
ফ্যাশন শুধু পোশাক নয়, এটি মানুষের সংস্কৃতি, পরিচয় ও সময়ের প্রতিচ্ছবি। প্রাচীন সভ্যতার প্রতীকী পোশাক থেকে শুরু করে আজকের প্রযুক্তিনির্ভর, বিশ্বায়িত ফ্যাশনের যাত্রা দীর্ঘ ও পরিবর্তনশীল। ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি প্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ফ্যাশন একজন মানষের ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাস ও সৃজনশীলতা তুলে ধরতে সাহায্য করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সামাজিক আন্দোলন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন ফ্যাশনকে পরিণত করেছে এক গতিশীল সাংস্কৃতিক শক্তিতে।
প্রাচীন বিশ্বের ফ্যাশন
প্রাচীন যুগে পোশাকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল লজ্জা নিবারণ। সে সময়ও পোশাক শুধু লজ্জা নিবারণে সীমাবদ্ধ ছিল না, অতিরিক্ত গরম ও ঠান্ডা থেকে সুরক্ষার বিষয়টিও যুক্ত ছিল এর সঙ্গে। তা ছাড়াও পোশাকের ধরন, কাপড়ের মান একজনের সামাজিক অবস্থান, ক্ষমতা ও বিশ্বাসের পরিচয় বহন করত।
প্রাচীন মিশরে অতি গরম আবহাওয়া থেকে বাঁচতে হালকা লিনেন কাপড় ব্যবহার করা হতো। ধনীরা সূক্ষ্মভাবে ভাঁজ করা পোশাক, সোনার গয়না ও পরচুলা দিয়ে নিজেদের সাজাত, যা মর্যাদা ও ঐশ্বর্যের প্রতীক ছিল। প্রাচীন গ্রিসে সরল ড্র্যাপারি, পেপ্লোস মার্জিত রুচির পরিচয় বহন করত।
প্রাচীন রোমে রোমানরা ‘টোগা’ পরিধান করত। এটি ছিল চওড়া ও লম্বা একটি থান কাপড়। টোগা ছিল রোমান পরিচয় এবং রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতীক। নির্দিষ্ট কিছু রঙের টোগা কেবল রাজ্যে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পরিধান করতে পারত, যেমন-বেগুনি রঙের পাড়যুক্ত টোগা শুধু সম্রাট এবং সিনেটরের জন্য সংরক্ষিত ছিল।
রেনেসাঁ ও বারোক যুগ
১৪ থেকে ১৭ শতকের রেনেসাঁ যুগে ফ্যাশন নতুন রূপ পায়। রাজদরবারগুলো তখন ফ্যাশনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সেখানে
রাজা-রানী এবং অভিজাতরা পোশাকের মানদণ্ড নির্ধারণ করতেন। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্সের রানী ক্যাথেরিন ডি মেডিসি এবং ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের জাঁকজমকপূর্ণ স্টাইল ফ্যাশনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল।
এই সময় ফ্যাশনের বৈশিষ্ট্য ছিল জমকালো ডিজাইন, দামি কাপড় ও সূক্ষ্ম কারুকাজ। সেলাইয়ের উন্নতির ফলে পোশাক আরো মজবুত হয়। সিল্ক, ভেলভেট, ব্রোকেডের মতো বিলাসবহুল কাপড়ে সূচিকাজ, লেইস ও রত্ন দিয়ে সাজানো পোশাক জনপ্রিয় হয়। রঙিন কাপড়ের দাম বেশি থাকায় এটি ধনীদের সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে।
রেনেসাঁর পর ১৭ শতকের বারোক যুগে বড় রাফলস, লেইস কলার, বিশাল স্কার্ট ও জমকালো পরচুলা ফ্যাশনকে আরো নাটকীয় করে তোলে।
সবার জন্য ফ্যাশন
১৮৫৮ সালের দিকে চার্লস ফ্রেডরিক ওর্থ প্যারিসে মেইজন কোটিউরার (Misson Couturier) স্থাপন করলেন; যার বাংলা অর্থ ফ্যাশন হাউস, যা পরবর্তী সময়ে হাউস অব ওর্থ (Hoous of Worth) নামে পরিচিতি পায়।
তার তৈরি পোশাকে নিজের নাম সেলাই করে লেবেল হিসেবে বসিয়ে দিতে লাগলেন। সেই সঙ্গে গণহারে পোশাক বানানোর পরিবর্তে তিনি তার ক্রেতাদের বুঝাতে শুরু করলেন যে কাকে কী পরলে ভালো লাগবে, কার জন্যে কেমন ডিজাইন বা নকশা মানাবে ইত্যাদি। ফ্যাশনের এই ধরনটিকে বলা হয় হাউট কোটিউর (Haute Couture)। এর আগ পর্যন্ত কেউ হাউট কোটিউর এবং রেডিমেড গার্মেন্টসের মধ্যে পার্থক্য সেভাবে বুঝত না। তাই বলা চলে ১৮ শতক থেকেই ফ্যাশন ডিজাইন জগতের যাত্রা শুরু হয়। এর আগে যা ছিল তাকে মূলত কস্টিউম ডিজাইন বলেই উল্লেখ করা যেতে পারে। আর তাই চার্লস ফ্রেডরিক ওর্থকে বলা হয় ফ্যাশন ডিজাইনের জনক। ১৮ শতকের শেষের দিকে শিল্পবিপ্লব ফ্যাশন জগতে আমূল পরিবর্তন আনে। যান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে পোশাক তৈরি পদ্ধতি বদলে যায়, যা ফ্যাশনকে অভিজাতদের বিলাসিতা থেকে সবার জন্য সহজলভ্য করে তোলে।
বিংশ শতক ফ্যাশনের বিপ্লবী সময়
২০ শতক ছিল ফ্যাশন জগতে এক যুগান্তকারী সময়। শতকের শুরুতে হাউট কোটিউর (haute courure) ডিজাইনারদের মর্যাদা আকাশচুম্বী করে তোলে। কোকো শ্যানেল নারীদের জন্য আরামদায়ক, ব্যাবহারিক ও মার্জিত পোশাক প্রবর্তন করে ফ্যাশনে বিপ্লব আনেন।
১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে হলিউড তারকাদের গ্ল্যামারাস স্টাইল প্রভাব বিস্তার করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাপড়ের রেশনিং পোশাককে আরো ব্যাবহারিক করে তোলে।
মজার ব্যাপার হলো ১৯২০-৪০-এ দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের থমথমে সময়ে ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে সিনেমা ভীষণ জনপ্রিয় হলো আর সিনেমার মাধ্যমে ফ্যাশনও ছড়িয়ে গেল দ্রুত গতিতে। ইতিহাসের পাতায় প্যারিস ফ্যাশনের এই সময়টাকে বলা হয় ‘ফ্রেঞ্চ ফ্যাশনের সোনালি অধ্যায়’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রচুর কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কয়েক বছরের জন্য স্থবির হয়ে যায়। যদিও ১৯৬০ সালের মধ্যেই হাওয়া বদল হতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে প্যারিস হয়ে ওঠে ফ্যাশনের রাজধানী। সে সময় ফ্যাশন এতটাই মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে যায় এবং দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।
২১ শতকে প্রযুক্তির ছোঁয়া
একুশ শতকে প্রযুক্তির কল্যাণে ফ্যাশন ডিজাইন উৎপাদন ও বিপণন সবখানেই বিপ্লব ঘটেছে। কম্পিউটার-এইডেড ডিজাইন (CAD) দ্রুত ও নিখুঁতভাবে ডিজাইন করতে সাহায্য করছে। থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের ফলে জটিল কাস্টমাইজড পোশাক তৈরির সুযোগ হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফ্যাশন ট্রেন্ড ছড়িয়ে দেওয়ার পদ্ধতি বদলে দিয়েছে। ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, পিন্টারেস্ট ডিজিটাল রানওয়েতে পরিণত, যেখানে ইনফ্লুয়েন্সার, সেলিব্রিটি ও সাধারণ মানুষ মিলে ফ্যাশনকে আরো গণমুখী করে তুলেছে। ই-কমার্স বিশ্বব্যাপী কেনাকাটাকে সহজ করে দিয়েছে।
ফ্যাশনের বিবর্তন চলছে এবং চলবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) এবং টেকসই অনুশীলনের সমন্বয় শুধু ফ্যাশন ডিজাইন ও উৎপাদন পদ্ধতিই নয়, বরং পোশাক ব্যবহার ও উপভোগের পদ্ধতিতেও বিপ্লব ঘটাতে চলেছে। এই উন্নয়নগুলো এমন একটি ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করছে, যেখানে সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তির মিলন ঘটবে।