Logo
×

Follow Us

ফিচার

এল ডোরাডো

সোনার শহরের খোঁজে অনন্ত যাত্রা

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:০১

সোনার শহরের খোঁজে অনন্ত যাত্রা

প্রতীকী ছবি

শত শত বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ এক স্বপ্নের খোঁজে ছুটে চলেছে। সেই স্বপ্ন কখনো মানচিত্রে আঁকা কোনো শহর, কখনোবা শুধুই মরীচিকা। এ যেন মানুষের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অদম্য লোভ আর অজানাকে জানার তীব্র আকাক্সক্ষা। এই মরীচিকার সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম ‘এল ডোরাডো’, যেখানে ছড়িয়ে রয়েছে সোনার যত গুপ্ত ভান্ডার! কিংবদন্তি এই শহরকে ঘিরে কতই না কল্পকাহিনি রয়েছে। কিন্তু এল ডোরাডো শহরটি আদৌ কি তৈরি হয়েছিল? 

এল ডোরাডো নামটি শুনলেই মানুষের মনে এক সোনার রাজ্যের ছবি ভেসে ওঠে। যুগ যুগ ধরে এই নামটি অভিযাত্রী ও অনুসন্ধানীদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করে আসছে। এই আকর্ষণ কেবল অজানাকে জানার নেশায় নয়, এর পেছনে রয়েছে সোনার প্রতি মানুষের এক অদম্য লোভ। শত শত বছর ধরে ধন-রত্নের প্রতি তীব্র আকাক্সক্ষা থেকেই জন্ম নিয়েছে এই কাল্পনিক সোনার শহরের গল্প।

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয়দের মধ্যে এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, দক্ষিণ আমেরিকার কোনো এক অজ্ঞাত অংশে লুকিয়ে আছে সোনায় মোড়ানো এক শহর, যার নাম এল ডোরাডো। সেই সোনার শহরের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বহু অভিযাত্রী দল দক্ষিণ আমেরিকার গহিন রেইন ফরেস্ট এবং দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান চালিয়েছে, কিন্তু সেই সোনার সন্ধান আজ পর্যন্ত মেলেনি।

স্বর্ণনগরী কিংবদন্তির জন্ম

এল ডোরাডো কিংবদন্তির প্রকৃত উৎস কল্পিত কোনো শহর নয়। এটি ছিল কলম্বিয়ার এক প্রাচীন উপজাতি মুইসকাদের একটি বিশেষ অভিষেক অনুষ্ঠান। স্প্যানিশরা মূলত ‘এল হোমব্রে ডোরাডো’ (সোনায় খচিত মানুষ) বা ‘এল রেই ডোরাডো’ (সোনায় খচিত রাজা) শব্দগুলো ব্যবহার করত প্রাচীন মুইসকা জাতির প্রধান ‘জিপা’কে নির্দেশ করতে।  

মুইসকা সম্প্রদায় খ্রিষ্টপূর্ব ১২৭০ থেকে ৫০০ সালের মধ্যে কলম্বিয়ার চুন্দিনামার্কা ও বয়াকা অঞ্চলের উঁচুভূমিতে বসতি স্থাপন করে। মায়া বা ইনকাদের মতো মুইসকা সভ্যতাও যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। তাদের সমাজে নতুন রাজা নির্বাচনের সময় এক বিশেষ প্রথা প্রচলিত ছিল। নতুন জিপা বা রাজা তার দায়িত্ব গ্রহণের আগে প্রথমে নগ্ন করে তার সারা গায়ে আঠালো 

মাটির প্রলেপ দেওয়া হতো এবং এরপর স্বর্ণচূর্ণ দিয়ে মুড়ে দেওয়া হতো, যাতে তাকে জীবন্ত সোনার মূর্তি বলে মনে হয়। এরপর সোনা ও মূল্যবান পাথর দিয়ে সজ্জিত একটি ভেলায় করে তাকে ও তার সঙ্গীদের গুয়াতাভিতা হ্রদের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে হবু রাজা সূর্য দেবতার উদ্দেশে নিজের শরীর থেকে সব সোনা হ্রদের জলে ধুয়ে ফেলতেন এবং সঙ্গে আনা সোনা ও দামি পাথর বিসর্জন দিতেন। ভেলায় থাকা রাজার সঙ্গীরাও হ্রদের জলে সোনা ও মূল্যবান রত্ন নিক্ষেপ করত। এই প্রথাটিকে দেবতাদের প্রতি তাদের আনুগত্য ও ত্যাগের প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। এই অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু, সেই স্বর্ণমণ্ডিত রাজাকেই বলা হতো ‘এল ডোরাডো’। ১৬৩৮ সালে স্প্যানিশ লেখক জুয়ান রডরিগেজ ফ্রেইলে তার বই ‘দ্য কনকোয়েস্ট অ্যান্ড ডিসকভারি অব দ্য নিউ কিংডম অব গ্রানাডা’তে এই প্রথার বর্ণনা দেন, যা ইউরোপীয়দের কাছে এল ডোরাডোর প্রথম লিখিত বিবরণ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

তবে এই কিংবদন্তি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পেছনে একটি গভীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জড়িত ছিল। ১৬০০ শতকের শুরুর দিকে হার্নান কর্টেস মেক্সিকোয় অ্যাজটেক সাম্রাজ্য এবং ফ্রান্সিসকো পিজারো পেরোতে ইনকা সাম্রাজ্য জয় করে বিপুল পরিমাণ সোনা ও সম্পদ লুণ্ঠন করেন। এই অভাবনীয় সাফল্য স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের মধ্যে সম্পদের জন্য সীমাহীন লোভের জন্ম দেয়। তাদের এই লোভ এতটাই প্রকট ছিল যে, যখন তারা মুইসকাদের ‘এল হামব্রে ডোরাডো’ বা ‘এল রেই ডোরাডো’র গল্প শুনল, তখন তারা ধর্মীয় এই  প্রথাকেই কাল্পনিক সোনার শহর হিসেবে ভাবতে লাগল। লোভের বশবর্তী হয়ে বা খ্যাতির মোহে, বহু অভিযাত্রী এল ডোরাডোর সন্ধানে ভয়ংকর ও বিপৎসংকুল সব অভিযান পরিচালনা করেছে। কল্পকাহিনির পরিবর্তনের সঙ্গে এল ডোরাডোর অবস্থানও পরিবর্তিত হয়েছে। সোনার শহরের সন্ধান শুধু কলম্বিয়া বা গুয়াতাভিতা হ্রদের আশপাশে সীমাবদ্ধ থাকেনি, একসময় তা সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকায় এর অনুসন্ধান কার্য ছড়িয়ে পড়েছিল। এল ডোরাডোর সন্ধানে চালানো অভিযানগুলো অভিযাত্রীদের কাক্সিক্ষত সোনার শহর উপহার দিতে না পারলেও এর ফলে বহু ঐতিহাসিক স্থান ও সভ্যতা লোকচক্ষুর সামনে এসেছে।

স্বর্ণের খোঁজে অভিযান ও ট্র্যাজেডি

এল ডোরাডোর খোঁজে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং মর্মান্তিক অভিযানগুলোর মধ্যে একটি ছিল গনসালো পিজারো এবং তার লেফটেন্যান্ট ফ্রান্সিসকো দে ওরেয়ানার দুঃসাহসিক যাত্রা। ১৫৪১ সালে এল ডোরাডো এবং ‘ল্যান্ড অব সিনামোন’-এর সন্ধানে বিশাল এই অভিযানটি কুইতো থেকে শুরু হয়েছিল। তারা এল ডোরাডো খুঁজে না পেলেও এই অভিযানের সময়ই ওরেয়ানা আমাজন নদীর বিশালতা আবিষ্কার করেন, যা ইউরোপীয়দের কাছে সম্পূর্ণ অজানা ছিল।  পিজারোর দল ছিল নির্মম ও বর্বর। তারা আদিবাসীদের থেকে তথ্য আদায়ের জন্য তাদের নির্মমভাবে পুড়িয়ে মারত অথবা কুকুর দিয়ে তাদের টুকরো টুকরো করে ফেলত। তবে একসময় চরম দুর্ভোগ, খাবারের সংকট ও রোগাক্রান্ত হয়ে একে একে অভিযাত্রীরা মারা যেতে শুরু করে। একসময় দলটি পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।   

এই অবস্থায় পিজারো তার লেফটেন্যান্ট ওরেয়ানার দলকে খাবার খুঁজতে পাঠান। ওরেয়ানা তার ৫৩ জন সৈন্যের সঙ্গে একটি ভেলায় করে নদীতে রওনা হন। কিন্তু নদীর তীব্র স্রোতের বিপরীতে ফিরে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে সৈন্যদের বিদ্রোহের মুখে তিনি মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাত্রা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই ঘটনা একটি অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের জন্ম দেয়। এল ডোরাডোর খোঁজে বেরিয়ে ওরেয়ানা ও তার দল ১৫৪২ সালে সমগ্র অ্যামাজন নদী পাড়ি দেন এবং প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে আটলান্টিক মহাসাগরে পৌঁছান। অন্যদিকে পিজারো ও তার দল কোনো ধরনের সাফল্য ছাড়াই কুইতোতে ফিরে আসে। এল ডোরাডোর মরীচিকা পিজারোর দলকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিলেও সেই একই মরীচিকা ওরেয়ানার মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নদী আবিষ্কারে সহায়তা করে।  

এল ডোরাডোর গল্পে স্প্যানিশদের পাশাপাশি একজন ইংরেজ অভিযাত্রীর নামও জ্বলজ্বলে। তিনি স্যার ওয়াল্টার র‌্যালে। রানী এলিজাবেথের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠার পর তিনি তার শত্রুদের চক্ষুঃশূলে পরিণত হন। রানী এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় এবং তাকে লন্ডন টাওয়ারে বন্দি করা হয়। প্রায় ১৪ বছর বন্দি ছিলেন তিনি। এই দীর্ঘ কারাবাসেই র‌্যালে তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ রচনা করেন, যা প্রাচীন পৃথিবীর ভৌগোলিক ইতিহাসের একটি অনন্য দলিল।   

বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য র‌্যালে নতুন রাজা প্রথম জেমসের কাছে এল ডোরাডো সম্পর্কিত তার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আবেদন করেন। রাজা তার কথা বিশ্বাস করেন এবং ১৬১৭ সালে তাকে ক্ষমা করে দিয়ে পুনরায় গায়ানায় এল ডোরাডোর খোঁজে অভিযানে পাঠান। তবে শর্ত ছিল, স্প্যানিশদের সঙ্গে কোনো ধরনের বিবাদে জড়ানো যাবে না। দ্বিতীয়বারের এই অভিযান র‌্যালের জন্য এক প্রকার সুইসাইড মিশন ছিল। যখন তার দল রাজার আদেশ অমান্য করে স্প্যানিশ ফাঁড়িগুলোতে হামলা করে এবং ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে, তখন রাজা জেমস তার প্রতিপক্ষদের চাপে র‌্যালের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন। 

এই অনুসন্ধানের ফলে মানুষ কাক্সিক্ষত সোনার শহর না পেলেও এমন অনেক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপনা আমাদের সামনে এনেছে, যা এতদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। ইনকা সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘মাচু পিচু’ এমনই এক আবিষ্কার, যা এল ডোরাডোর অনুসন্ধানের পথেই আবিষ্কৃত হয়েছিল।

সংস্কৃতিতে এল ডোরাডোর ছায়া

সাহিত্যে, চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে সংগীতেও এই কিংবদন্তির গভীর ছাপ দেখা যায়। ষোড়শ শতকে এই শহরকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য একটি আর্টিকেল হুয়ান রড্রিগজ ফ্রেইলের ‘দ্য কনকোয়েস্ট অ্যান্ড ডিসকভারি অব দ্য নিউ কিংডম অব গ্রানাডা’। এ ছাড়া এডগার অ্যালেন পো তার বিখ্যাত কবিতা এল ডোরাডোতে এই স্বপ্নের এক মনমাতানো চিত্র এঁকেছেন, যা পাঠকের মনে বুনে দিয়েছে সোনায় মোড়া এক দেশকে খুঁজে দেখার অদম্য তৃষ্ণা।  অ্যালান পো বলেছিলেন, ‘এল ডোরাডো যেতে চাও, তবে চাঁদের পাহাড় পেরিয়ে, ছায়ার উপত্যকা ছাড়িয়ে, হেঁটে যাও, শুধু হেঁটে যাও।’

এই সোনার শহরকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে অসংখ্য সিনেমা ও অ্যানিমেশন। ১৯৬৬ সালে নির্মিত মার্কিন চলচ্চিত্র ঊষ উড়ৎধফড় কিংবা ২০০০ সালের জনপ্রিয় অ্যানিমেশন মুভি ঞযব জড়ধফ ঃড় ঊষ উড়ৎধফড়-এর কাহিনি এই সোনার শহরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া জেমস গ্রে-এর ঞযব খড়ংঃ ঈরঃু ড়ভ ত চলচ্চিত্রটিও মূলত সোনার শহরের খোঁজকেই বড় পর্দায় তুলে ধরেছে। এমনকি কলম্বিয়ান রক ব্যান্ড আটেরসিওপেলাডোস এবং বিশ্বখ্যাত শিল্পী শাকিরা তাদের অ্যালবামের নামকরণও করেছেন ‘এল ডোরাডো’। 

এল ডোরাডোর কিংবদন্তি কেবল ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা বাঙালি সংস্কৃতির গভীরেও প্রবেশ করেছে। বাঙালি পাঠক ও দর্শকের কাছে এই কাল্পনিক শহরটি নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করে সত্যজিৎ রায়ের অমর চরিত্র প্রফেসর শঙ্কুর হাত ধরে। তার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘প্রফেসর শঙ্কু ও এল ডোরাডো’ এই কিংবদন্তিকে এক নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করেছে। 

অন্যদিকে কিংবদন্তে পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-এর প্রসঙ্গেও এল ডোরাডোর ছায়া দেখা যায়। এই চলচ্চিত্রে কাঞ্চন নামে এক কিশোরের শহর কলকাতা যাত্রাকে ‘এল ডোরাডোর খোঁজে’ এক প্রতীকী অভিযাত্রার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। শঙ্কুর ক্ষেত্রে এটি এক নতুন আবিষ্কারের নেশা, আর কাঞ্চনের ক্ষেত্রে এটি জীবনের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে নিজের পরিচয় খুঁজে বের করার এক যাত্রা। 

এল ডোরাডো কি সত্যিই ছিল, যদি থাকেই, তাহলে কোথায়? শত শত বছর ধরে এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক গবেষণায় আজ প্রমাণিত যে এল ডোরাডো কোনো বাস্তব শহর না, বরং মানুষের কল্পনা, লোভ এবং অনুসন্ধানের এক মিলিত ফসল। এটি নিছক গুজব থেকে একটি আন্তর্জাতিক মিথ এবং সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে, সেই যাত্রাই এই কিংবদন্তির প্রকৃত তাৎপর্য। এল ডোরাডোর সত্যিকারের মূল্য সেই কল্পিত সোনার ভান্ডারে ছিল না, বরং সেই যাত্রায় নিহিত ছিল।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫