Logo
×

Follow Us

ফিচার

চিমু সভ্যতা : সন্তান বলিদানের এক নারকীয় ইতিহাস

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৩৫

চিমু সভ্যতা : সন্তান বলিদানের এক নারকীয় ইতিহাস

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা আছে, যা মানুষকে বিস্মিত করে, ভয় পাইয়ে দেয় এবং একই সঙ্গে কৌতূহল জাগায়। এর মধ্যে অন্যতম হলো পেরুতে শত শত শিশুকে বলিদান দেওয়ার ভয়াবহ ঘটনা, যা সামনে আসে ২০১৮ সালে। গবেষকরা নিশ্চিত হন, ধর্মীয় আচারের অংশ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ঠেকাতে বা দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে দেওয়া হয়েছিল এই বলিদান।

পেরুর উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলে আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিল চিমু সভ্যতা। তাদের স্থাপত্য, মৃৎশিল্প ও সেচব্যবস্থা ওই সময়ের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল। কিন্তু এই সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর অধ্যায়Ñশত শত শিশুর নৃশংস বলিদান। এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণারত একদল প্রত্নতাত্ত্বিক খুঁজে পেয়েছেন প্রায় ১৪০টি শিশুর দেহাবশেষ, যেগুলো মূলত সেই সময় বলি দেওয়া শিশুদের দেহাবশেষ।  ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে নারকীয় শিশু হত্যাযজ্ঞ।

চিমু সভ্যতা ছিল প্রাক-কলম্বিয়ান যুগের, যা বর্তমান পেরুর উত্তর উপকূলে চিমোর অঞ্চলে প্রায় ৯০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিকশিত হয়েছিল। মোচে সভ্যতার পতনের পর এই সভ্যতার উত্থান ঘটে এবং ইনকাদের আগমনের আগে এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চিমু সভ্যতা।

চিমুরা মূলত ছিল উত্তর পেরুর উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা। তারা ছিল চন্দ্র উপাসক। চন্দ্র, প্রকৃতি ও দেবতার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী উৎসর্গ করা তাদের ধর্মাচরণের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু একটি উন্নত সভ্যতা কেন তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, অর্থাৎ সন্তানদের উৎসর্গ করার মতো এমন চরম পথ বেছে নিয়েছিল?

এক সমৃদ্ধ সভ্যতার উত্থান

আনুমানিক ১২৫০ থেকে ১৪৭০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উত্তর পেরুর চিমোর অঞ্চলে চিমু সভ্যতা তার স্বর্ণযুগে পৌঁছেছিল। তাদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ ও মাছ ধরা। চিমুরা ছিল দক্ষ প্রকৌশলী; তারা মোচে নদী থেকে খাল কেটে প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে এক জটিল ও উন্নত সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, যার মাধ্যমে তারা তাদের প্রধান ফসল ভুট্টা ও তুলার চাষ করত।

তাদের রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল ‘চান চান’। এটি ছিল সে সময় দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম বৃহত্তম শহর। ধারণা করা হয়, সম্পূর্ণ মাটির তৈরি এই নগরীতে প্রায় এক লাখ মানুষ বাস করত, যাদের বিশাল প্রাসাদগুলো আজও তাদের স্থাপত্য দক্ষতার সাক্ষী হয়ে আছে। চিমু সংস্কৃতি মৃৎশিল্প ও ধাতুশিল্পে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। 

তাদের তৈরি কালো রঙের মৃৎপাত্রগুলোর নকশা ছিল স্বতন্ত্র, যেগুলোর আকৃতি হতো বিভিন্ন প্রাণী বা মানুষের মতো। পাশাপাশি সোনা, রুপা ও তামার সংকর ধাতু ব্যবহার করে তারা অসাধারণ অলংকার ও ব্যবহার্য সামগ্রী তৈরি করত।

ভয়াবহতম শিশু বলিদানের ইতিহাস উন্মোচন

চিমু সভ্যতার এই সমৃদ্ধ ইতিহাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর রহস্যটি উন্মোচিত হয় ২০১১ সালে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অর্থায়নে প্রত্নতাত্ত্বিক গ্যাব্রিয়েল প্রিয়েতোর নেতৃত্বে একটি দল প্রথমে ৪২টি শিশুর দেহাবশেষ খুঁজে পায়। পরবর্তী গবেষণায় এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪০-এ, যদিও কিছু প্রত্নতাত্ত্বিকের মতে, মোট ২৬৯ জন শিশু এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল।

এই শিশুদের বয়স ছিল ৫ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে, তবে বেশির ভাগেরই বয়স ছিল ৮ থেকে ১২ বছর। কঙ্কাল পরীক্ষা করে দেখা যায়, শিশুদের বুকের পাঁজর কেটে হৃৎপিণ্ড বের করে নেওয়া হয়েছিল, যা এই প্রথার চরম নিষ্ঠুরতম দিক। শিশুদের পাশাপাশি প্রায় ২০০টি কচি লামাকেও (উটজাতীয় পশু) বলি দেওয়া হয়েছিল, যেগুলোর বয়স ছিল ১৮ মাসেরও কম। প্রতিটি দেহ একইভাবে সজ্জিত ছিল, মাথা একদিকে, পা অন্যদিকে। অনেকের পরনের পরিধেয় রঙিন কাপড়ের চিহ্ন ছিল। কিছু দেহে আঁকা ছিল লাল রঙের দাগ, যা ধর্মীয় চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই আবিষ্কার মেক্সিকো সিটির টেম্পল মায়োরে পাওয়া ৪২টি শিশুর বলিদানের ঘটনাকেও ছাপিয়ে গেছে। এটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ইতিহাসের বৃহত্তম শিশু বলিদানের নজির।

কেন এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ?

চিমুরা কোনো লিখিত ইতিহাস রেখে না যাওয়ায় এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া কঠিন। তবে সবচেয়ে জোরালো যে তত্ত্বটি উঠে এসেছে, তা হলো প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দেবতাদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা শিশুদের কঙ্কালের স্তূপের সঙ্গে শুকনো কাদামাটির স্তর খুঁজে পেয়েছেন, যা প্রমাণ করে যে সেই সময়ে এই অঞ্চলে ‘এল নিনো’র প্রভাবে ভয়াবহ বন্যা ও অতিবৃষ্টি হয়েছিল। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, ফসল নষ্ট হয় এবং সভ্যতা এক চরম সংকটের মুখে পড়ে। গবেষকদের ধারণা, চিমুরা বিশ্বাস করত যে তাদের দেবতারা রুষ্ট হয়েছেন। তাই দেবতাদের শান্ত করতে এবং সভ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে তারা তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ শিশুদের উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়। 

কার্বন ডেটিং পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে, এই বলিদান ১৪০০ থেকে ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল, যা তাদের পতনের ঠিক আগেকার সময়। ধারণা করা হয়, তৎকালীন শাসক বা ধর্মগুরুদের নির্দেশেই সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে এই শিশুদের জীবন বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল।

একটি সভ্যতার পতন

১৪৭০ সালে ইনকা সম্রাট টুপাক ইনকা ইউপানাকির বাহিনী চিমুদের পরাজিত করে এবং তাদের শেষ রাজা মিনচামাঙ্কামানকে বন্দি করেন। এর মাধ্যমে চিমু সাম্রাজ্য ইনকাদের অধীনে চলে আসে এবং একটি স্বাধীন শক্তি হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। ইনকাদের আক্রমণের মাত্র ৫০ বছর আগেই যে এই ভয়ংকর শিশু বলিদানের ঘটনা ঘটেছিল, তা চিমু সভ্যতার হতাশাজনক পরিস্থিতির দিকেই ইঙ্গিত করে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫