অপহরণকারীদের পক্ষে অস্ত্র তুলে নেয় প্যাট্রিশিয়া

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:০৬

অস্ত্র হাতে প্যাট্রিশিয়া ক্যাম্পবেল হার্স্ট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে হাইবারনিয়া ব্যাংকের সানসেট ব্রাঞ্চে ১৫ এপ্রিল ১৯৭৪-এর দুপুরে একদল সশস্ত্র ব্যক্তি ঢুকে পড়ে। সশস্ত্র ওই ব্যক্তিরা নিজেদের সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মির (এসএলএ) সদস্য হিসেবে ঘোষণা করে। বামপন্থি এই সংগঠনটি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে তখন ব্যাপক কার্যক্রম চালাচ্ছিল। এই খাতে অর্থের জোগান দিতেই ব্যাংক ডাকাতি শুরু করে তারা। তারই অংশ হিসেবে হাইবারনিয়া ব্যাংকের এই শাখা তারা লুট করতে আসে। তাদের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যাংকের ভেতরে অবস্থানকারী সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ে। প্রায় বিনা বাধায় তারা ব্যাংকের সব টাকা-পয়সা লুটে নেয়। তবে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ইচ্ছা করেই তারা সিসি ক্যামেরায় নিজেদের চেহারা দেখিয়ে যায়। এটি ছিল তাদের সংগঠনের প্রচার কৌশল।
বিপত্তি বাধল ব্যাংক ডাকাতিতে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে গিয়ে। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে সানফ্রান্সিসকোর পুলিশ দেখতে পায়, এক মাস আগে সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মির হাতে অপহৃত প্যাট্রিশিয়া ক্যাম্পবেল হার্স্ট অস্ত্র তাক করে ব্যাংকে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের হুমকি দিচ্ছেন! দৃশ্যটি দেখে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা আশ্চর্য হয়ে যান।
ঘটনাটি বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। ১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে উনিশ বছরের প্যাট্রিশিয়া হার্স্টকে অপহরণ করেন সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মির সশস্ত্র সদস্যরা। প্যাট্রিশিয়ার বাবা র্যান্ডলফ হার্স্ট ছিলেন এক্সামিনার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। প্যাট্রিশিয়ারা পারিবারিকভাবে ধনী ছিলেন।
প্যাট্রিশিয়াকে অপহরণ করার তিন দিন পর স্থানীয় রেডিও স্টেশনে চিঠি পাঠায় সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মি। চিঠিতে প্যাট্রিশিয়াকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি তাদের একটি অডিওটেপ রেডিও থেকে প্রচারিত হয়। এতে র্যান্ডলফ হার্স্টকে উদ্দেশ করে বলা হয়, ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা রোজা থেকে লস অ্যাঞ্জেলস পর্যন্ত সব দরিদ্র মানুষকে ৭০ ডলারের খাদ্যদ্রব্য দিতে হবে। তারপরই র্যান্ডলফ মেয়েকে ফিরে পাওয়ার জন্য আলোচনায় বসতে পারবেন। এই টেপে প্যাট্রিশিয়া হার্স্টের গলাও শোনা যায়। সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মির দাবি দ্রুত মেনে নিতে করুণ গলায় মা-বাবাকে অনুরোধ করেন। অডিওটেপ প্রচারিত হওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই প্যাট্রিশিয়ার পরিবার ‘পিপল ইন নিড’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মির দাবি পূরণ করেন।
এতে তাদের দুই মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। কিন্তু সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মি আরো ছয় মিলিয়ন ডলার দাবি করে। প্যাট্রিশিয়ার পরিবার জানায়, মেয়েকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পেলে তবেই তারা টাকা দেবেন। এরপর আরেকটা অডিওটেপ পাঠায় গেরিলা সংগঠনটি। সেই টেপে প্যাট্রিশিয়াকে বলতে শোনা যায়, স্বেচ্ছায় তিনি সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মিতে যোগ দিয়ে বিপ্লবের অংশ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! এ ঘটনার প্রায় এক মাস পরই হাইবারনিয়া ব্যাংকের ওই শাখায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে এবং প্যাট্রিশিয়া হার্স্ট আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন।
সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মির মূল উদ্দেশ্য ছিল সিসি ক্যামেরায় প্যাট্রিশিয়া হার্স্টকে উপস্থাপন করা, যেন তারা মিডিয়া কভারেজ পায়। চারদিকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, প্যাট্রিশিয়া নিজ থেকেই এসব করছেন, নাকি তার মগজ ধোলাই করা হয়েছে? এই বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মি একটি অডিওটেপে দাবি করে, প্যাট্রিশিয়া স্বেচ্ছায় তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তার মগজ ধোলাই করা হয়নি।
ব্যাংক ডাকাতির কিছুদিন পর গেরিলা দলের দুই সদস্যসহ একটি দোকান লুট করতে গিয়ে ব্যর্থ হন প্যাট্রিশিয়া। এ ঘটনার পর এফবিআই এবং পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে ১৭ মে সানফ্রান্সিসকোর একটি বাড়িতে গেরিলা দলটির প্রধান ডোনাল্ড ডেবিড ডি ফ্রিজসহ সাতজন প্রাণ হারান। পুরো ঘটনাটি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। তবে প্যাট্রিশিয়া হার্স্টকে সেখানে পাওয়া যায়নি। এক বছর পর সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মির সাবেক সদস্য ক্যাথেলিন সোলিয়াহকে অনুসরণ করে প্যাট্রিশিয়া ও তার সঙ্গীদের অবস্থান শনাক্ত করে পুলিশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে।
১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিচারক অলিভার জেসি কার্টারের আদালতে প্যাট্রিশিয়া হার্স্টের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষে জিম ব্রাউনিং এবং আসামিপক্ষের হয়ে লড়েন লি বেইলি। বেইলি দাবি করেন প্যাট্রিশিয়ার মগজ ধোলাই করা হয়েছে এবং তিনি স্টকহোম সিনড্রোমে ভুগছেন। মগজ ধোলাইয়ের বিষয়টি লি বেইলি বিভিন্ন যুক্তিতে আদালতে উপস্থাপন করতে থাকেন। অন্যদিকে প্যাট্রিশিয়া দাবি করেন গেরিলা দলটির সদস্যদের দ্বারা তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, ফলে প্রাণ ভয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। প্যাট্রিশিয়া এবং তার আইনজীবীর যুক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি জুরি বোর্ড। ২০ মার্চ প্যাট্রিশিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করেন আদালত। সাত বছরের কারাদণ্ড হয় তার। রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার হার্স্টের ২২ মাস কারাদণ্ড মওকুফ করেন, এতে তিনি তার প্রথম প্যারোল শুনানির আট মাস আগে মুক্তি পান। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে কঠোর শর্তে প্যারোলে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে অভিনেত্রী হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে র্যান্ডলফ হার্স্ট দেহরক্ষীর একটি দল নিয়োগ করেন। নিরাপত্তারক্ষীদের একজন ছিলেন বার্নার্ড শ। প্যাট্রিশিয়া তাকে বিয়ে করেন। গিলিয়ান হার্স্ট শ এবং লিডিয়া হার্স্ট শ নামে দুটি সন্তান জন্ম দেন এই দম্পতি। ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি বিল ক্লিনটন প্যাট্রিশিয়া হার্স্টের সাজা পুরোপুরি মওকুফ করে দেন এবং প্যাট্রিশিয়ার অফিশিয়াল রেকর্ড থেকে এ-সংক্রান্ত সব তথ্য মুছে দেওয়া হয়। বিল ক্লিনটন যেদিন প্যাট্রিশিয়ার সাজা মওকুফ করেন, সেদিন ছিল ক্লিন্টনের প্রেসিডেন্সির দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিন।
অনেকেই মনে করেন প্যাট্রিশিয়ার মগজ ধোলাই করা হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে স্টকহোম সিনড্রোমে প্যাট্রিশিয়া আক্রান্ত হওয়ার কারণেই। এখানে উল্লেখ্য, ‘স্টকহোম সিনড্রোমের শিকার ব্যক্তিরা কোনো জিম্মি বা নির্যাতিত ব্যক্তি এক পর্যায়ে অপহরণকারী বা নির্যাতনকারীর সংবেদনশীল আচরণে পূর্বের ঘটনা ভুলে গিয়ে দুর্বলতা অনুভব করেন। এই সিনড্রোম চরম ভয়, চাপ এবং বেঁচে থাকার কৌশলের মাধ্যমে তৈরি হয়।
১৯৭৩ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে একটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়। সে ঘটনায় জিম্মি ব্যক্তিরা ডাকাতদের প্রতি এতটাই সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছিলেন যে মুক্তির পরও তারা প্রকাশ্যে ডাকাতদের সমর্থন করতে থাকেন! যেহেতু ঘটনাটি স্টক হোমে ঘটেছিল, তাই এই মনস্তাত্ত্বিক রোগকে স্টকহোম সিন্ড্রোম নামে পরিচিতি লাভ করে।
সত্তরের দশকে আমেরিকায় বেশ কিছু সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে। সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মি (এসএলএ) ছিল তেমনই একটি সংগঠন। তাদের কার্যক্রম ছিল ক্যালিফোর্নিয়ায় সীমাবদ্ধ। পুঁজিবাদী সরকার হটিয়ে সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠাই ছিল তাদের লক্ষ্য। ডোনাল্ড ডেভিড ডি ফ্রিজ নামে জেল পালানো এক ব্যক্তি এই সংগঠনের নেতৃতে¦ ছিলেন। ডি ফ্রিজ নিজেকে ‘ফিল্ড মার্শাল সিঙ্ক মিটুম’ নামে পরিচয় দিতেন। ডি ফ্রিজের নেতৃত্বে সংগঠনটিতে আটজন সদস্য ছিলেন এই দলে। ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে মার্কাস ফস্টার নামে এক স্কুল শিক্ষককে হত্যা করে আলোচনায় আসে সংগঠনটি। কারণ তিনি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করেছিলেন। পরিচয়পত্র প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করাকে সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মি ফ্যাসিজম হিসেবে চিহ্নিত করে। এই হত্যার দায়ে ১৯৭৪ সালের শুরুর দিকে তাদের দুই সদস্যকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অস্তিত্ব জানান দিতে সিম্বায়োনিজ লিবারেশন আর্মি বড় কিছু করার পরিকল্পনা করে। যার ফলে ক্যালিফোর্নিয়ার অন্যতম ধনী হার্স্ট পরিবারের সদস্য প্যাট্রিশিয়া ক্যাম্পবেল হার্স্টকে অপহরণ করে আলোচনায় আসে সংগঠনটি।