Logo
×

Follow Us

ফিচার

উজানে চীনের বৃহত্তম বাঁধ : বাংলাদেশের ভাগ্যে আরেকটি ‘ফারাক্কা’

Icon

গৌরাঙ্গ নন্দী

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৩:০৩

উজানে চীনের বৃহত্তম বাঁধ : বাংলাদেশের ভাগ্যে আরেকটি ‘ফারাক্কা’

ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপরে বাঁধ তৈরি করবে চীন

ভাটির দেশের মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নেই। যেহেতু ভাটিতে অর্থাৎ নিম্নভাগে আমাদের বসবাস, তাই উজানে বা উত্তরের অংশে বসবাসকারীদের চাপিয়ে দেওয়া সব সমস্যা আমাদেরই সইতে হয়। আর উজানের বাসিন্দারা যদি ধনী ও শক্তিধর হয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। কারণে-অকারণে শক্তিধররা দুর্বলের ওপর শাসানি, চোখ রাঙানি অথবা নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে চাপিয়ে দেয়। কখনো বা পরিকল্পিতভাবে, ইচ্ছে করেই। 

গাঙ্গেয় এই ব-দ্বীপটিতে উজান হতে মোট ৫৭টি নদী এসেছে। এর মধ্যে ৫৪টি ভারত থেকে আর তিনটি মিয়ানমার থেকে। এই নদীগুলো সব আমাদের দেশের ওপর প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। নদীগুলোর বেশির ভাগ উৎস হিমালয় পর্বতমালা। নদীর উৎস উত্তরে হওয়ায় উজানে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হলে ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের বিপদ বাড়ে; আমরা বন্যায় তলিয়ে যাই। আবার শুষ্ক মৌসুমে যখন পানির প্রয়োজন হয়, তখন আমরা তা পাই না। কারণ উত্তরের দেশ পানির প্রবাহ আটকে দেয়, ফলে ভাটির দেশ হিসেবে আমরা শুকিয়ে মরি।

পদ্মার উজানে গঙ্গার ফারাক্কায় ভারতের দেওয়া বাঁধের প্রতিক্রিয়ার কথা জানি। এতে শুষ্ক মৌসুমে আমরা প্রয়োজনীয় পানি থেকে বঞ্চিত হই; আবার ভারি বর্ষায় তারা পানি ছেড়ে দিলে আমরা তলিয়ে যাই। মিষ্টি পানির প্রবাহ আমাদের দেশে কমেছে, বিপরীতে সমুদ্রের নোনা পানি দেশের ক্রমাগত উত্তরের দিকে উঠছে। দক্ষিণ-পশ্চিমের সুন্দরবন তার প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। ভারত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় ভাটির দেশের 

দাবি-প্রয়োজন অস্বীকার করে একতরফাভাবে পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে। 

এবারে চীনও সেই ভূমিকায় আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। চীন বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ নির্মাণকাজ শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ক্লিন এনার্জি (নবায়নযোগ্য জ্বালানি) উৎপাদনের লক্ষ্যে এই বাঁধ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে চীন। বলা হচ্ছে, এটি মেগা ড্যাম। এখানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। চীনের প্রধানমন্ত্রী এটিকে ‘শতাব্দীর প্রকল্প’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিব্বতের ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর এই বিশাল কাঠামোটি নির্মিত হবে। ২০২০ সালে চীনের চৌদ্দতম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এই প্রকল্পের কথা বলা হয়েছিল। এই মেগা প্রকল্পে পাঁচটি ক্যাসকেড জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকবে, যা বাস্তবায়নে প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান বা ১২৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। 

জলবিদ্যুৎ তৈরি মানেই বিশাল পরিমাণে পানি আটকে রাখা। আর এই পানি আটকে রাখায় উজানসংলগ্ন অঞ্চলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যেমনটি হয়েছিল আমাদের কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে। এর সামাজিক প্রভাব ছিল ভয়াবহ। চাকমা রাজার বাড়ি তলিয়ে যায় রাঙামাটির লেকে। আর জাতিগতভাবে চাকমা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা হয়েছে গৃহহারা ও দেশছাড়া। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মৃত্যু হয়েছে অনেকের। তৈরি হয়েছে বাঙালিদের প্রতি ঘৃণা-আক্রোশ। আর এ থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। সাংপোর অবকাঠামো তৈরির আশপাশেও এসব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। 

গত ডিসেম্বরে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘চীন ভাটির দেশগুলোর সঙ্গে বর্তমান তথ্যবিনিময় চ্যানেল বজায় রাখবে এবং দুর্যোগ প্রতিরোধ ও প্রশমনে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। 

ইয়ারলু সাংপো বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘতম নদী। চীন, ভারত ও বাংলাদেশজুড়ে এ নদী বিস্তৃত। তিব্বতে যা সাংপো, আসামে তাই ব্রহ্মপুত্র। ভারতের অরুণাচল প্রদেশ এবং আসাম রাজ্য হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার পাখিউড়া গ্রামে এই নদীটি ব্রহ্মপুত্র নামে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলো হয়ে ব্রহ্মপুত্র যমুনায় মিলিত হয়েছে, যা মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে তিনবার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা হচ্ছে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ১৯২০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ৬৮ বছরে এই অববাহিকায় মোট ৪৬৪ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। যার তীব্রতা রিখটার স্কেলে ৫ থেকে ৮ মাত্রার মধ্যে। এর আগে ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল এবং ১৮৯৭ সালের ১২ জুনে সংঘটিত দুটি ভূমিকম্প ছিল ভয়াবহ রকমের বিধ্বংসী। এতে ব্রহ্মপুত্র নদসহ একাধিক শাখা ও উপ নদ-নদীর প্রবাহে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। 

গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের সম্মিলিত ধারাটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ গড়ে তুলেছে। জোয়ার-ভাটায় সৃষ্ট এই ব-দ্বীপটি এখনো তার গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের একাধিক মোহনার মধ্যে মেঘনা মোহনা, যা দিয়ে পানি নির্গমণের পরিমাণ সর্বাধিক। মেঘনার মোহনা দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১০ লাখ ৮৬ হাজার ৫০০’ কিউবিক ফুট পানি প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ছে। যার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে আসছে প্রতি সেকেন্ডে সাত লাখ কিউবিক ফুট। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদী ব্যবস্থাপনায় সাগরে পতিত পানি পরিমাণের দিক দিয়ে বিশ্বে তৃতীয়। এই প্রবাহ যে পরিমাণ তলানি বা অবক্ষেপ (পলি, কাদা, বালু ইত্যাদি) বহন করে তার পরিমাণ বছরে ১.৮৪ বিলিয়ন টন। বিশ্বের যেকোনো নদ-নদীর তুলনায় এই অবক্ষেপের পরিমাণ সর্বাধিক। এর মধ্যে শুধু ব্রহ্মপুত্র নদের মাধ্যমে পরিবাহিত অবক্ষেপের পরিমাণ বছরে গড়ে ৫২৭ মিলিয়ন টন। 

উর্বরা ভূমি ও অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার হওয়ায় অই অঞ্চলটি ঘনবসতিপূর্ণ। তাই সাংপোর বাঁধ ভাটি অঞ্চলের লাখো লাখো মানুষকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে। ভারত যেমন ফারাক্কায় তৈরি বাঁধ দিয়ে পানির ন্যায্য অধিকার হতে ভাটির দেশ বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে; তেমনি চীনেরও সুযোগ থাকবে এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ভাটির দেশ ভারত ও বাংলাদেশকে জব্দ করার। অবশ্য একেবারে দক্ষিণে হওয়ায় বাংলাদেশের বিপদ আরো বেশি। সাংপোর ভাটিতে ভারত একাধিক জলবিদ্যুৎ তৈরির পরিকল্পনা করছে। কারণ দরকষাকষিতে ভারত এগিয়ে থাকতে চায়। আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী চীনকে চাপে রাখার জন্য ভারতের এটি একটি কৌশল। যে সুযোগ বাংলাদেশ নিতে পারবে না। কারণ বাংলাদেশ এখনো আন্তর্জাতিক নদীবিষয়ক এই আইনে স্বাক্ষরই করেনি। অবশ্য চীনের আশ্বাসবাণীতে আমরা অনেকেই আশ্বস্ত হচ্ছি, যেটি কোনো কাজের কথা নয়। 

উজানে বাঁধ নির্মাণের ফলে ভাটির দেশে বন্যা, নদীভাঙন এবং পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। ভারতের ফারাক্কা বাঁধ এ ক্ষেত্রে বড় একটি উদাহরণ। তেমনি আমাদের দেশের অভ্যন্তরে নির্মিত নানা ধরনের বাঁধও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। যাতে মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পোল্ডার প্রকল্পের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় অভ্যন্তরের নদ-নদী-খাল মরেছে; জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে; সুন্দরবনের বুকে পলি পড়ে উঁচু হচ্ছে। কুষ্টিয়া এলাকায় জি-কে বা গঙ্গা-কপোতাক্ষ বাঁধ প্রকল্প নদীপ্রবাহ সংকুচিত করেছে। মেঘনা-ধনাগোদা বাঁধ প্রকল্প প্রত্যাশিত ফলাফল দেখাতে পারেনি। আর দেশের অভ্যন্তরে অপরিকল্পিত সড়ক (যা এক ধরনের বাঁধ) এই ব-দ্বীপের অবাধ পানিপ্রবাহকে বাধা দিয়েছে; ফলে নদীগুলো (প্রাকৃতিক নিষ্কাশন চ্যানেল) মরছে। 

দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে এখন জলাবদ্ধতা একটি প্রধান সমস্যা। পাহাড়ি ঢল, অতি বৃষ্টিতে বন্যা প্রায় স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাঁধের কারণে নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও কমে যেতে পারে, যা কৃষি এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলবে। সার্বিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। আমরা কী-এসব আমাদের ভবিতব্য বলে মেনে নেব!

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫