Logo
×

Follow Us

ফিচার

ছাপা বইয়ের স্থিরতায় ফিরে আসা

Icon

মনিরা তাবাস্সুম

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৫, ১২:৫৮

ছাপা বইয়ের স্থিরতায় ফিরে আসা

বই পড়া একসময় ছিল ছাদের ওপরে বসে বাতাসের সঙ্গে পৃষ্ঠা ওল্টানো কিংবা কেরোসিন বাতির নিচে রাত জেগে একটা উপন্যাসে ডুবে থাকার গল্প। এখন? স্ক্রিনে টোকা দিলে খুলে যায় অজস্র বই, ডিজিটাল লাইব্রেরি, পিডিএফ, ই-বুক, অডিওবুক। কিন্তু এই ‘সহজ’ যুগেও অনেক পাঠক আবার ফিরছে সেই পুরোনো ছাপা বইয়ের পাতায়। ছাপা বই পড়া মানে শুধু জ্ঞান আহরণ নয়, এ এক ধ্যান, আরাম, এক আত্মমগ্ন যাত্রা।

স্ক্রিনে টানা ৩০ মিনিট পড়ার পর চোখে জ্বালা ধরে। নোটিফিকেশনের ঝাঁপটায় মনোযোগে চিড় ধরে। আবার বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে পাঠক যেমন ধীরে ধীরে ডুবে যান গল্পে, তেমনটা ই-বুকে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমিক জার্নাল ঝপরবহপব ড়ভ জবধফরহম-এর মতে, ছাপা বই পাঠককে দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং তা পাঠ্যবস্তু বুঝে নিতে বেশ কার্যকর। বিশেষত শিশুরা যখন পাতা উল্টে, ছবিতে আঙুল রাখে তাদের শেখার গতি বেড়ে যায়। 

ছাপা বইয়ের একটি দিক আজও অনন্য। এটি হলো তার স্পর্শ ও ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ মস্তিষ্কে স্মৃতির ট্রিগার হিসেবে কাজ করে, যা ডিজিটালে পাওয়া যায় না। ন্যুরোসায়েন্টিস্ট অ্যান মার্টিনের মতে, ‘ছাপা বই পড়া শুধু দেখার অভিজ্ঞতা নয়, এটা একাধিক ইন্দ্রিয়ের সমন্বয়।’ রোদোসী নামের এক পাঠক বলেন, ‘পিডিএফে পড়লে মাথা ধরতে থাকে। কিন্তু ছাপা বই পড়লে মনে হয় সময় থেমে গেছে। গল্পটা যেন চারপাশে বাস্তব হয়ে উঠছে।’

মনোরোগ চিকিৎসকরা বলছেন, বই পড়া মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এতে স্ট্রেস হরমোন কমে, ধ্যানমগ্নতা বাড়ে। একাকিত্ব, উদ্বেগ, অবসাদের সময় ছাপা বই হতে পারে সবচেয়ে সস্তা এবং কার্যকর থেরাপি। ব্রিটিশ একাডেমিক জার্নাল জবধফরহম ধহফ ঈড়মহরঃরড়হ-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ছাপা বই পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে বেশি, কারণ সেখানে কোনো পপ-আপ বিজ্ঞাপন বা স্ক্রল করার তাড়া থাকে না। চোখও কম ক্লান্ত হয়, স্মরণশক্তিও বাড়ে।

গবেষণা বলছে, বইয়ের পাতার ঘ্রাণে থাকে এক ধরনের রাসায়নিক যেটা আমাদের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে যায়। যেসব শিশু ছোটবেলা থেকে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে অভ্যস্ত হয়, তাদের চিন্তার গভীরতা ও ভাষাজ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়।

পাঠকের পাঠাভ্যাস ফিরিয়ে আনতে ঢাকায় গড়ে উঠেছে কিছু বইকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক পরিসর, যাদের ঘিরে তৈরি হয়েছে পাঠক সমাজ। ‘বেঙ্গল বই’, ‘পাঠক সমাবেশে’র মতো লাইব্রেরিগুলো ব্যস্ততার মাঝেও এক নিঃশব্দ শান্তি। ‘বেঙ্গল বুক’ শুধু বই বিক্রি করে না, ওখানে নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা, বুক রিভিউ সেশন, শিশুদের বইপাঠ কর্মশালাও হয়। আর ‘পাঠক সমাবেশ’? এখানেও নিয়মিত চলে আলোচনাসভা, প্রকাশনা অনুষ্ঠান, পুরোনো বই আদান-প্রদান। এ ছাড়া ‘বাতিঘর’, ‘নালন্দা লাইব্রেরি’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগার এসব জায়গায় এখনো চোখে পড়ে একাগ্র পাঠক।

তবে প্রযুক্তি মানেই শত্রু এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। অনেকেই আজ ই-বুক ও অডিও-বুককে এক ধরনের ‘প্রবেশদ্বার’ হিসেবে দেখছেন, যেখান থেকে পাঠকের ছাপা বইয়ের প্রতি আগ্রহ জন্ম নেয়। ডিজিটাল যুগ মানুষকে দিচ্ছে গতির নেশা, আর বই দিচ্ছে স্থিরতা। ছাপা বই হয়তো দ্রুতগামী দুনিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। কিন্তু সেটাই তো তার শক্তি। সে তাড়া দেয় না, সে বসতে বলে, সময় নিয়ে পড়তে বলে, ভাবতে বলে। একটি বই যখন হাতে নিই, আমরা শুধু গল্প পড়ি না, নিজের ভেতরে যাই, নিঃশব্দে। ছাপা বইয়ের সঙ্গে সত্যিকার সংযোগ তৈরি হয় তখনই, যখন একটা পাতার পাশে নিজের মন বসে যায় নিঃশব্দে। আজকের জটিল সময়ে, হয়তো প্রয়োজন একটু ধীর হওয়া। একটু নিজের দিকে ফিরে তাকানো। আর সেই পথ দেখায় একটি ছাপা বই। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫