Logo
×

Follow Us

ফিচার

মধ্যরাতের সূর্য এবং উত্তরের আলোর আবাসে

Icon

সৌরভ মাহমুদ

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১৫:২৯

মধ্যরাতের সূর্য এবং উত্তরের আলোর আবাসে

ওই দেখা যায় বোডো শহর

নরওয়ের ছোট্ট শহর অরনেস থেকে আরো উত্তরে দুই ঘণ্টা জাহাজ চলার পর মনে হলো নীল রঙের দুনিয়ায় চলে এসেছি। চকচকে রোদ আর আকাশের প্রতিবিম্ব সমুদ্রের জলকে গাঢ় নীলে রাঙিয়ে দিয়েছে। সামুদ্রিক পাখির ছায়াটাও যেন নীল। 

দুপুর ১টার সময় সুমেরু বৃত্তের মধ্যে অবস্থিত বোডো শহরে পৌঁছে যাই। জাহাজের ছাদ থেকেই দেখা গেল স্যান্ডহর্নেট পর্বতমালা, এই পর্বতমালার প্রান্তেই বোডো শহর অবস্থিত। বোডোকে বলা হয়-উত্তরের আলোর আবাস! 

জাহাজ থেকে নেমে দেখতে পেলাম একটি শিশু স্প্রে রং দিয়ে নর্দান লাইটের সবুজ আভা দেওয়ালে আঁকছে। তার নিচে পর্বতের চূড়া ও নরওয়েজিয়ান পাইন গাছ। অদ্ভুত সুন্দর চিত্রটি দেখে প্রমাণ মিলল-এ শহর উত্তরের আলোর শহর। চিত্রটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। জাহাজের অভিযাত্রী দক্ষিণ আফ্রিকার এক নারীও আমার মতোই অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন চিত্রটির দিকে।

বোডো শহরকে দুপুরে খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। তখনো পুরো শহর বরফে আচ্ছাদিত। একটি পার্কে গিয়ে দেখলাম তিনটি শিশু বরফের মধ্যে খেলছে। পার্কের পাশেই নর্ডল্যান্ড মিউজিয়াম, সাপ্তাহিক বন্ধ থাকায় মিউজিয়ামের ভেতরটা দেখা হলো না। শহরের দোকানপাটও সব বন্ধ। ফলে কোনো সুভেনিয়র কেনা হলো না। 

বোডো টাউন হল ভবন থেকে বন্দর তেমন দূরে নয়। প্রায় দুই ঘণ্টা শহরে হাঁটাহাঁটি করেছি এবং শহরের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছি। এটি পরিপূর্ণ শহর। বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং রেলওয়ে স্টেশন-সবই হাঁটার দূরত্বে। বোডো নর্ডল্যান্ড কাউন্টির রাজধানী। এ শহর আর্কটিক সার্কেলের ঠিক উত্তরে অবস্থিত। এখানে ২ জুন থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত মধ্যরাতের সূর্যের দেখা মেলে। 

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মেলস্ট্রম বা ঘূর্ণিবাত বোডোতে। এই ঘূর্ণিবাত নিয়ে বহু শতাব্দী ধরে কল্পকথা রয়েছে। ঘূর্ণিবাতের কারণে জাহাজের অদৃশ্য হয়ে যাওয়াকে সামুদ্রিক দানবদের কাজ বলে মনে করা হতো। ১৮৪৫ সালের শেষদিকে এনসাইক্লোপিডিয়া মেট্রোপলিটানায় এরিক পন্টোপ্পিডানের বর্ণনায় আধমাইল আকারের সমুদ্রের দৈত্যদের দ্বারা জাহাজডুবি নিয়ে পর্যালোচনা ছিল। লেখক এডগার অ্যালান পো, ওয়াল্টার ময়েস, জুল ভার্নসহ অনেক লেখকের কাছে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল এই মেলস্ট্রম বা ঘূর্ণিবাত। এই ঘূর্ণিবাতকে আমরা ঘোল বলে জানি। বাংলাদেশের বড় বড় নদীতে এ রকম ঘূর্ণিবাত দেখা যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সামুদ্রিক ঈগলের আবাস বোডোতে। শহরের বাড়িগুলোর দেওয়ালে তাই ঈগলের ছবির দেখা মেলে।

বোডোর আশপাশের গ্রামগুলো মনোরম ও প্রাণবন্ত। অনেক চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছে এখানে। প্রায় ১০ হাজার বছর আগে এখানে মানুষের বসতি গড়ে ওঠে। বোডোর সালটেন ফিয়র্ডে প্রচুর মাছ এবং সামুদ্রিক পাখির কারণে বসতি স্থাপনকারীরা আকৃষ্ট হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। 

বোডো শহরের গোড়াপত্তন হয় ১৮১৬ সালে। প্রথম ২০ থেকে ৩০ বছর এ শহরের বাসিন্দা ছিল মাত্র ২০০ জন। ১৮৬০ সালে উপকূলে হেরিং মাছের আগমন ঘটে এবং পরবর্তী ২০ বছর এর উপস্থিতি বাড়ার কারণে শহরটি দ্রুত বৃদ্ধি পায়, ব্যাপক শিল্পের বিকাশ ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হামলায় বোডো শহরে তিন হাজার ৭০০ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছিল। যুদ্ধের পরে একটি বিমান পরিসেবা চালু হয় শহরে, যা শহরটিকে একটি প্রধান যোগাযোগ কেন্দ্রে পরিণত করে। শহরটিও যুদ্ধের পরে নতুন করে গড়ে ওঠে। 

বোডো শহর ছেড়ে পরবর্তী গন্তব্য স্ট্যামসুন্ড যেত যেতে পড়ন্ত বিকেল। বোডো থেকে স্ট্যামসুন্ডের সমুদ্রপথও অসাধারণ সুন্দর। একদিকে মহাসাগর এবং অন্যদিকে সারি সারি পর্বতমালা। সমুদ্রের মাঝে ছোট ছোট অসংখ্য অনেক দ্বীপ। এসব দ্বীপ বরফে আচ্ছাদিত। কোনো কোনো দ্বীপে আছে মেরুন রঙের জেলেদের বাড়ি। কোথাও দু-একটি বাতিঘর। স্ট্যামসুন্ড আসার পথে একটি পর্বতমালা দেখে বিস্ময় লেগেছে। পর্বতমালার কয়েকটি পর্বতের আকৃতি ও অবস্থান দেখতে পিরামিডের মতো। 

স্ট্যামসুন্ড হলো একটি ছোট গ্রাম। গ্রামটির সমুদ্র এলাকাও মাছের জন্য বিখ্যাত। এটি লোফোটেন দ্বীপপুঞ্জের ভেস্টভ্যাগয় দ্বীপের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। স্ট্যামসন্ডের জনসংখ্যা এক হাজার। গ্রামটিতে পর্যটকদের থাকার জন্য কয়েকটি হোটেলও আছে। গ্রামটির আশপাশের পাহাড়গুলো হাইকিংয়ের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। এখানে এসে একটি ভাইকিং জাদুঘর দেখলাম। সেদিন সন্ধ্যায় আকাশে কোনো মেঘ ছিল না। রাতের আকাশে উত্তরের আলো দেখার যথেষ্ট সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের জাহাজ ছুটে চলল আরো উত্তরের দিকে। 


লেখক : প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ও পর্যটক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫