মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা শন ম্যাকব্রাইড

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:০৭

শন ম্যাকব্রাইড
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রায় নিরন্তর কাজ করে গেছেন সাবেক আইরিশ বিপ্লবী শন ম্যাকব্রাইড। কিন্তু মার্টিন লুথার কিং অথবা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো ততটা আলোচিত নন তিনি। লুথার কিং ও ম্যান্ডেলা থেকে ম্যাকব্রাইড একটু আলাদাই ছিলেন। কৈশোরে যোগ দিয়েছেন আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিতে। হাতে তুলে নিয়েছেন অস্ত্র, জড়িয়েছেন রক্তক্ষয়ী গেরিলা যুদ্ধে।
জন্ম ও শৈশব
১৯০৪ সালের ২৬ জানুয়ারি প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন শন ম্যাকব্রাইড। তার বাবা ছিলেন মেজর জন ম্যাকব্রাইড ও মা মড গন ম্যাকব্রাইড। তারা ছিলেন তখনকার আয়ারল্যান্ডের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত দুই নাম। মা-বাবা দুজনই ছিলেন বিপ্লবী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে তারা নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে কাজ করে গেছেন। জন ম্যাকব্রাইড দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিবাসী আইরিশদের সংগঠিত করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বোয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। হয়ে ওঠেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যজুড়ে মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা। অন্যদিকে মড গন ম্যাকব্রাইডও পিছিয়ে ছিলেন না। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের দরুন আয়ারল্যান্ডের ‘জোয়ান অব আর্ক’ নামে পরিচিতি লাভ করেন।
শন ম্যাকব্রাইডের জন্মের পরই তার মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তাই শিশুকাল থেকে প্যারিসে মায়ের কাছেই বেড়ে ওঠেন তিনি। তাবড় তাবড় আইরিশ বিপ্লবীরা আসা-যাওয়া করতেন তাদের বাড়িতে। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির এই বিপ্লবী আবহের আঁচ তার গায়ে এসে লাগে।
১৯১৬ সালে মেজর জন ম্যাকব্রাইডের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ তুলে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করে ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত থেকে আয়ারল্যান্ডের মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে কিশোর শন ম্যাকব্রাইডকে নিয়ে আয়ারল্যান্ডে ফিরে আসেন মড গন। রাজধানী ডাবলিনে বসতি গড়লেন তিনি। শন ম্যাকব্রাইডকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো স্কুলে।
বিপ্লবী দলে যোগদান
১৯১৯ সালে সুযোগে বয়স লুকিয়ে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিতে যোগ দেন ১৫ বছরের কিশোর শন ম্যাকব্রাইড। জায়গা হয়-ডাবলিন ব্রিগেডের তৃতীয় ব্যাটালিয়নের বি কোম্পানিতে। বি কোম্পানি প্রায় পুরোটাই শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত। শনের মতো অপেক্ষাকৃত অভিজাত শ্রেণির কেউ এখানে ছিলেন না। শন শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে যেতে পেরেছিলেন। অভিজাত শ্রেণির কোনো ‘নাক উঁচু’ স্বভাব তার মধ্যে ছিল না।
গেরিলা জীবন ও সমাপ্তি
১৯২০ সালের ২১ নভেম্বর রাতে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের ১২ জন সদস্যকে হত্যা করে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি। এই ঘটনাটি শন ম্যাকব্রাইডের গেরিলা জীবনের সবচেয়ে বড় অভিযান। তবে পাল্টা আক্রমণে মারা যান রিপাবলিকান আর্মির ডাবলিন ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার। এ ঘটনার পর আত্মগোপনে চলে যান শন ম্যাকব্রাইড।
গেরিলা জীবনে শন ম্যাকব্রাইড যে অঞ্চলেই দায়িত্বে ছিলেন, সেখানকার পুলিশ-প্রশাসনকে সব সময়ই দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়েছে। তাদের সব সময় এটাই ভাবতে হয়েছে, ‘শনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে যাচ্ছে?’ কর্মগুণে রিপাবলিকান আর্মিতে তার দায়িত্বের ভারও বেড়েছিল।
১৯২১ সালে ব্রিটিশ সরকার নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডকে বাদ রেখে আয়ারল্যান্ডের বাকি অংশকে (বর্তমান আয়ারল্যান্ড) স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তাব করে। শন ম্যাকব্রাইড এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। শন ম্যাকব্রাইড ও তার সহযোদ্ধারা পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। এ সময় আয়ারল্যান্ডজুড়ে দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। এক পক্ষ চায় পূর্ণ স্বাধীনতা, অন্যপক্ষ স্বায়ত্তশাসন। শুরু হয় ব্যাপক গৃহযুদ্ধ। শন ম্যাকব্রাইড বন্দি হন স্বায়ত্তশাসনপন্থিদের হাতে। এক বছর ধরে চলা এই গৃহযুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনপন্থিরা জয়ী হয়। গ্রেট ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে স্বায়ত্তশাসিত দেশ হিসেবে থেকে যায় আয়ারল্যান্ড।
যুদ্ধ শেষে মুক্তি পান শন ম্যাকব্রাইড। ভর্তি হন ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিয়ে করেন বয়সে চার বছর বড় সহযোদ্ধা ক্যাটালিনা বুলফিনকে। এরপর ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বেশ কয়েক বছর কাটান এই দম্পতি। ১৯২৭ সালে আবারও ডাবলিনে ফিরে আসেন তারা। পুরোনো সহযোদ্ধাদের নিয়ে একটু একটু করে রাজনীতির মাঠে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে থাকেন।
আইন পেশা এবং নতুন রাজনীতি
১৯৩৭ সালে আয়ারল্যান্ডের সংবিধান কার্যকর হয়। একই বছর ব্যারিস্টারি পাস করেন শন ম্যাকব্রাইড। রাজনীতি ছেড়ে আয়ারল্যান্ডের বারে যোগ দেন উকিল হিসেবে। কয়েক বছরের মধ্যেই অত্যন্ত সফল আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন তিনি। রাজনীতি ছাড়লেও সহযোদ্ধাদের ভুলে যাননি শন। এককালের বহু সহযোদ্ধাকে আইনি সাহায্য দিয়ে প্রাণে রক্ষা করেছেন।
১৯৪৬ সালে শন ম্যাকব্রাইড আবারও রাজনীতিতে ফিরে আসেন। গঠন করেন সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের রাজনৈতিক দল ‘ক্ল্যান না পোব্লাকটা’। ১৯৪৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ১০টি আসন পায় তার দল। কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে ফাইন গল, লেবার পার্টি, ন্যাশনাল লেবার পার্টির সঙ্গে শন ম্যাকব্রাইডের দল একসঙ্গে সরকার গঠন করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান শন ম্যাকব্রাইড।
১৯৪৯ সালে আয়ারল্যান্ডকে রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। এতে করে বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষায় স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা লাভ করে আয়ারল্যান্ডে। এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত আইনসভায় পাস করার অন্যতম কারিগর ছিলেন শন ম্যাকব্রাইড। দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই বহির্বিশ্বে আয়ারল্যান্ডের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব জানান দিতে তৎপরতা চালাতে থাকেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জর্জরিত ইউরোপে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে European Convention on Human Rights-ECHR চুক্তি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৫০ সালে কাউন্সিল অব ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, একই সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কো-অপারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ন্যাটোতে আয়ারল্যান্ডকে যোগদান থেকেও বিরত রেখেছিলেন এই শন ম্যাকব্রাইড।
১৯৫১ সালের পর আর কোনো নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেননি। তার দলেরও শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এরপর রাজনীতি থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন শন ম্যাকব্রাইড। একপর্যায়ে রাজনীতি থেকে অবসর নেন এবং নিজ দলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এরপর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন।
মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা
মূলত ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই শন ম্যাকব্রাইড বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার আন্দোলন এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করেন।
১৯৫৮ সালে সাইপ্রাসের জাতীয়তাবাদী নেতা আর্চবিশপ মাকারিওসকে ব্রিটিশরা সিচেলস দ্বীপে নির্বাসনে পাঠায়। শন ম্যাকব্রাইড ব্রিটেনের বিরুদ্ধে মামলা লড়ে তাকে মুক্ত করেন।
বোয়ার যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শনের বাবা জন ম্যাকব্রাইডের অবদান স্মরণ করে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার শন ম্যাকব্রাইডকে সম্মান জানাতে আমন্ত্রণ জানায়। সে সময় তার অনুরোধে দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিয়ে সরকার।
সারা বিশ্বের কারাবন্দিদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে ব্রিটিশ আইনজীবী পিটার বেনেনসনকে নিয়ে শন ম্যাকব্রাইড গঠন করেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’। শন ম্যাকব্রাইডের আইনি এবং কূটনৈতিক দক্ষতার ওপর ভর করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আলোর মুখ দেখে। খুব দ্রুতই বিচারহীন গ্রেপ্তার, কারাবন্দিত্ব এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রধানতম প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায় অ্যামনেস্টি। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ম্যাকব্রাইড।
১৯৬৩ সালে শন ম্যাক ব্রাইডকে ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টসের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষায় নিরপেক্ষভাবে কাজ করার কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটির, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের বিষয়ে অদ্ভুত নীরবতা পালন করে প্রতিষ্ঠানটি। অ্যামনেস্টির মতো নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন শন ম্যাকব্রাইড, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থ হন। ১৯৬৩ সালে চীনের তিব্বত দখলের নিন্দা জানানোর পর মার্কিন প্রতিনিধিরা শন ম্যাকব্রাইডের ওপর খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ভিয়েতনাম আক্রমণের কড়া সমালোচনা করে তাদের সেই খুশি ম্লান করে দেন তিনি। ১৯৬৯ সালে ম্যাকব্রাইড উত্তর ভিয়েতনাম পরিদর্শন করেন এবং মার্কিন বাহিনীর হাতে বেসামরিক মানুষের হতাহতের পরিমাণ দেখে হতবাক হয়ে যান। এ ছাড়াও শন ম্যাকব্রাইড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় শন ম্যাকব্রাইডকে ১৯৭৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং ১৯৭৭ সালে লেনিন শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। একই সঙ্গে বিপরীত মেরুর এই দুই পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনা বিরল দৃষ্টান্তই বলা যায়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার এই অগ্রদূত ১৫ জানুয়ারি ১৯৮৮ সালে ৮৩ বছর বয়সে ডাবলিনে মৃত্যুবরণ করেন।