বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মৃত্যুফাঁদ
ফ্লাইট উনিশ ও ভুলের গোলকধাঁধা

রফিকুর রহমান প্রিয়াম
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৩৯

১৯৪৫ সালের বিষণ্ন এক বিকাল। ফ্লোরিডার নৌঘাঁটি থেকে হাসিমুখে আকাশে উড়ে গিয়েছিলেন সাতাশ তরুণ। প্রিয়জনেরা পথ চেয়েছিল, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঘরে ফিরবে তাদের সন্তান, ভাই ও স্বামী। কিন্তু সেই ফেরা আর হয়নি। ফ্লাইট উনিশ এবং তাকে খুঁজতে যাওয়া উদ্ধারকারী বিমানটি হারিয়ে গিয়েছিল আটলান্টিকের অতলে। তাদের অন্তর্ধান জন্ম দিয়েছিল ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’ নামক এক গা ছমছমে কিংবদন্তির। কিন্তু এর চেয়েও করুণ ও হৃদয়বিদারক অধ্যায় হলো সেই অন্তর্ধানের পরের গল্প। বারবার খুঁজে পাওয়ার আশা জাগা এবং প্রতিবার সেই আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার এক গোলকধাঁধা।
সাগরের অতলে হাজারো সমাধিক্ষেত্র
ফ্লাইট উনিশের রহস্য সমাধানের সবচেয়ে বড় বাধা হলো ফ্লোরিডার উপকূলবর্তী সমুদ্র নিজেই এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শুধু ফোর্ট লডারডেল ঘাঁটি থেকেই প্রশিক্ষণ দুর্ঘটনায় প্রায় পঁচানব্বই জন বিমানসেনা প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাদের বিমানগুলোর ধ্বংসাবশেষ আজও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সাগরের গভীরে। তাই যখনই কোনো অ্যাভেঞ্জার বিমানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, তখনই ফ্লাইট উনিশকে খুঁজে পাওয়ার একটি ক্ষীণ আশা জেগে ওঠে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রতিবারই সেই আশা এক নির্মম পরিহাসে পরিণত হয়েছে।
আশার বিভ্রম : ভুলের গোলকধাঁধায় অনুসন্ধান
ষাটের দশকের মাঝামাঝি। ফ্লোরিডার এক জঙ্গলে একজন শিকারি খুঁজে পান নৌবাহিনীর চিহ্ন দেওয়া একটি বিধ্বস্ত বিমান, ভেতরে তখনো দুটি দেহাবশেষ। নৌবাহিনী প্রথমে জানায়, এটি হারিয়ে যাওয়া ফ্লাইট উনিশের অংশ হতে পারে। খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবারগুলোর মনে দশকের পর দশক ধরে চলা অপেক্ষার অবসানের আশা জাগে। কিন্তু কিছুদিন পরই নৌবাহিনী তাদের বক্তব্য ফিরিয়ে নেয়। পরিচয় শনাক্ত করার মতো যথেষ্ট তথ্য না থাকায় সেই দেহাবশেষ দুটি কার, তা আজও এক রহস্য। আশা জাগিয়েও তা কেড়ে নেওয়ার সেই ছিল শুরু।
এরপর ১৯৮৬ সালে স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজতে গিয়ে সমুদ্রের গভীরে পাওয়া যায় আরেকটি অ্যাভেঞ্জার বিমান। ১৯৯০ সালে সেটিকে তুলে আনার পর অনুসন্ধানকারীরা ভেবেছিলেন, হয়তো এটিই সেই হারানো বিমানগুলোর একটি। কিন্তু আবারও ভুল ভাঙে।
সবচেয়ে বড় আশা জেগেছিল ১৯৯১ সালে। গ্রাহাম হক্স নামের এক অভিযাত্রীর দল ঘোষণা করে, তারা সমুদ্রের নিচে একসঙ্গে পাঁচটি অ্যাভেঞ্জার বিমানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছে! সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়, অবশেষে কি রহস্যের অবসান হলো? পরিবারগুলোর বুকের ভেতর বয়ে যায় আনন্দের শীতল স্রোত। এবার হয়তো প্রিয়জনদের একটি অন্তিম যাত্রার ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু সেই আনন্দ ছিল ক্ষণস্থায়ী। বিমানগুলোর লেজের নম্বর পরীক্ষা করে দেখা যায়, এগুলো ফ্লাইট উনিশের কোনো বিমান নয়। এগুলো ছিল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানের এক দুর্ভাগ্যজনক সমাবেশ। যে স্বপ্ন আকাশ ছুঁয়েছিল, তা এক নিমিষে সাগরের অতলে ডুবে যায়।
পরবর্তী সময়ে একটি তথ্যচিত্রে হক্স ফিরে এসে প্রমাণ করেন, তার খুঁজে পাওয়া বিমানগুলোর একটি আসলে ১৯৪৩ সালে বিধ্বস্ত হয়েছিল, যার চালকরা সৌভাগ্যবশত বেঁচে ফিরেছিলেন। নির্মম সত্য হলো, ফ্লাইট উনিশের বিমানগুলো বাদেও আরো অনেক বিমান হারিয়েছে সেই জলে।
উপসংহার : যেখানে সমাপ্তি মানেই যন্ত্রণা
আজও ফ্লাইট উনিশ বা তাদের উদ্ধার করতে যাওয়া বিমানটির কোনো নির্ভরযোগ্য চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা হলো, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পথ হারিয়ে জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় বিমানগুলো সমুদ্রে আছড়ে পড়েছিল এবং উদ্ধারকারী বিমানটি মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হয়েছিল।
ফ্লাইট উনিশের গল্পটি শুধু হারিয়ে যাওয়ার নয়, এটি বারবার খুঁজে পাওয়ার মিথ্যা আশায় বুক বাঁধা আর স্বপ্নভঙ্গের এক অন্তহীন উপাখ্যান। প্রতিটি নতুন আবিষ্কার পরিবারগুলোর পুরোনো ক্ষতকে ফের রক্তাক্ত করে তোলে। এই ভুলের গোলকধাঁধা হয়তো একদিন শেষ হবে, অথবা হয়তো কোনো দিনও হবে না, কিন্তু সাতাশ তরুণের ঘরে না ফেরার যন্ত্রণা আর তাদের প্রিয়জনের সেই অন্তহীন অপেক্ষা, এই মানবিক ট্র্যাজেডি যেকোনো কিংবদন্তির চেয়েও অনেক বেশি ভারী ও বাস্তব। সাগর হয়তো তার রহস্য কোনো দিনও প্রকাশ করবে না, কিন্তু এই পরিবারগুলোর হৃদয়ে যে অপেক্ষার সমুদ্র, তার কোনো কিনারা নেই।