স্থলভাগে উঠে এসেছে, তারা পরিচিত বাজাউ দারাত নামে।

এই ফিচারের মূল আলোচ্য বাজাউ লাউত, যাদের জীবন, সংস্কৃতি, টিকে থাকার সংগ্রাম সবকিছুই সমুদ্রকেন্দ্রিক। তারা ঠিক যেন এক আধুনিক নোমাডিক জলমানব।

নাগরিকত্বহীনতার দুঃসহ জীবন

আজকের বিশ্বে যেখানে নাগরিকত্ব একটি মৌলিক অধিকার, সেখানে বাজাউদের অনেকেই এখনো রাষ্ট্রহীন।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা UNHCR অনুযায়ী, মালয়েশিয়াতেই হাজার হাজার বাজাউ বর্তমানে স্ট্যাটলেস (stateless) অবস্থায় জীবন যাপন করছেন।

চিকিৎসা, শিক্ষা এমনকি জমি কেনার অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। এই অনিশ্চিত পরিচয় তাদের ভবিষ্যৎকে করে তুলেছে আরো অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত।

রঙিন উৎসব ‘রেগাতা লেপা’

বাজাউদের ঐতিহ্যিক নৌকা ‘লেপা’র নামেই প্রতি বছর মালয়েশিয়ার সেমপোর্নায় অনুষ্ঠিত হয় এক মনোমুগ্ধকর উৎসব, রেগাতা লেপা। এই উৎসবে শত শত রঙিন নৌকা সেজে ওঠে পতাকা, কাপড় ও হাতের শিল্পে। যেন জলবক্ষে ভাসে একেকটি ভ্রাম্যমাণ রাজপ্রাসাদ। উৎসবটি শুধু বিনোদন নয়, বরং বাজাউ জাতিসত্তার প্রতি সম্মান জানানোর এক অনন্য অভিব্যক্তি।

সেমপোর্না : একপাশে সাগর, আরেক পাশে বাস্তুচ্যুতি

আজকের বাজাউরা আর সেই আগের মতো সম্পূর্ণ জলচর নয়। অনেকেই এখন সেমপোর্না, ওমাডাল কিংবা মাবুল দ্বীপে উঠে এসেছে পানির ওপর খুঁটি বসানো ঘরে। তবে তারা এখনো নৌকাতেই কাটায় জীবনের বড় অংশ।

কিন্তু নাগরিকত্ব না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কোনো স্কুলে ভর্তি হতে পারে না, চিকিৎসা নেই, ভোটাধিকার নেই এমনকি জন্মসনদও নেই। তাদের অস্তিত্ব যেন অদৃশ্য, পৃথিবীতে থেকেও নেই।

সমুদ্রের ক্ষত : মাছ নেই, বোমা আছে

বাজাউদের কাছে সমুদ্র মানে জীবন। কিন্তু এখন সেই সমুদ্রও ক্লান্ত। জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়েছে, যার ফলে প্রবাল প্রাচীর সাদা হয়ে যাচ্ছে (corl bleaching)। এতে মাছের বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে।

এর ওপর ব্লাস্ট ফিশিং বা বোমা মেরে মাছ ধরা এক ভয়াবহ চর্চা। মাত্র ১৫ রিঙ্গিতে তৈরি হওয়া বিস্ফোরক দিয়ে কয়েক সেকেন্ডে ধরা পড়ে শত শত মাছ, কিন্তু একই সঙ্গে ধ্বংস হয় প্রবাল ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। বহু বাজাউ তরুণ নিজের অজান্তেই এই নিষ্ঠুর পেশায় জড়িয়ে পড়ে।

আবিসসি ও হাইকাল : নতুন প্রজন্মের সমুদ্রযোদ্ধা

এখন এক নতুন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা শুধু সমুদ্র ব্যবহার করছে না, রক্ষাও করছে। ইমরান আবিসসি ও হাইকাল নুকিমান নামের দুই বাজাউ তরুণ ট্রপিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টারে কাজ করছেন। তারা স্কুবা ডাইভিং করে কোরাল রিস্টোরেশন, টার্টল হ্যাচারি ও সাগরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অবদান রাখছেন।

তারা নিজেরাই বলছেন, ‘আগে আমরা জানতাম না প্রবাল কী, এখন নিজের হাতে প্রবাল গড়ে তুলছি।’ এই শিক্ষাগুলো অন্য বাজাউ তরুণদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে।

ফিরে পাওয়া লেপা : বিলকুইনের স্বপ্ন

বাজাউ তরুণী বিলকুইন সালিহ এখন শিক্ষক। তিনি পড়ান মালয় ভাষা এবং শিশুদের শেখান সমুদ্র সংরক্ষণ ও বাজাউ ঐতিহ্য। তার স্বপ্ন, নিজ হাতে আবার একটি লেপা তৈরি করা, যেমনটা তার দাদা বানাতেন।

‘আমি চাই আমার সন্তানেরা শিখুক কীভাবে তৈরি হয় লেপা, কীভাবে জেগে উঠতে হয় ঢেউয়ের তালে’ তিনি বলেন।

এই স্বপ্ন শুধু এক নৌকা নয়, এই স্বপ্ন বাজাউ জাতির সংস্কৃতি ও পরিচয়ের পুনর্জাগরণ। বাজাউদের গল্প যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, একবার হারিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে নতুন রূপে। এখন প্রশ্ন একটাই, এই ঢেউ কি টিকবে, নাকি হারিয়ে যাবে ইতিহাসের অতলে?

সূত্র : সিএনএন, গার্ডিয়ান, হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল গবেষণা, ট্রপিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টার (টিআরএসিসি), রিফ চেক মালয়েশিয়া, করাল ট্রায়াঙ্গেল সেন্টার, বোর্নিও কোমরাড

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫