Logo
×

Follow Us

ফিচার

তিন গোয়েন্দার ৪০ বছর

Icon

ইশতিয়াক হাসান

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৫, ১১:২০

তিন গোয়েন্দার ৪০ বছর

প্রতীকী ছবি

আজ থেকে ঠিক ৪০ বছর আগে, ১৯৮৫ সালের আগস্টে সেবা প্রকাশনী থেকে শুরু হলো এমন এক সিরিজ, যা বাঙালি কিশোর-কিশোরীদের টেনে নিয়ে গেল রহস্য-রোমাঞ্চের এক বিস্ময়কর জগতে। রকিব হাসানের সৃষ্টি ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের প্রথম বই তিন গোয়েন্দা প্রকাশ পায় সেদিন।

গত শতকের নয়ের দশকের গোড়ার দিকের কথা। হাতে হাতে ঘুরত তিন গোয়েন্দার বই। কয়েকজন বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরাও হব গোয়েন্দা। খুলে ফেললাম নিজেদের রহস্যভেদী দল। 

কি অদ্ভুত মজার সময় ছিল সেটা! অচেনা কাউকে দেখলেই মনে হতো সন্দেহজনক চরিত্র, কোনো গাড়ি দেখলেই ভেবে বসতাম সোনাভর্তি কিংবা চোরাচালানির গাড়ি। আবার রাস্তায় পড়ে থাকা কোনো অস্পষ্ট লেখা কাগজ চোখে পড়লেই মনে হতো এ নিশ্চয়ই গুপ্তধনের মানচিত্র! শুধু আমরা নই, তখনকার অগণিত কিশোর-কিশোরীই তিন গোয়েন্দা পড়ে গড়ে তুলেছিল নিজেদের গোয়েন্দা দল। বইয়ের পাতার সেই তিন ছেলেই যেন আমাদের স্বপ্ন আর শৈশবের খেলার আসল সঙ্গী হয়ে উঠেছিল।

বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীর মনে তিন গোয়েন্দার মতো এতটা নাড়া আর কোনো সিরিজ দিতে পারেনি। প্রথম বই প্রকাশের পর কেটে গেছে ৪০ বছর। সময়ের সঙ্গে আগের সেই উন্মাদনা কিছুটা ফিকে হলেও আজও পাঠক হন্যে হয়ে খোঁজেন পুরোনো কপি। এখনো নিয়ম করে বের হচ্ছে নতুন কাহিনি, আর অনলাইন বুক শপগুলোতে অ্যান্টিক হিসেবে চড়া দামে বিক্রি হয় রুপালি মাকড়সা, জলদস্যুর দ্বীপ কিংবা ঘড়ির গোলমালের মতো বই।

এবার তিন গোয়েন্দার কিছু হাঁড়ির খবর জানা যাক।

আপনি কি রবার্ট আর্থার জুনিয়র নামটা শুনেছেন? ‘তিন গোয়েন্দা’র জন্মের পেছনে তারই হাত। 

তিনি লিখতেন কিশোরদের জন্য দুর্দান্ত সিরিজ থ্রি ইনভেস্টিগেটরস। রকিব হাসান এই সিরিজ থেকেই নেন তিন গোয়েন্দার কাঠামো এবং প্রথম দিককার কয়েকটি কাহিনির আইডিয়া। লেখক কখনো লুকোননি যে সিরিজটি বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে লেখা। 

থ্রি ইনভেস্টিগেটরসের প্রথম বই দ্য সিক্রেট অব দ্য টেরর ক্যাসল প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। শুরুতে সিরিজটির নাম ছিল ‘আলফ্রেড হিচকক অ্যান্ড থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’। হলিউডের কিংবদন্তি পরিচালক আলফ্রেড হিচককের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছিল বই বিক্রি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে। 

প্রথম দিকের গল্পগুলোতে তিন গোয়েন্দাকে কেস দিতেন তিনিই। পাঠকরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, এই হিচককই তিন গোয়েন্দায় এসে হয়ে যায় আমাদের চেনা ডেভিস ক্রিস্টোফার।

প্রথম বই প্রকাশের পর জনপ্রিয়তা দেখে হতবাক হন আর্থার ও তার প্রকাশক র‌্যান্ডম হাউস। সে বছরই বের হয় দ্বিতীয় বই ‘দ্য মিস্ট্রি অব দ্য স্টাটারিং প্যারট’। যার অনুকরণে লেখা হয় তিন গোয়েন্দার অন্যতম জনপ্রিয় বই কাকাতুয়া রহস্য। সিরিজের শেষ অর্থাৎ ৪৩তম বই ছিল ‘দ্য মিস্ট্রি অব দ্য ক্রেংকি কালেক্টর’। তবে সব বই আর্থার লেখেননি; প্রথম ৯টি এবং ১১তম বই তার লেখা। পরেরগুলো লেখেন উইলিয়াম আরডেন, নিক ওয়েস্ট, এম ভি কেরি ও মার্ক ব্রান্ডেল।

থ্রি ইনভেস্টিগেটরসের তিন নায়ক ছিলেন জুপিটার জোনস, পিট ক্রেনশো আর রবার্ট বব। এদের ছাঁচেই জন্ম নেয় আমাদের কিশোর পাশা, মুসা আমান ও রবিন মিলফোর্ড। তবে কিশোর পাশাকে বানানো হয় বাঙালি চরিত্র, যাতে পাঠকেরা সহজে নিজেদের মেলাতে পারে। আর গল্প জমিয়ে তুলতে যোগ হলো শুঁটকি টেরি, যার আদলে ছিল থ্রি ইনভেস্টিগেটরসের স্কিনি নরিস। মূল সিরিজের পটভূমি ছিল আমেরিকার কল্পিত শহর রকি বিচ, প্রশান্ত মহাসাগরের ধারে। বই পড়ে অনেকেই ভেবেছিল এটি বাস্তব শহর, পরে জেনে মন খারাপ হয়েছিল সবার।

তিন গোয়েন্দার অনেক জনপ্রিয় চরিত্রই থ্রি ইনভেস্টিগেটরস থেকে নেওয়া, তবে রকিব হাসান কাহিনির প্রয়োজনে সবার মধ্যেই এনেছেন নতুনত্ব। এদিকে জিনা আর রাফিয়ান আসলে এসেছে এনিড ব্লাইটনের ফেমাস ফাইভ সিরিজ থেকে। আরো একটি মিল, ভূত থেকে ভূতের কাহিনির মূল সূত্র এসেছে থ্রি ইনভেস্টিগেটরসের ঘোস্ট টু ঘোস্ট হুক আপ থেকে। অর্থাৎ বিদেশি সিরিজের ছাঁচে শুরু হলেও রকিব হাসানের লেখনীর জাদু আর দেশি আবহে বদলে গিয়েছিল সবকিছু। 

কিশোরদের জন্য গোয়েন্দা সিরিজ লেখার প্রস্তাবটা প্রথমে দিয়েছিলেন রকিব হাসান। সেবার কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেনও তখন নতুন কিছু খুঁজছিলেন, কারণ তার জনপ্রিয় সিরিজ কুয়াশা বন্ধ হয়ে গেছে, আর সেবায় তখন শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা কিছু ছিল না। ফলে প্রস্তাবে সায় দিতে দেরি করেননি তিনি।

১৯৮৫ সালের আগস্টে প্রকাশিত তিন গোয়েন্দার প্রথম বইয়ে পাঠক এমনভাবে বুঁদ হয়ে গেল যে, কিশোর-মুসা-রবিন হয়ে উঠল আপনজন। রকিব হাসান কিংবা সেবা প্রকাশনী, কেউই হয়তো ভাবতে পারেনি এতটা সাড়া মিলবে। 

তবে এত বড় সাফল্য আসেনি এমনি এমনি। বিদেশি কাহিনি নিয়ে সেটিকে বাংলার পাঠকের মনের মতো করে তোলা মোটেও সহজ কাজ নয়। সেই কঠিন কাজটি সহজ করে ফেলেছিলেন রকিব হাসান চরিত্র আর কাহিনিকে বদলে, দেশি আবহে সাজিয়ে। 

কিন্তু একসময় ফুরিয়ে গেল থ্রি ইনভেস্টিগেটরসের ভান্ডার। তখন রকিব হাসান হাত বাড়ালেন অন্য বিদেশি লেখকদের কাহিনির দিকে। সেগুলোকেও তিনি এত দক্ষতার সঙ্গে রূপ দিলেন যে, জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। এভাবে টানা ২০০৩ সাল পর্যন্ত লিখলেন তিনি। এরপর দায়িত্ব নিলেন শামসুদ্দীন নওয়াব। এক পর্যায়ে তিন গোয়েন্দা ঢুকে গেল ভলিউম যুগে, এখন আর আলাদা একক বই বেরোয় না, ভলিউম হিসেবেই প্রকাশিত হয়। নওয়াবের গল্পেও হাজির হয় আগের প্রিয় চরিত্ররা-রাশেদ পাশা, মেরী চাচি, জিনা, রাফিয়ান, শুঁটকি টেরি, .সঙ্গে যোগ হয় নতুন অনেক চরিত্র।

শামসুদ্দীন নওয়াব নামে সবচেয়ে বেশি তিন গোয়েন্দা লিখেছেন কাজী শাহনূর হোসেন। শামসুদ্দীন নওয়াব নাম ব্যবহার করে তিন গোয়েন্দা লিখেছেন কাজী মায়মূর হোসেন, এমনকি স্বয়ং কাজী আনোয়ার হোসেনও। তার সৃষ্টি এক স্মরণীয় চরিত্র কাকাতুয়া ‘কিকো’।

অন্যদিকে রকিব হাসানও থেমে থাকেননি। তিন গোয়েন্দা নামে না হলেও প্রথমা প্রকাশনীসহ আরো কয়েক জায়গা থেকে কিশোর, মুসা আর রবিনকে নিয়ে লিখেছেন রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প। 

তিন গোয়েন্দার জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। এর কারণ যদ্দূর বুঝি, সময় পাল্টেছে। একসময় বই পড়া ছিল শিশু-কিশোরদের প্রিয় বিনোদন। এখন প্রযুক্তির ঝড় সেই আগ্রহকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। তবে এখনো কাকাতুয়া রহস্য, ভীষণ অরণ্য, মমি, রত্নদানো, জলদস্যুর দ্বীপ, বুদ্ধির ঝিলিক, বাক্সটা প্রয়োজন, অথৈ সাগর, ঘড়ির গোলমালের মতো বইগুলো খুঁজে বেড়ায় পাঠকরা। 

কিন্তু দুঃখের খবর হলো প্রিয় লেখক রকিব হাসান ভীষণ অসুস্থ। তার দুটি কিডনি প্রায় অকেজো। কখনো হাসপাতাল, কখনো বাসায়ই কাটছে দিন। তার বড় ছেলে রাহিদ হাসান বলেছেন, পাঠকরা যেন তার বাবার জন্য দোয়া করেন।

রাহিদের কাছ থেকে জানা গেল এক মজার ঘটনা। সাল ১৯৮৮-৮৯। তখন তিন গোয়েন্দা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তাদের বাসা ছিল তিলপাপাড়ায়। একদিন লেখক বাসায় নেই, বাইরে হঠাৎ হইচই। রাহিদের মা তাকেই পাঠালেন দেখতে। গিয়ে দেখে ২৫ থেকে ৩০ জন স্কুলগার্ল দাঁড়িয়ে আছে, সবাই অষ্টম বা নবম শ্রেণির ছাত্রী। তারা এসেছে শুধু রকিব হাসানের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য! ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা শেষে লেখক ফেরার পর তিন গোয়েন্দার বইয়ে সই নিয়েই তারা ফিরল। রাহিদ জানালেন, স্কুল-কলেজে পড়া ছেলেমেয়েদের ভিড় তাদের বাসায় ছিল নিত্যদিনের ঘটনা, তবে মেয়ে পাঠকের সংখ্যাই ছিল বেশি। 

সেবা প্রকাশনীর বর্তমান ম্যানেজার মমিনুল ইসলামেরও তিন গোয়েন্দা নিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা। সালটা ১৯৯৫। তিন গোয়েন্দা তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। মমিনুল তখন গুদামের দায়িত্বে। এ সময় বের হয় নিখোঁজ সংবাদ। আশ্চর্যজনকভাবে ১৫ দিনেই শেষ হয়ে যায় সব কপি। অথচ কম ছাপা হয়নি আগের তিন গোয়েন্দা থেকে। দ্রুত রিপ্রিন্ট হয় আবার। মমিনুল বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতায় এত দ্রুত কোনো বই শেষ হতে দেখিনি।’

তবে সবচেয়ে ঝক্কি পোহাতে হতো কিশোর, রবিন, মুসা যে বাস্তব চরিত্র নয়, এটা পাঠকদের বুঝাতে। অনেকেই ফোন দিয়ে কিশোর, রবিন ও মুসার সঙ্গে দেখা করতে চাইত। ছোট ছেলেমেয়েদের মন ভাঙতে চাইতেন না সেবা প্রকাশনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কখনো কখনো অবশ্য বুঝানোর চেষ্টাও করতেন না। বলতেন, ওদের বিষয়ে রকিব হাসানই বলতে পারবেন। কারণ যখন জানানো হতো চরিত্রগুলো পুরোপুরি কাল্পনিক, তখন হতাশ হয় অনেকেই।

সেবার জনপ্রিয় লেখক ডিউক জন। ছোটবেলাটা তারও কেটেছে তিন গোয়েন্দা নিয়ে উন্মাদনায়। শামসুদ্দীন নওয়াবের নামে একের পর এক তিন গোয়েন্দা লিখে চলা কাজী শাহনূর হোসেনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম এখন পর্যন্ত কতটা তিন গোয়েন্দা প্রকাশ পেয়েছে। জানালেন তিন গোয়েন্দার সর্বশেষ বইটি বের হয়েছে এই আগস্টে। এটা ভলিউম ১৬৪। তবে কোনো ভলিউমের আবার একাধিক খণ্ড থাকায় মোট ভলিউমের সংখ্যা ১৯৭। কাহিনির সংখ্যা ৬০০-এর আশপাশে। ভাবতে পারেন, একটি সিরিজের এত কাহিনি, চাট্টিখানি কথা নয়!

তিন গোয়েন্দা শুধু একটি বইয়ের সিরিজ নয়, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ছুঁয়ে যাওয়া এক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা। কেউ পড়তে পড়তে বানিয়েছে নিজেদের গোয়েন্দা দল, কেউ আবার সেই অনুপ্রেরণায় হয়ে উঠেছেন লেখক।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫