Logo
×

Follow Us

ফিচার

অদৃশ্য শত্রু ‘ভ্যাম্পায়ার এনার্জি’

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪৮

অদৃশ্য শত্রু ‘ভ্যাম্পায়ার এনার্জি’

অদ্ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিল হাতে পেয়ে চমকে ওঠেনি-এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। মাস শেষে মোটা অঙ্কের বিল দেখে অনেকেই ভাবেন, এত বিল কীভাবে এলো, আমি তো তেমন কিছুই ব্যবহার করিনি! এই ভাবনার পেছনে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য শত্রুর নাম ‘ভ্যাম্পায়ার এনার্জি’ বা ‘ফ্যান্টম পাওয়ার’। নামটি শুনতে ভয়ের মনে হলেও এর প্রভাব পড়ে সরাসরি আপনার পকেটের ওপর।

বাড়ির ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিগুলো বন্ধ থাকা সত্ত্বেও প্লাগ ইন করা থাকলে তখনো তা সামান্য পরিমাণে বিদ্যুৎ খরচ হতে থাকে। এই অলস সময়ে খরচ হওয়া বিদ্যুৎকেই বলা হয় ‘ভ্যাম্পায়ার এনার্জি’। ঠিক যেমন পৌরাণিক ভ্যাম্পায়াররা রাতের আঁধারে শিকারের রক্ত শুষে নেয়, তেমনই এই ডিভাইসগুলো অজান্তেই বাড়ির বিদ্যুৎ শুষে নিতে থাকে, যা মাস শেষে বিলকে ভারী করে তোলে।

ভ্যাম্পায়ার এনার্জি বা ফ্যান্টম পাওয়ার কী?

সহজ কথায়, ভ্যাম্পায়ার এনার্জি হলো সেই বিদ্যুৎ, যা ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা অ্যাপ্লায়েন্সগুলো বন্ধ থাকা অবস্থায়ও ব্যবহার হতে থাকে। একে ‘স্ট্যান্ডবাই পাওয়ার’ও বলা হয়। আজকের দিনের প্রায় সব আধুনিক ডিভাইসেই এই বৈশিষ্ট্যটি রয়েছে। যেমন-রিমোট দিয়ে টিভি বা এসি বন্ধ করা হলে তখন সেটি পুরোপুরি বন্ধ না হয়ে ‘স্ট্যান্ডবাই মোডে’ চলে যায়। ফলে পরবর্তী সময়ে যেন রিমোটের একটি বোতাম চেপেই আবার চালু করা যায়। এই সুবিধার জন্য ডিভাইসটিকে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হয় এবং অল্প পরিমাণে বিদ্যুৎ খরচ করতে হয়। ঠিক একইভাবে মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ডিজিটাল ঘড়ি বা ওয়াইফাই রাউটারের মতো যেসব যন্ত্রে সার্বক্ষণিক ডিসপ্লে বা আলো জ্বলে, সেগুলো প্লাগ ইন থাকা অবস্থায় একটানা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে।

যুক্তরাষ্ট্রের লরেন্স বার্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির গবেষণা অনুযায়ী একটি মার্কিন পরিবারের মোট বিদ্যুৎ খরচের প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত এই ভ্যাম্পায়ার এনার্জির কারণে অপচয় হয়। 

ভ্যাম্পায়ার এনার্জি কীভাবে কাজ করে

লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির গবেষণায় দেখা যায়, একটি সম্পূর্ণ চার্জ হওয়া স্মার্টফোন প্লাগইন অবস্থায় প্রায় ২.২৪ ওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, যা চার্জ হওয়ার সময়কার বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রায় ৬০ শতাংশ। একটি সম্পূর্ণ চার্জ হওয়া ল্যাপটপের ক্ষেত্রে এই অপচয় আরো বেশি। এটি প্লাগইন অবস্থায় প্রতি ঘণ্টায় ২৯.৪৮ ওয়াট বিদ্যুৎ টানে, যা চার্জ হওয়ার সময়ের ৪৪.২৮ ওয়াটের ৬৬ শতাংশ। যদি একটি ল্যাপটপ সারা বছর এভাবে প্লাগইন রাখা হয়, তাহলে তা দিয়ে একটি কফি মেকার একটানা ১২ দিন চালানো সম্ভব।

শুধু ডিভাইস নয়, খালি চার্জারও বিদ্যুৎ অপচয় করে। একটি চার্জার অনেকক্ষণ ধরে প্লাগইন অবস্থায় থাকলে তাতে হাত দিলে যে সামান্য উষ্ণতা অনুভব করবেন, সেটাই হলো অপচয় হওয়া বিদ্যুৎ। প্রযুক্তিগতভাবে একে ‘নো লোড মোড’ বলা হয়। গবেষণায় আরো দেখা যায়, একটি খালি মোবাইল চার্জার এই মোডে ০.২৬ ওয়াট এবং একটি ল্যাপটপ চার্জার ৪.৪২ ওয়াট বিদ্যুৎ নষ্ট করে। এই সংখ্যাগুলো স্বাভাবিকভাবে খুবই সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু যখন লাখ লাখ বাড়িতে থাকা কোটি কোটি ডিভাইসের সঙ্গে গুণ করা হয়, তখন এই অদৃশ্য ভ্যাম্পায়ারদের কারণে মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের একটি বড় অংশ অপচয় হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক নীরব সংকট

আমাদের দেশে এই সমস্যাটি আরো বেশি প্রকট। এখানে অধিকাংশ মানুষ এই বিষয়ে সচেতন নয়। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই বিদ্যুতের অপচয় ব্যক্তিগত সমস্যাকে ছাপিয়ে জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। যখন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা সীমিত, তখন প্রতিটি ইউনিট বিদ্যুতের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।

গ্রামে বা শহরে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই একাধিক ডিভাইস ২৪ ঘণ্টা প্লাগইন অবস্থায় থাকে। একটি সাধারণ পরিবারের কথা ভাবুন-সেখানে টেলিভিশন, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, কয়েকটি স্মার্টফোন চার্জার, ওয়াইফাই রাউটার এবং কিছু ছোট গ্যাজেট থাকে। এমনকি যখন এগুলো বন্ধ, কিন্তু স্ট্যান্ডবাই মোডে থাকে, তখনো এদের সম্মিলিত বিদ্যুৎ খরচ বেশ বড় আকার ধারণ করে।

আমাদের দেশে বিদ্যুৎ সংকট একটি সাধারণ বিষয়। গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লে লোডশেডিংয়ের পরিমাণও বাড়ে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে জ্বালানির খরচ আকাশছোঁয়া, ফলে সরকারকে প্রায়ই ভর্তুকি দিতে হয়। এই অবস্থায় যদি আবাসিক খাতে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎও ভ্যাম্পায়ার এনার্জির কারণে অপচয় হয়, তাহলে এর আর্থিক মূল্য এবং জাতীয় গ্রিডের ওপর চাপ মারাত্মক আকার ধারণ করে। শুধু এই অপচয় রোধ করতে পারলেও লোডশেডিংয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হতো। 

ফ্যান্টম পাওয়ারের কয়েকটি কারণ 

সচেতনতার অভাব : বেশির ভাগ মানুষই জানে না যে, বন্ধ থাকা ডিভাইসও বিদ্যুৎ খরচ করতে পারে। মোবাইল চার্জার ব্যবহার শেষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি সারা দিন ধরে সকেটে লাগিয়ে রাখা একটি সাধারণ অভ্যাস। একইভাবে টিভি, কম্পিউটার বা এসির সুইচ বন্ধ না করে শুধু রিমোট দিয়ে বন্ধ করা হয়।

পুরোনো প্রযুক্তির ব্যবহার : অনেক বাড়িতে এখনো পুরোনো মডেলের টিভি, ফ্রিজ বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয়, যেগুলোর স্ট্যান্ডবাই পাওয়ার খরচ আধুনিক শক্তি সাশ্রয়ী মডেলের চেয়ে অনেক বেশি।

মাল্টি-প্লাগের অতিরিক্ত ব্যবহার : প্রায় প্রতিটি ঘরেই এখন মাল্টি-প্লাগ বা পাওয়ার স্ট্রিপ ব্যবহার করা হয়, যেখানে একসঙ্গে একাধিক ডিভাইস সংযুক্ত থাকে। কাজ শেষে মূল সুইচটি বন্ধ না করায় সব ডিভাইস একসঙ্গে ভ্যাম্পায়ার লোড তৈরি করে।

একটি সাধারণ হিসাব করলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। আপনার বাড়িতে ১০টি এমন ডিভাইস আছে, যা স্ট্যান্ডবাই মোডে সম্মিলিতভাবে ১০ ওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করে। দিনে ২৪ ঘণ্টা এবং মাসে ৩০ দিন চললে এর মোট খরচ দাঁড়াবে (১০ ওয়াট*২৪ ঘণ্টা*৩০ দিন)= ৭২০০ ওয়াট-ঘণ্টা বা ৭.২ ইউনিট। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ১০ টাকা ধরলেও মাসে প্রায় ৭২ টাকা শুধু এই অদৃশ্য শক্তির জন্যই বিল দিচ্ছেন, যা বছরে প্রায় ৮৬৪ টাকা। 

উপায়

আনপ্লাগ করার অভ্যাস : এটি সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর উপায়। যখন কোনো ডিভাইস সম্পূর্ণ চার্জ হয়ে যায়, তখন সেটির প্লাগ খুলে ফেলুন। বিশেষ করে মোবাইল ফোন চার্জার বা ল্যাপটপ অ্যাডাপ্টারের মতো ছোট ডিভাইসগুলো সব সময় আনপ্লাগ করে রাখুন। 

পাওয়ার স্ট্রিপ ব্যবহার : টেলিভিশন, গেমিং কনসোল, সাউন্ড সিস্টেম এবং অন্যান্য ডিভাইস একটি পাওয়ার স্ট্রিপে সংযোগ করুন। যখন ব্যবহার শেষ হবে, তখন পাওয়ার স্ট্রিপের একটি সুইচ বন্ধ করেই সব কটি ডিভাইসের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে। এটি একটি করে প্লাগ খোলার ঝামেলা থেকে মুক্তি দেবে।

স্মার্ট চার্জার : যা ডিভাইস সংযুক্ত না থাকলে কোনো বিদ্যুৎই খরচ করে না। এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যয়বহুল হলেও দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎ খরচ কমাতে সাহায্য করে এবং পরিবেশের জন্য ভালো। বাংলাদেশে এখন ধীরে ধীরে এই প্রযুক্তিগুলো সহজলভ্য হচ্ছে।

এনার্জি সেভিং স্টার রেটিং : নতুন কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা অ্যাপ্লায়েন্স কেনার সময় সেটি কতটা শক্তি-সাশ্রয়ী, তা দেখে নিন। বাংলাদেশে এখন অনেক পণ্যের গায়ে এনার্জি সেভিং স্টার রেটিং দেওয়া থাকে। বেশি স্টারযুক্ত পণ্য সাধারণত স্ট্যান্ডবাই মোডে কম বিদ্যুৎ খরচ করে।

সেটিংসে পরিবর্তন : কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও গেমিং কনসোলের পাওয়ার সেটিংসে গিয়ে ‘সিøপ মোড’ বা ‘স্ট্যান্ডবাই মোড’ অপশনটি পরিবর্তন করুন। ‘কুইক স্টার্ট’ বা ‘ইনস্ট্যান্ট অন’ মোডগুলো বন্ধ রাখুন, কারণ এগুলো স্ট্যান্ডবাই অবস্থায় বেশি বিদ্যুৎ খরচ করে।

মনিটর পুরোপুরি বন্ধ করা : কম্পিউটারের স্ক্রিন সেভার মনিটরকে চালু রাখে এবং বিদ্যুৎ খরচ করে। এর পরিবর্তে কম্পিউটার ব্যবহার না করলে মনিটরটি পুরোপুরি বন্ধ করে দিন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫