
অজগর হাতে ‘ওয়াইল্ড লাইফ এন্ড স্নেক রেসকিউ টিম ইন বাংলাদেশ’-এর সদস্যরা
রান্নাঘরের টিমটিমে আলোয় রাতের খাবার গরম করছিলেন গৃহবধূ নীলাম্বরী মজুমদার। হঠাৎ গ্যাস সিলিন্ডারের আড়াল থেকে ‘কালো-হলুদ’ রঙের একটি শঙ্খিনী সাপ দ্রুতই চালের ড্রামের আড়ালে আশ্রয় নিল। দৃশ্যটি দেখে নীলাম্বরী মজুমদার আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন। তার চিৎকারে পরিবারের অন্য সদস্যরা রান্নাঘরে ছুটে এলো। বিস্তারিত জানার পর তারা দ্রুতই ‘স্নেক রেসকিউ টিম’কে ফোন করেন। বেশ কম সময়ের মধ্যেই ব্যাগ ও সাপ ধরার যন্ত্র নিয়ে স্নেক রেসকিউ টিমের সদস্যরা চলে আসেন এবং সাপটিকে ধরে ফেলেন। পরে নিরাপদ স্থানে তারা সাপটিকে অবমুক্ত করেন।
দেশের গ্রামীণ জীবনে সাপ মানেই এক আতঙ্কের নাম। ফলে মানুষ চটজলদি যেকোনো সাপই মেরে ফেলতে চায়। অথচ এই প্রাণীটি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সাপ মানেই ভয়ংকর ক্ষতিকারক প্রাণী-এই ভুল ধারণা ভেঙে দিতে ২০২০ সালের মে মাসে জন্ম নেয় ‘ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ টিম ইন বাংলাদেশ’। বর্তমানে তাদের ফেসবুক গ্রুপে দুই লাখেরও বেশি মানুষ যুক্ত রয়েছেন। সারা দেশে সক্রিয় সদস্য এক হাজার ছাড়িয়েছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধারকর্মী আছেন ২৫০ জন।
চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু হয় ২০২১ সালে। এখানে ১০ জন তরুণ নিয়মিত কাজ করছেন। তারা মানুষকে সচেতন করছেন, ‘সাপকে ভয় নয়, বুঝতে হবে’ এই প্রতিপাদ্যে।
সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মীরসরাই ইউনিটের নেতৃত্বে থাকা মো. নাইমুল ইসলাম নিলয় বলেন, ‘আমরা চাই মানুষ সাপকে শত্রু নয়, প্রকৃতির বন্ধু ভাবুক। নির্বিষ সাপ মানুষের উপকারেই আসে। তাই সাপকে অকারণে মারবেন না।’
মাইনউদ্দিন মুরাদ, শুভ বিশ্বাস, আব্দুর রহমান, কেফায়েত উল্যাহ খান, সালাউদ্দিন মাহাদি, নাওশিন ইসলাম নিরব, শাকিল আহমেদ ও নুরুজ্জামান আহাদ। সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। তারাই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে উদ্ধার করেছেন বিরল প্রজাতির রেড কোরাল কুকরি (কমলাবতি সাপ) এবং ছোট কৃষ্ণ কালাচ। পাশাপাশি কিং কোবরা, কেউটে, শঙ্খিনীসহ বহু বিষধর ও নির্বিষ সাপকে জীবিত অবস্থায় নিরাপদে অবমুক্ত করেছে তারা।
এই কাজে ঝুঁকিও কম নয়। উদ্ধারকাজ পরিচালনা করতে গিয়ে সংগঠনের কয়েকজন সদস্যকে বিষধর সাপের কামড় খেতে হয়েছে। তবে চিকিৎসা শেষে তারা আবারও কাজে ফিরেছেন। যেন সাপ রক্ষাই তাদের জীবনের অন্যতম ব্রত।
মীরসরাইয়ের মানুষের মাঝে এখন সচেতনতা তৈরি হয়েছে। সাপ দেখলেই মেরে ফেলার ঘটনা অনেক কমেছে। সাপ দেখলে স্নেক রেসকিউ টিমকে খবর দেওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্য, এই তরুণরা শুধু সাপই বাঁচাচ্ছেন না, মানুষের মনেও জাগিয়ে তুলছেন প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ববোধ।
চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘সাপ মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং পরিবেশ ও কৃষি ব্যবস্থায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সাপকে বন্যপ্রাণী হিসেবে সংরক্ষণ অপরিহার্য। সাপ উদ্ধারে তরুণদের উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। একই সঙ্গে সাপ হত্যার প্রবণতা কমার পাশাপাশি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গড়ে উঠছে নতুন সামাজিক মনোভাব।’
সাপের প্রতি ভয় থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু মেরে ফেলা সমাধান নয়। প্রকৃতির স্বার্থেই তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মীরসরাইয়ের এই তরুণরা সেই কাজটিই করছেন। তারা ভয় ভেঙে সামনে এসেছেন। সাপ ও মানুষের দূরত্ব কমিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় তারা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন।