
দাঁশাই নৃত্যের দৃশ্য
আশ্বিনের হিমেল হাওয়া যখন দোলা দেয় কাশবনে, গাছ ভরে শিউলি আর টগর বয়ে নিয়ে আসে দুর্গার আগমন বার্তা। এ সময়ে সাঁওতাল গ্রামের চিত্রও বদলে যায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবী দুর্গার ষষ্ঠীর দিনে দেবীর বোধনের সঙ্গেই শুরু হয় এই দুঃখের উৎসব। প্রথম দিনে থাকে দাঁশাই নাচ। শেষ হয় বিজয়া দশমীতে। তবে এই পরবের বিশেষত্ব হলো কেবল পুরুষই অংশ নেয়। মহিলাদের প্রয়োজন মেটাতে তারাই মেয়েদের পোশাক পরেন। শাড়ি পরেন ধুতির মতো করে। সেই সঙ্গে অন্য অলংকার থাকে এবং মাথায় থাকে ময়ূরের পালক। মূলত লাল পাড় হলুদ শাড়ি কিংবা সবুজ পাড় সাদা শাড়িই তারা ব্যবহার করে। সেই সঙ্গে ব্যবহার করা হয় বিশেষ বাদ্যযন্ত্র ভুয়াং।এ ছাড়া বাঁশি, ধামসা, বানাম, মাদল প্রভৃতিও ব্যবহার করা হয়। রাজায় রাজায় যুদ্ধ থেকে আশ্বিন মাস তাই সাঁওতাল জনজীবনে নিয়ে আসে ভিন্ন একটি মাত্রা। এই মাসেই অনুষ্ঠিত হয় অন্যতম সাঁওতাল পরব দাঁশাই। দাঁশাই কিন্তু তাদের কাছে দুঃখের পরব হিসেবেই চিহ্নিত। মূলত মহিষাসুরের বন্দনা করে তারা।
এই পরবের মধ্যে লুকিয়ে থাকে স্বজন হারানোর ব্যথা। কিন্তু তার মধ্যেও কোথা থাকে অদ্ভুত স্পর্শানুভূতি। তাই তো সারিবদ্ধ হয়ে হেসে-গেয়ে তারা এই পরবে মেতে ওঠে। দাঁশাই নাচের একটা অদ্ভূত ইতিহাস আছে। এই নাচের মাধ্যমে এরা এদের দেবতা ‘হুদুর দুর্গা’কে খুঁজে বেড়ান। এই নাচ মূলত আর্যদের বিরুদ্ধে অনার্যদের বিদ্রোহের নাচ। সুকৌশলে চাতুরি করে আর্যরা হুদুর দুর্গাকে মেরে ফেলে। এই সময়টাকেই তাই এরা এই নাচের জন্য বেছে নিয়েছে। দশমীতে তাদের দেবতাকে মেরে ফেলা হয়। একটি তুলসী তলায় থান তৈরি করে সেখানে এই নাচ হতো। একে ‘মাঝি থান’ বলা হয়। এখানে তিন দেবতার নামে তিনটে পাথর রেখে পুজো দেওয়া হয়। আগে যখন জঙ্গলে ঘেরা ছিল প্রান্তর, তখন এই নাচের মাধ্যমেই ঔষধি গাছগাছালি সংগ্রহ করার রীতির প্রচলন ছিল। সেই সংগ্রহ এখন বদল হয়েছে দ্রব্য, অর্থ সংগ্রহে।
অরণ্যের অভাবে অরণ্যের মানুষজন নেমে এসেছে পথের ভিড়ে। প্রথা অনুযায়ী দশমী তিথিতে নানা আচার অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা করার পর তুলসীগাছসমেত পুজোর অন্যান্য সামগ্রীও জলে ফেলে দেওয়া হয়। নন্দ মুর্মুর কাছ থেকেই জানলাম দুই ধরনের দাঁশাই নাচের কথা। একটি আনন্দের, অন্যটি দুঃখের। ষষ্ঠীর আগে পর্যন্ত মুখের দাঁশাই আর ষষ্ঠীর পরে দশমী পর্যন্ত দুঃখের দাঁশাই। তাই এরা কেউ নতুন পোশাক পরেন না। আর্য-অনার্যের লড়াই, মা দুর্গার সৃষ্টি এসবই পুরাণ কথা। সাঁওতালরাই তো আদি বাসিন্দা, এরাই তো মাটি-পাথর-প্রকৃতির সবচেয়ে কাছের। অরণ্যের অধিকার এদের। সেই মানুষগুলোর বিশ্বাস, প্রত্যয় আমার অবস্থানগত স্থানটি নিয়ে বহু প্রশ্নচিহ্ন আবর্তিত হয়েছে, নিজের কৃষ্টির দিকে আঙুল তুলেছে। সাঁওতাল জনগোষ্ঠী আমাদের আদিবাসিন্দা। আর্যদের আগমনের মধ্য দিয়ে যে লড়াই সূচিত হয়েছিল অনার্যদের সঙ্গে দাঁশাই উৎসব তারই ইতিহাস বহন করছে।