Logo
×

Follow Us

ফিচার

আদিবাসী ওঁরাওদের গল্পকথা

Icon

বাবুল চন্দ্র সূত্রধর

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৫৮

আদিবাসী ওঁরাওদের গল্পকথা

উৎসবপ্রিয় ওঁরাও জনগোষ্ঠী

শ্রেয়তর জীবন ও জীবিকা, সামাজিক ও বৈষয়িক নিরাপত্তা, যুদ্ধবিগ্রহ প্রভৃতি বহুবিধ কারণে মানবগোষ্ঠী বিভিন্ন স্থানে বসতি নির্মাণ করেছে এবং তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট স্থানে স্থায়ী হয়েছে। এই ধারা অবলম্বনেই একসময় বাংলায় আগমন ঘটেছিল বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর; যাদের মধ্যে রয়েছে ওঁরাও, সাঁওতাল, মাহাতো, মাহালী, কড়া, বাগদী, মুণ্ডা, রাখাইন, ভূমিজ, রাজোয়াড়, খাসিয়া, ত্রিপুরা প্রভৃতি  জনগোষ্ঠী। বাংলার মাটি ও মানুষের প্রকৃতিগত বদান্যতা যেকোনো জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করতে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। অবশ্য বাংলাদেশের সরকারি গেজেটে তাদের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে ৫০টি জনগোষ্ঠীর তালিকা আছে। এই তালিকার প্রথম নামটিই ওঁরাও জনগোষ্ঠীর। 

ওঁরাও, উরাও বা উরাং-এর আভিধানিক অর্থ ‘মানুষ’। তাদের ভাষার নাম কুরুখ, যার অর্থ ‘বক্তা’। ওঁরাওরা তাদের ভাষার নাম অনুসারে ‘কুরুখ’ নামেও পরিচিত। ‘সাদরী’ নামেও এই ভাষার পরিচিতি রয়েছে। ভাষাটি বাংলা ভাষা থেকে খুব একটা ভিন্নতর মনে হয় না। একটি দেশাত্মবোধক গানের কথা এখানে উল্লেখ করা যায় : 

কুরুখ বা সাদরী : 

প্রভুকে ভক্তি কারালো

বাংলা মাইকে বাসো না যে ভালো। ... ...

মুক্তিবাহিনী দাদামানে স্মরণ রাখো না রাতে-দিনে

তুহিনীকের তুহিনীকের জরে স্বাধীন বাংলা পালো॥ ... ...

বাংলা :

প্রভুকে ভক্তি করলাম

বাংলা মাকে ভালোবাসলাম। ... ... 

মুক্তিবাহিনী দাদাদেরে স্মরণ কর রাতে-দিনে 

তারা ছিল বলে স্বাধীন বাংলা পেলাম॥ ... ...

নৃবিজ্ঞানীদের মতে, ওঁরাওরা দ্রাবিড়-ভাষী কুরুখ জনগণের বংশধর। মোগল আমলে ভারতের প্রাচীন কঙ্কণ অঞ্চল (মহারাষ্ট্র প্রদেশের পূর্বাঞ্চল ও কর্ণাটক প্রদেশের উত্তরাঞ্চল) থেকে ওঁরাওরা বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ওঁরাও জনগোষ্ঠীর ইতিহাস আরো প্রাচীন। ৬৫ হাজার বছরেরও আগে আফ্রিকা থেকে এক বিশাল জনগোষ্ঠী এশিয়া তথা ভারতবর্ষের দিকে আসে, যারা নৃতত্ত্বে প্রোটো-অস্ট্রেলয়েড নামে পরিচিত। ওঁরাওরা এই জনগোষ্ঠীর অংশ বলে নৃতাত্ত্বিকরা মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশে বসবাসরত মুণ্ডা, সাঁওতাল ও মালপাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ওঁরাওদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তারাও প্রোটো-অস্ট্রেলয়েড জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। অবশ্য ওঁরাওরা ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে দ্রাবিড় পরিবারের আওতায় পড়ে; তাই এরা প্রোটো-অস্ট্রেলয়েড কি না, সে বিষয়ে কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানী সন্দেহ প্রকাশ করেন।

ওঁরাও জনগোষ্ঠীর লোকজন বাংলাদেশের উত্তরের বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, পাবনা জেলা এবং 

দক্ষিণ-পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে এবং উত্তর অঞ্চলের বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট জেলায় বাঙালিদের সঙ্গে বসবাস করছে। বলা আবশ্যক যে, বাংলাদেশের রাজশাহী, নওগাঁ ও দিনাজপুর জেলায় ওঁরাওদের বসবাস সর্বাধিক। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, ওড়িশা ইত্যাদি রাজ্যে বিপুলসংখ্যক ওঁরাও বাস করে। চীন ও মিয়ানমারেও তাদের বসবাস রয়েছে। 

ওঁরাওরা এশিয়ার পাঁচটি বৃহত্তম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি। বাংলাদেশে বসবাসকারী ওঁরাওদের সংখ্যা প্রায়  এক লাখ ২০ হাজার। 

ধর্মীয় চেতনায় ওঁরাওরা সর্বপ্রাণবাদী প্রকৃতি পূজারী, যা বৃহত্তর অর্থে সনাতন ধর্মের অধীন। ওঁরাওরা জন্মান্তরবাদী। এ কারণে তারা বিদেহী আত্মার কল্যাণার্থে কতিপয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। এই আদিবাসীর কিছু লোক খ্রিষ্ট ধর্মেও দীক্ষিত হয়েছে। ধর্মান্তরিত হলেও একদিকে যেমন তারা খ্রিষ্টান ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে, ঠিক তেমনি তাদের ঐতিহ্যবাহী নানা পূজা-পার্বণও পালন করে থাকে। 

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উৎসবপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। ওঁরাওদের প্রধান উৎসবটি হলো কারাম পূজা। স্মরণাতীত কাল থেকে গোটা ওঁরাও জনগোষ্ঠী কারাম উৎসব পালন করে অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধা সহকারে। সঙ্গে যথাসাধ্য জাঁকজমকও। কারাম মূলত একটি বৃক্ষের নাম, যা ওঁরাওদের কাছে যাবতীয় পবিত্রতা, মঙ্গল ও সুরক্ষার প্রতীক। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উৎসব শুরু হয়ে তিন দিনব্যাপী একনাগাড়ে পালিত হয় কারাম উৎসব। এ ছাড়া তারা সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান যেমন-বিয়ে, জন্ম, পূজা-পার্বণ প্রভৃতিতে নাচ-গান পরিবেশন করেন। তাদের সংগীত ও নৃত্যে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র যেমন তাসি, তরুমুরু, আন্তই, খোল, কাঁসি, একতারা, সানাই, মুখবাঁশি, সারিন্দা, দোতারা ও করতাল ইত্যাদি ব্যবহার করতে দেখা যায়।

ওঁরাওরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। যেমন : লাকডা, তিগ্যা, তিরকী, বিন্ডো, বাড়োয়ার, খাখা, কেরকেটা, টপ্প্য, এক্কা, খালকো, লিন্ডা, মিনজ, বাকলা, বাড়া, পান্না, বেক, কুজুর প্রভৃতি। একই গোত্রের সদস্যকে ওঁরাওরা একই বংশের সন্তান বলে মনে করে, ফলে তাদের একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ওঁরাওদের শারীরিক গঠন অনেকটা বাঙালিদের মতোই। বর্তমানে ওঁরাও ও বাঙালি ভেদ করার তেমন কোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্য নেই বলেই দেখা যায়। একান্ত প্রয়োজন না হলে তারা আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সেবা তেমন একটা গ্রহণ করেন না। কারণ বুনিয়াদী লোকচিকিৎসার প্রতি তাদের অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাস রয়েছে। মাটির ঘরে বসবাস করা ওঁরাওদের বহুকালের ঐতিহ্য। তবে বর্তমানে বাঙালিদের মতো তারা পাকা ঘরের দিকে বেশ ঝুঁকে পড়েছে; তবে এর সংখ্যা খুব বেশি নয়।

আধুনিক যুগে বসবাস করলেও বেশির ভাগ ওঁরাও ছেলেমেয়ে আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকছে। নিতান্ত অল্প বয়সেই এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা মা-বাবার সঙ্গে অর্থ উপার্জনে নেমে পড়ে। আবার বাংলা ভাষা তাদের কাছে অনেকটা অপরিচিত এবং নিজেদের ভাষার কোনো লিখিত রূপ বা বর্ণমালা নেই, কেবল কথ্য ভাষায়ই এর প্রচলন রয়েছে। অল্প বয়সেই ছেলেমেয়েরা মুখে মুখে নিজেদের ভাষাজ্ঞান, লোকসংগীত, ছড়া, গান, ধাঁধা ও প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদি শেখে।  

সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের মতো এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি পারিবারিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বটে, কিন্তু তাদের অবস্থান পুরুষদের থেকে অনেক নিচে। ওঁরাও আদিবাসী নারী-পুরুষ সবাই অত্যন্ত পরিশ্রমী; নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ আসবাব, গৃহে ব্যবহৃত বাসনপত্র নিজেরাই তৈরি করেন। এমনকি তারা নিজেদের তৈরি অলংকারাদি পরিধান করতে অধিক পছন্দ করেন। 

সাম্য, অর্র্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সর্বোপরি আত্মনিয়ন্ত্রণের আশায় ওঁরাওরা বাঙালিদের সঙ্গে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বটে, কিন্তু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা বাঙালিদের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য প্রভৃতি বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। সম্প্রতি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার ওঁরাও, সাঁওতাল রাজোয়াড় ও রায়Ñএই চারটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত এক গবেষণার প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, এসব জনগোষ্ঠীর লোকজনের পেশাগত পরিচিতির মূল অংশ গিলে ফেলেছে কৃষিশ্রমিক (৭০.০ শতাংশ) ও প্রান্তিক কৃষক (১৫.৫%); শিক্ষার চিত্র হলো নিরক্ষর ১৬.১ শতাংশ, দস্তখত জানে ২৫.৪ শতাংশ ও এসএসসি+ ২.৬ শতাংশ; 

কৃষিজমি নেই ৬৭.৩ শতাংশ ও বসতবাড়ী নেই ৩০.৫ শতাংশ; জমি হারানোর কারণ জাল দলিল ৭০.৪ শতাংশ ও জবর দখল ২৯.৬ শতাংশ। 

অধিকারকর্মী ও রাজশাহী কলেজের স্নাতকোত্তরের (ভূগোল বিভাগ) শেষ বর্ষের ছাত্রী ওঁরাও জনগোষ্ঠীর মেয়ে শ্রীমতী সুধা টপ্প্যকে এই পরিসংখ্যান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে অনেক নেতিবাচক লক্ষণের উপস্থিতি রয়েছে, যেমন-সরল স্বভাব, সহজ বিশ্বাস, শিক্ষায় কম অংশগ্রহণ, একতার অভাব, ঐতিহ্যবাহী পেশা (শ্রমিক বা দিনমজুর) এবং কম জনসংখ্যা। এসব কারণে বৃহত্তর সমাজের মধ্যে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা খুবই কম।’

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে এই ছোট পরিসংখ্যানগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় থাকা অত্যাবশ্যক। ওঁরাওদের সামাজিক সংগঠন ‘দিঘরী রাজা পরিষদ’-এর উপদেষ্টা ও  গোদাগাড়ী উপজেলাধীন গুণীগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি সুধীর চন্দ্র ওঁরাওদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সরকারি পরিসেবায় যুক্ত হতে না পারলে দারিদ্র্যপীড়িত ওঁরাওদের এগিয়ে যাওয়া কঠিন। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষেরও সজাগ হওয়া প্রয়োজন, এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন নাগরিক অধিকারের বিষয়ে নিজেদের সচেতন হওয়া, যা শিক্ষায় ব্যাপক অংশগ্রহণ ও ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে।’ 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫