Logo
×

Follow Us

ফিচার

পোশাকশিল্পের সুরক্ষায় দরকার স্থিতিশীলতা

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১২:৩১

পোশাকশিল্পের সুরক্ষায় দরকার স্থিতিশীলতা

পাট ছিল একসময়ে বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। এ কারণে পাটকে স্বর্ণসূত্র বলা হতো। পাটকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের খুলনার খালিশপুরে যে পরিমাণ কারখানা গড়ে ওঠে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। একইভাবে ১৯৫০ সালে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার তীরে সিদ্ধিরগঞ্জের সুমিলপাড়ায় আদমজী জুটমিল গড়ে ওঠে ২৯৭ একর জমির ওপর। এখানে উন্নতমানের পাট ব্যবহার করে বিভিন্ন পাটজাত দ্রব্য প্রস্তুত করা হতো। কিন্তু সত্তরের দশক থেকে প্লাস্টিক ও পলিথিন পাটতন্তুর বিকল্প রূপে আত্মপ্রকাশ করলে পাটের স্বর্ণযুগের অবসান হয়। অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর ২০০২ সালের ৩০ জুন কলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, সারা দেশে এমন অনেক পাটকলই বন্ধ হয়ে যায়। ততদিনে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামোও ভেঙে গেছে।

এ সময় আবির্ভাব ঘটে পোশাক শিল্পের। ফলে গ্রামের কর্মহীন নারী-পুরুষের কাজের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তৈরি পোশাক শিল্প। যদিও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু ষাটের দশকে। তবে সত্তরের দশকের শেষের দিকে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। গ্রামের লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষের কাজের সংস্থান হয় এই পোশাকশিল্পের মাধ্যমে। পোশাকশিল্পের বিকাশ নারীকেও দিয়েছে নতুন পথের দিশা। ঘরকন্যা করা, নির্যাতিত নারী যখন আয়ের সংস্থান খুঁজে পায় তাদের অধিকারের জায়গাটিও প্রশস্ত হয়। তৈরি পোশাক শিল্পের কারণে এমন অজস্র মানুষের কাজের সংস্থান হয়েছে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্প খাত। ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু তৈরি পোশাক শিল্প থেকেই রপ্তানির পরিমাণ ৪২.৬১৩ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮১.৮১ শতাংশ। 

কিন্তু টানা পৌনে দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমছে। কানাডা, আমেরিকাসহ ইউরোপের প্রধান ৯টি বাজারেও রপ্তানি আয় কমেছে ৮.৭৯ শতাংশ। তবে জাপানসহ অনেক নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়ায় সার্বিকভাবে এ খাতে রপ্তানি আয় বেড়েছে। যদি মার্কিন প্রশাসনের অতিরিক্ত আরোপিত শুল্ককাঠামো অব্যাহত থাকে তাহলে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাড়তে পারে। কারণ পোশাকশিল্পের রপ্তানি বাড়াতে সরকার বিভিন্ন খাতে নীতি সহায়তা দিচ্ছে। তার পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে আগামী দিনে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও বাণিজ্যনীতির পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সদ্যবিদায়ি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১৮৫ কোটি ডলার, অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ১৯৯ কোটি ডলার, জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ১৯০ কোটি ডলার ও এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ১৮১ কোটি ডলার পণ্য দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গড় হিসাবে পৌনে দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি কমছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলো হচ্ছে ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা ও কম্বোডিয়া। এর মধ্যে ভারতে শুল্ক ৫০ শতাংশ। অন্য দেশগুলোতে ১৯ থেকে ২০ শতাংশ। বাংলাদেশেও ২০ শতাংশ। এ হিসাবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রায় সমান পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের বাড়তি নীতি সহায়তা পাচ্ছে। এখন দরকার স্থিতিশীলতা। এই স্থিতিশীলতার সংকটের কারণে বাংলাদেশ থেকে কাজ ভারত, শ্রীলঙ্কামুখী হচ্ছে। অন্যদিকে দেখা যায়, তৈরি পোশাক শিল্পের প্রধান ৯টি বাজারের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। যেটা আর্থিক হিসাবে গত প্রান্তিকে ছিল ১৮১ কোটি ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে জার্মানি, গত প্রান্তিকে তাদের কাছে রপ্তানি করা হয়েছে ১১৫ কোটি ডলার। এর পরে রয়েছে যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, কানাডা ও বেলজিয়াম। এদিকে নতুন বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চীন, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, আগামী দিনে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। এখন প্রয়োজন উদ্যোক্তাদের পণ্য বহুমুখীকরণের দিকে নজর দেওয়া। দক্ষতা বাড়িয়ে পণ্যের উৎপাদন খরচ কমানো। তাহলে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা আরো বাড়বে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিক নেতাদের বক্তব্য থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তাহলো গত বছরে দুই শতাধিক গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে প্রায় তিন লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়েছে। এদের অধিকাংশই আইনানুগ বেতন পায়নি। যেসব কারখানা চালু আছে তারাও শ্রমিকদের সময়মতো বেতন দেয় না। তাদের পাওনা সুবিধা দেয় না। ফলে শ্রমিক অসন্তোষ একটি প্রাত্যহিক ব্যাপার। আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, গার্মেন্টস শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে বসেছেন। পুলিশ পিটালে তারা পুলিশের সঙ্গে পাল্টা আক্রমণে নামছেন। শ্রমিকরা এভাবে কেন নামেনÑএ প্রশ্ন ইয়াসমিন নামের এক শ্রমিককে করলে তিনি বলেছিলেন, বাসায় গিয়ে সন্তানের খাবারের জন্য চিৎকার শোনার থেকে বন্দুকের গুলির শব্দ শোনা অনেক কম কষ্টের।

শ্রমিক অসন্তোষ থাকলে কাজ বন্ধ থাকে। ফলে বিদেশি ক্রেতারা আমাদের দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, মালিকদের অতি লোভের কারণে শ্রম পরিবেশ বজায় না থাকায় উৎপাদন ও রপ্তানি ঝুঁকিপূর্ণ ভেবে এবং সময়মতো কাজ না পাওয়ার ভয়ে কাজের অর্ডার দিতে চায় না। এই অস্থিতিশীলতাই আমাদের উৎপাদন ও অর্থনীতির জন্য মূলত অশনিসংকেত। এ ক্ষেত্রে পোশাক শিল্প-কারখানায় স্থিতিশীলতা বজায় রেখে ক্রেতাদের সংশয় কাটানোর বিকল্প নেই। নতুবা আমেরিকা শুল্ক কমালেও পোশাকশিল্পের সংকট কাটবে না। এ ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় নিয়ে ভাবা দরকার। 

আমাদের দেশে পোশাক রপ্তানি যে খুব কমেছে তা নয়। কিন্তু অর্ডার পাওয়া নিয়ে মালিকদের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা চলে তার ফলে পোশাকের মূল্য যে হারে বৃদ্ধি হওয়ার কথা, সেটা হচ্ছে না। আমাদের দেশে শিল্প-কারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নেই। ব্যাংক-বীমা, আমদানি-রপ্তানিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরকারের যথাযথ সেবা না দিতে পারায় শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্রে সংকট বাড়ছে। অন্যদিকে কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতার মধ্যে শ্রমিকরা মজুরি ও সার্ভিস বেনিফিট না পাওয়ায় তারা বাধ্য হন আন্দোলনে যেতে। শ্রমিক অসন্তোষ বন্ধ করতে মালিক ও সরকার যথাযথ দায়িত্বও পালন করছে না। ফলে পরিবেশে স্থিতিশীলতা না আসায় কাজেও স্থিতিশীলতা আসছে না। এ ক্ষেত্রে মার্কিন শুল্কনীতি শিল্পের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেও সরকার ও মালিকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনে আন্তরিক হতে হবে। নতুবা সংকট নিরসন কষ্টকর। 

পোশাক খাতের প্রাণ হলো শ্রমিক। শ্রমিকের জন্য চাই বেতন ও সার্ভিস বেনিফিট। যেটা পেলে কারখানায় ঝামেলা থাকে না। সরকার ও মালিকপক্ষ মিলে সেটা নিশ্চিত করলে পোশাকশিল্পের সংকট দূর হবে। শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক ভালো না হলে আমেরিকা শুল্ক কমালেও তা কতটা কাজে আসবে তা ভাবা দরকার। কাজের পরিবেশ স্থিতিশীলতা পোশাক ক্রেতাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি। সেটা নিশ্চিত করতে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫