Logo
×

Follow Us

ফিচার

যেখানে হাতি সেখানেই তারা

Icon

ইশতিয়াক হাসান

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৫, ১৭:১২

যেখানে হাতি সেখানেই তারা

ছবি : বন বিভাগ ও ইআরটি সদস্যদের সৌজন্যে

হ্যাংলা-পাতলা গড়নের লোকটার চুল কাঁধ ছোঁয়া লম্বা। কখনো সামনে কখনো অদৃশ্য গাছপালার ফাঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ। আবার কিছুক্ষণ পরই কোথা থেকে যেন ভেসে এসে আমাদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করছেন। লোকটির নাম সোনা মিয়া। ইনানীর জঙ্গলের কাদামাখা, পিচ্ছিল এক জায়গা পেরোনোর পর আবার হাজির হলেন লোকটি। হেসে বললেন, ‘দুশ্চিন্তা কইরেন না মামা, হাতির কাছে নিয়াই যাব। কিছু হবে না।’ সোনা মিয়া না বললেও আমি বুঝতাম সমস্যার কিছু নেই। ইনানীর জঙ্গল আর এখানকার হাতিদের তার চেয়ে বেশি আর কে চেনে! সত্যি নির্বিঘ্নেই ইনানীর জঙ্গলে হাতি দর্শনের ব্যবস্থা করেছিলেন এই কথার আধঘণ্টা পরই। হাতিরাও বিরক্ত হয়নি একটুও। সোনা মিয়া ইনানীর এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্য। একটি দলের দলনেতাই তিনি। আমাদের আজকের গল্প এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম নিয়ে।

সোনা মিয়া ইনানীর বনকে চেনেন হাতের তালুর মতো। বললেন, ‘কাল রাতে সমতলে নেমেছিল হাতিরা। ইআরটির সদস্যরা এগুলোকে সরিয়ে দিলে পরে খালের দিকে আসে পানি খেতে। ওই সময় কিছু সুপারি বাগান ভাঙে।’

কক্সবাজারের ইআরটি টিমের সদস্যরা।        ছবি : বন বিভাগের সৌজন্যে

আপনাদের কাজটা কী? জানতে চাইলাম তার কাছে। বললেন, ‘আমরা হাতি আসার খবর পেলেই মানুষকে সাবধান করি। সঙ্গে বাঁশি, সাইরেন, মাইক-এসব থাকে। এগুলো দিয়ে নানা শব্দ করে হাতিদেরও লোকালয় থেকে সরিয়ে দিই। মামা বলে আদর করে বললে ওরা ঝামেলা করে না, চলে যায়। আবার আমরা মানুষকেও বুঝাই, হাতিদের যেন উত্ত্যক্ত না করে।’

বাংলাদেশে এখনো ১৩টি জেলায় বুনো হাতির বিচরণ আছে। বন বিভাগের হিসাবে এসব এলাকায় অন্তত ১৫৯টি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম কাজ করছে। এর মধ্যে শুধু গারো পাহাড় অঞ্চলে ময়মনসিংহ বন বিভাগের অধীনে আছে ৫২টি টিম। কক্সবাজারের উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগ মিলিয়ে আছে আরো ৪৭টি।

এই টিমগুলোই হাতি-মানুষ দ্বন্দ্বের মধ্যস্থতাকারী। সাধারণত একেক দলে ১০ জন করে সদস্য থাকেন। তবে কখনো ১২ থেকে ১৫ জনের বড় দলও হয়, তবে এ রকম দলের সংখ্যা কম। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ও আরণ্যক এই দুই সংস্থার উদ্যোগেই বেশির ভাগ টিম গড়ে ওঠে। তাদের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ হতো, কর্মশালা হতো, এমনকি সদস্যদের জন্য একটা ছোট্ট সম্মানিও ছিল। কিন্তু ফান্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেই সহযোগিতা উঠে গেছে। এখন এসব টিম পুরোপুরি বন বিভাগের ভরসায়, আর টিমের সদস্যরা কাজ করেন একেবারেই স্বেচ্ছাসেবক হয়ে। ঝড়-বৃষ্টি, রাত-বিরাত, হাতির সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ বাঁচানো কিংবা হাতিকে নিরাপদে ফেরানো-সবই করেন নিছক ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থেকে।

অন্যান্য রেঞ্জ অফিসের মতো ইনানী রেঞ্জ অফিসও গাছপালার কোলে বসে থাকা এক শান্ত আশ্রয়। চারপাশে নাম জানা না-জানা বিভিন্ন গাছ, লতাগুল্ম, বাতাসে ভেজা পাতার গন্ধ। পাখিদের ডাকের ফাঁকে ফাঁকে ভেসে আসে দূরের ঢেউয়ের মৃদু গর্জন। এই সবুজের ভেতরেই আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল ইনানী বন রেঞ্জের রেঞ্জার ফিরোজ আল আমিনের সঙ্গে। সেদিন সময় কম ছিল, তাই ফোনে আবার কথা হলো তার সঙ্গে। হাসিখুশি গলায় বললেন, ‘ইনানীতে মোট সাতটা এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম আছে, সব মিলিয়ে সদস্য ৭০ জন। আগে চারটি আরণ্যক চালাত, তিনটি আইইউসিএন, তবে তখনো তারা বন বিভাগের সঙ্গেই কাজ করত। এখন পুরোপুরি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে বন বিভাগের মাধ্যমেই চলছে। ভাতা দিতে পারছি না।’

রেঞ্জার ফিরোজ আরো বললেন, ‘হাতি রক্ষায় আর হাতি-মানুষ সংঘাত ঠেকাতে ওরা অসাধারণ কাজ করে। বর্ষায় হাতি কম নামে, তাই কাজও একটু কম হয়। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে, যখন হাতি খাবারের খোঁজে লোকালয়ে নামে, তখন ওদের ব্যস্ততা চরমে ওঠে। ধান পাকার মৌসুমেও সারারাত পাহারায় থাকে। হাতি নামার খবর পেলেই এলাকার মানুষ আর বন বিভাগকে সতর্ক করে। এমনকি মামা, মামা বলে হাতির সঙ্গে ওরা এমনভাবে কথা বলে, যেন বহু দিনের আত্মীয়।’

তার কথায় বোঝা গেল ইনানীতে হাতি নিয়ে বড় কোনো সংঘাত না হওয়ার পেছনে ইআরটিরই হাত রয়েছে। ডাক পড়লেই ওরা ঝড়-বৃষ্টি, রাত-অন্ধকার উপেক্ষা করে ছুটে যায়, বাঁশি, সাইরেন আর মানুষের হাতের উষ্ণতা নিয়ে।

ইনানীর জঙ্গলের হাতির পাল দেখা শেষ। আমরা বের হব জঙ্গল থেকে, সঙ্গীও তৈরি, কিন্তু সোনা মিয়া রয়ে গেলেন বন বাগানের কাজে। যাওয়ার সময় হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ভাই, আমাদের কথা একটু লিখবেন। দিনের বেশির ভাগ সময় বনের ভেতর কাটাই। হাতিগুলোর জন্য কষ্ট হয়, কিছু করতে পারলে ভালো লাগে। বনেই থাকতে চাই সব সময়। কিন্তু আমাদেরও তো পেট আছে’ তার গলা খানিক ভারী হয়ে এলো। 

বললেন, ‘দুই দিন আগে এক বাড়িতে সাপ ঢুকছিল, আমি যেতে পারিনি, ভাতিজাকে পাঠালাম। সাপ ওকে কামড়ে দিল। এখন কক্সবাজার হাসপাতালে ভর্তি। খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।’

ইনানী থেকে মনে পড়ল গারো পাহাড়ের কথা। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে হাতি নিয়ে কাজ করছেন গারো যুবক কাঞ্চন মারাক। তার সূত্রে আলাপ হলো মধুটিলা এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের দুই সদস্য আব্দুর রাজ্জাক (৪০) ও আরফান আলী (৩৩)-এর সঙ্গে।

আব্দুর রাজ্জাক বললেন, ‘আমরা শুধু মানুষ আর ফসল বাঁচাই না, হাতিকেও বাঁচাই। কেউ ফাঁদ পাতলে বোঝাই এটা করবেন না।’ তার মুখে শুনলাম এক রাতের গল্প। ‘সমুশ্চুড়া গ্রামে চলে আসে হাতির পাল। এক বাড়িতে চড়াও হয় তারা, ভেতরে আটকে ছিলেন এক বৃদ্ধ। আমরা ছুটে গিয়ে উদ্ধার করতে চাই, কিন্তু উল্টো হাতির তাড়া খেলাম। শেষমেশ বাড়ির অন্য পাশ দিয়ে গিয়ে তাকে বের করি।’

একটু থেমে ধীরে বললেন, ‘আমরা স্বেচ্ছাসেবক। বেশি কিছু চাইতে ভালো লাগে না। কিন্তু বলতেই হবে আইইউসিএন ১২ বছর আগে যে সরঞ্জাম দিয়েছিল তার অনেকটাই এখন নষ্ট। রাতে মাঠে নামতে হয়, সাপের ভয় থাকেÑকিছু দিন আগে বিষধর সাপের সামনে পড়েছিলাম, আমাদের গামবুট দরকার। বর্ষায় রেইনকোট দরকার। অনেকে দিন আনে দিন খায়­Ñরাতভর পাহারা দিয়ে সকালে আবার জীবিকার জন্য মাঠে নামা খুব কঠিন। কিছু পারিশ্রমিক বা সম্মানি হলে ভালো হতো। আশা করি বন বিভাগ আমাদের দিকে আরেকটু দৃষ্টি দেবে।’

তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরফান আলী যোগ করলেন, ‘আমাদের অনেক রকম অভিজ্ঞতা হয়। একবার একটা হাতি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। দুই সপ্তাহ পশু চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করানো হলো, আমরা ওটার গায়ে পানি দিয়েছি, খাবার জোগাড় করেছি। শেষে ওটা সুস্থ হয়ে গারো পাহাড় পেরিয়ে ভারতের গভীরে চলে যায়।’

জঙ্গলের গল্পগুলো শুনতে শুনতে মনে হলো হাতি-মানুষের এই নীরব যুদ্ধের প্রকৃত নায়করা আসলে এরাই। বনের ভেতর বাঁশি, সাইরেন আর প্রাণপণ সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলো।

কাঞ্চন হাতি নিয়ে কাজ করেন এটা তো আগেই বলেছি। শেরপুরে হাতি বাঁচানোর যেকোনো উদ্যোগে তার নাম থাকবেই। কথায় কথায় বললেন, ‘শেরপুরে ইআরটির অনেক সদস্য আর সক্রিয় নেই। বড় কারণ, তারা হয় একেবারেই দরিদ্র, নয়তো দিন আনে দিন খায় ধরনের মানুষ। ধরেন হাতি যদি তিন মাস এলাকায় থাকে, আর প্রতি রাত পাহারা দিতে হয় তাহলে তারা জীবিকা চালাবে কীভাবে? আবার অনেকের সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে গেছে, কেউ কেউ নিজের পয়সায় লাইট কিনেছেন। নতুন সরঞ্জাম দেওয়া দরকার। তা ছাড়া স্থানীয়দের সঙ্গে বন বিভাগের কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এটা কমাতে পারলে ভালো।’

এই কথাগুলো মনে নিয়েই বন বিভাগের বন্যপ্রাণী বিভাগের বন সংরক্ষক মো. ছানাউল্ল্যা পাটওয়ারীর সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন, ‘সত্যি বলতে, ইআরটির জন্য আলাদা কোনো ভাতার ব্যবস্থা নেই। তবে বন বিভাগের চারা রোপণ, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কাজে তারা অগ্রাধিকার পায়, এগুলো থেকে কিছু অর্থ জোটে। আর হাতি সংরক্ষণের একটি প্রকল্প সম্প্রতি শুরু হয়েছে। এর আওতায় প্রশিক্ষণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দৈনিক ৫০০ টাকার ভাতার সুযোগ হয়েছে।’

সম্প্রতি ইআরটিদের প্রশিক্ষণ দিতে গিয়েছিলেন ড. রেজা খান। দুই দিনে ১০টি দলকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তার কাছেই জানতে চাইলাম অভিজ্ঞতা। বললেন, ‘দুই দিনের প্রশিক্ষণ ছিল শেরপুরে। এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্যরা এতে অংশ নেন। আমরা হাতির সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা উচিত এটা শেয়ার করি, পাশাপাশি হাতি নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা শুনি। কোন পরিস্থিতিতে হাতি কেমন আচরণ করতে পারে বিভিন্ন জায়গার তথ্যের আলোকে আমরা তাদের জানাই। মূলত হাতি-মানুষ বোঝাপড়া বাড়ানো এবং সংঘাত এড়ানোই এই প্রশিক্ষণের অংশ।’

ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন মো. মাহফুজুর রহমান। গারো পাহাড়ে বারবার ছুটে গিয়েছেন হাতির টানে। এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্যদের সঙ্গে হাতিদের বাঁচাতে ও হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব দূর করতে বসেছেন যখন সুযোগ পেয়েছেন তখনই। মাহফুজ বললেন, ‘আইইউসিএন দায়িত্ব ছাড়ার পর টিমগুলো কিছুটা অগোছালো হয়েছিল, তবে কাজ থেমে যায়নি। বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, বরং সদস্য সংখ্যা বেড়েছে। এখন শুধু গারো পাহাড়েই ৫২টি ইআরটি আছে। এদের অনেকের জমি-ফসলও হাতির ক্ষতির শিকার হয়, তাই হাতি নিয়ে কাজ করা তাদের নিজের প্রয়োজনও।’

তিনি আরো যোগ করেন, ‘গত বছর হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব বেড়ে যাওয়ায় টিমগুলোকে আবার সক্রিয় করা হয়েছে। আমার মনে হয়, সদস্যদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব না হলেও গামবুট, বর্ষাতির মতো সরঞ্জাম সরবরাহ করা উচিত। আর এতগুলো দল না রেখে সংখ্যা কমিয়ে আরো পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করাই ভালো।’

নতুন যে ‘হাতি সংরক্ষণ প্রকল্প’ শুরু হয়েছে, তার প্রকল্প পরিচালক ও বন বিভাগের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের বন সংরক্ষক জহির আকন বললেন, ‘আমাদের প্রকল্প আর্থিকভাবে ছোট। ইআরটি মূলত স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম। তবে এর আওতায় আমরা সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দেব। সামান্য কিছু আর্থিক অনুদানের কথাও ভাবছি।’

হাতির চলার পথ আর মানুষের বসতির এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম। তারা না থাকলে হয়তো সংঘাত হতো আরো বড়, ক্ষতি হতো আরো বেশি, আর বন হারাত তার শান্তি। কিন্তু তাদের হাতে সরঞ্জাম কম, পকেটে টাকা নেই আছে শুধু সাহস, দায়িত্ববোধ আর হাতি আর মানুষকে একসঙ্গে বাঁচানোর স্বপ্ন। সেই স্বপ্নটাই তাদের রাত জেগে বাঁশি আর সাইরেন বাজাত, টর্চ হাতে অন্ধকারে ছুটে যেতে প্রেরণা দেয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫