-68d3ce0d13108.jpg)
চাঁদে টিনটিন
রাতের আকাশে তাকালেই দেখা যায় সেই চিরচেনা আলো—চাঁদ। কখনো পূর্ণিমায় সাদা রুপালি প্রদীপের মতো ঝলমল করে, কখনো অমাবস্যায় মিলিয়ে যায় রহস্যময় অন্ধকারে। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ তাকিয়ে থেকেছে সেই দূরের গোলাকার আলোয়, ভেবেছে—ওখানে কি দেবতার আসন? নাকি লুকিয়ে আছে অন্য কোনো প্রাণী?
কবি লিখেছেন প্রেমের গান, সাধু-সন্ন্যাসী ভেবেছেন আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক, আবার ছোট শিশুদের কাছে সে ছিল কেবলই মামা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা মনের ভেতর গোপনে জিজ্ঞাসা রেখেছেন—সত্যিই কি কোনোদিন ওখানে যাওয়া সম্ভব?
কল্পনায় শুরু হয়েছিল সেই যাত্রা। তারপর ধীরে ধীরে কল্পনা মিশেছে বিজ্ঞানের সঙ্গে, আর মানুষ একদিন সত্যিই পৌঁছে গেছে সেই রুপালি গোলার বুকে।
জুল ভার্নের বিস্ময়কর স্বপ্ন
১৮৬৫ সাল। প্যারিসের আকাশে তখনও কোনো বিমান নেই, রকেটের নামগন্ধও মানুষ শোনেনি। সেই সময়ে ফরাসি লেখক জুল ভার্ন হঠাৎ যেন ভবিষ্যতের জানালা খুলে দিলেন তাঁর অভাবনীয় উপন্যাস ফ্রম দ্য আর্থ টু মুন–এ।
গল্পে দেখা যায়, কিছু দুঃসাহসী বিজ্ঞানী বিশাল এক কামান বানাচ্ছেন—যেন পৃথিবীর বুকে গজিয়ে ওঠা এক অগ্নিমুখ। সেই কামান থেকে ছুঁড়ে দেওয়া হবে এক বিশাল লোহার ক্যাপসুল। আর তাতে চড়ে বসবেন অভিযাত্রী মানুষ! উদ্দেশ্য একটাই—চাঁদ জয়।
ভাবুন তো, তখন মানুষের কল্পনায় মহাকাশ কেবলই অদৃশ্য রহস্য। অথচ জুল ভার্ন এমন নিখুঁত বর্ণনা দিলেন যে পড়তে পড়তে মনে হয়—এ কোনো গল্প নয়, বাস্তবেই যেন ঘটছে। ক্যাপসুলের ভেতরে থাকবে অক্সিজেন ব্যবস্থা, থাকবে ছোট ছোট জানালা, যেখানে হেলে বসে অভিযাত্রীরা দেখতে পাবেন তারাভরা মহাশূন্য। এমনকি তিনি লিখে ফেললেন—মহাশূন্যে ভরশূন্য হয়ে মানুষ কেমন ভেসে যাবে!
কী আশ্চর্য, আজ আমরা জানি এই সবই বাস্তব মহাকাশযাত্রার অপরিহার্য অংশ। অথচ জুল ভার্ন লিখেছিলেন সবকিছু মানুষ চাঁদে পা রাখার এক শতাব্দী আগেই। যেন তাঁর কলমে ফুটে উঠেছিল ভবিষ্যতের সত্যি হয়ে ওঠা স্বপ্ন।
টিনটিনের রোমাঞ্চকর অভিযান
জুল ভার্নের কলমে যখন চাঁদ জয় ছিল কেবল কল্পনার গল্প, তার প্রায় এক শতাব্দী পর সেই কল্পনায় রঙ লাগালেন এক কার্টুনিস্ট। তিনি বেলজিয়ামের হার্জে—যিনি সৃষ্টি করলেন বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় কমিক চরিত্র টিনটিন।
১৯৫৩ সালে বের হলো ডেসটিনেশন মুন। বইয়ের পাতায় পাতায় আঁকা হলো এক রকেটের মহাযাত্রার প্রস্তুতি—লাল-সাদা চেক করা দেহ, সুউচ্চ টাওয়ারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সেই রকেট যেন পৃথিবী ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে উদগ্রীব। তারপর ১৯৫৪ সালে প্রকাশ পেল সিক্যুয়েল এক্সপ্লোরারস অন দ্য মুন। এবার টিনটিন, ক্যাপ্টেন হ্যাডক, প্রফেসর ক্যালকুলাস আর স্নোয়ি কুকুরটিও রওনা হলো এক অবিশ্বাস্য অভিযানে—সরাসরি চাঁদের বুকে!
হার্জের আঁকায় দেখা গেল রকেট গর্জে উঠছে, আকাশে ধোঁয়া আর আগুনের রেখা টেনে পৃথিবী ছাড়ছে। ভেতরে বসে থাকা টিনটিন হঠাৎ অনুভব করছে ভরশূন্যতা—শূন্যে ভেসে যাচ্ছে কলম, বোতল, এমনকি স্নোয়ি! আবার চাঁদের ধূসর মাটিতে নামার পর দেখা গেল তাঁদের পদচিহ্ন—যেন বাস্তবেই নভোচারীরা নেমে এসেছে সেই অজানা গ্রহাণুর বুকে।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো—তখনো বাস্তবে মানুষ পৃথিবীর কক্ষপথেও যায়নি। প্রথম মানব-অভিযান ইউরি গ্যাগরিন–এর ঐতিহাসিক ফ্লাইট হয়েছিল আরও আট বছর পরে, ১৯৬১ সালে। অথচ হার্জে তাঁর কমিকে রকেটের নকশা, ভরশূন্য অভিজ্ঞতা, এমনকি চাঁদের পৃষ্ঠের বর্ণনা এত নিখুঁতভাবে তুলে ধরলেন যে তা পরবর্তী বাস্তব মহাকাশযাত্রার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়।
পাঠকেরা তখন একেবারে মোহাবিষ্ট। ছোটরা ভেবেছে—একদিন আমরাও টিনটিনের মতো রকেটে চড়ে চাঁদে যাব। বড়রাও বিস্ময়ে ভেবেছে—এ যেন ভবিষ্যতের আভাস, যেন কোনো গোপন বৈজ্ঞানিক নীলনকশা আগে থেকেই প্রকাশ পেয়েছে এই কমিকের পাতায়।
টিনটিনের সেই অভিযানের পর চাঁদ আর কেবল রুপালি গোলা রইল না, বরং হয়ে উঠল মানুষের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্য।
বাস্তবের প্রথম পদচিহ্ন
সব কল্পনা, সব গল্প, সব আঁকিবুঁকির পর অবশেষে এল সেই দিন—২০ জুলাই ১৯৬৯। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা পাঠালো মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃসাহসিক মিশন—অ্যাপোলো–১১।
চাঁদের মাটিতে নামল লুনার মডিউল ঈগল। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে রইল। আর তখনই নেমে এলেন নীল আর্মস্ট্রং—মানুষের প্রথম প্রতিনিধি, যিনি পা রাখলেন চাঁদের ধূসর, নির্জন বালুকণায়।
তাঁর সেই ঐতিহাসিক বাক্য আজো যেন মহাশূন্যে প্রতিধ্বনিত হয়—
“একজন মানুষের জন্য ক্ষুদ্র পদক্ষেপ, মানবজাতির জন্য বিশাল লাফ।”
কিছুক্ষণ পরেই তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন বাজ অলড্রিন। দুইজন নভোচারী পতাকা গেড়ে, পরীক্ষা চালিয়ে, পাথর সংগ্রহ করে ফিরলেন ইতিহাসের পাতায়।
কিন্তু এ ছিল কেবল শুরু। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে মানুষ মোট ছয়বার চাঁদের মাটিতে অবতরণ করেছে—অ্যাপোলো ১১, ১২, ১৪, ১৫, ১৬ আর ১৭। এ ছয় অভিযানে মোট ১২ জন নভোচারী হাঁটলেন চাঁদের বুকে। তবে ১৯৭২ সালের পর থেকে আর কোনো মানুষ সেখানে যায়নি। চাঁদ আবার রয়ে গেল দূর, অজানা আর রহস্যময়।
আবার নতুন স্বপ্ন: আর্টেমিস–২
পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। এর মধ্যে চাঁদে গেছে অসংখ্য রোবট, ল্যান্ডার আর রোভার, কিন্তু মানুষের পদচিহ্ন আর পড়েনি। এবার আবার ইতিহাস রচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে নাসা।
তাদের নতুন কর্মসূচি আর্টেমিস প্রোগ্রাম—যার লক্ষ্য কেবল চাঁদে ফেরা নয়, বরং সেখানে স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করে ভবিষ্যতের মঙ্গল যাত্রার সিঁড়ি গড়া।
এই কর্মসূচির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো আর্টেমিস–২। এই মিশনে নভোচারীরা পৃথিবী ছেড়ে সরাসরি চাঁদের কক্ষপথে গিয়ে ঘুরে আসবেন। তাঁরা অবতরণ করবেন না, কিন্তু এতদিন পর মানুষের আবার চাঁদের এত কাছাকাছি পৌঁছানো হবে এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
এ যেন অর্ধশতাব্দী পর আবার মানুষের প্রত্যাবর্তন—১৯৭২ সালের অ্যাপোলো–১৭–এর পর থেকে হারিয়ে যাওয়া রোমাঞ্চের পুনর্জাগরণ। আর এই আর্টেমিস–২–এর হাত ধরেই শুরু হবে নতুন অধ্যায়—ভবিষ্যতের আর্টেমিস–৩, যেখানে মানুষ আবার নামবে চাঁদের বুকে, এবার হয়তো কেবল পতাকা গেড়ে নয়, বরং চাঁদকে বানাবে মহাবিশ্ব জয় করার প্রথম ঘর।
রূপালি পর্দায়
চাঁদ নিয়ে স্বপ্নচর্চা শুধু বিজ্ঞান বা বিইয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং রূপালি পর্দাও পেয়েছে এর রোমাঞ্চ। সিনেমার ইতিহাসেই প্রথম দিকের মহাকাশ কল্পনা ছিল ফরাসি পরিচালক জর্জ মেলিয়ের কিংবদন্তি ছবি আ ট্রিপ টু দ্য মুন, ১৯০২। সেখানে চাঁদের চোখে রকেট বিধবার দৃশ্য সিনেমাপ্রেমীদের আজও মনে গেঁথে আছে। পরে স্ট্যানলি কুব্রিকের টু থাউজ্যান্ড ওয়ান: আ স্পেস অডিসি, ১৯৬৮ মহাকাশ কল্পনার জগতে এনে দেয় দার্শনিক গভীরতা ও ভিজ্যুয়াল বিপ্লব। সত্তরের দশকে তৈরি মুনরেকার, ১৯৭৯ নামের জেমস বন্ড ছবিও মহাকাশ নিয়ে জনমনে কৌতূহল বাড়ায়।
সাম্প্রতিক সময়ে Apollo 13 (অ্যাপোলো ১৩, ১৯৯৫) আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে মহাকাশ অভিযানের ঝুঁকি ও সাহসিকতার গল্প, আর First Man (ফার্স্ট ম্যান, ২০১৮) তুলে ধরেছে নীল আর্মস্ট্রংয়ের মানবিক ও সংগ্রামী যাত্রা। এমনকি অ্যানিমেশনেও চাঁদ জনপ্রিয়—যেমন Despicable Me (ডেসপিকেবল মি, ২০১০)–তে চাঁদ চুরির মজার কাহিনি শিশুদের কল্পনা ছুঁয়ে গেছে।
অনন্ত রোমাঞ্চের প্রতীক
জুল ভার্নের কল্পনা, টিনটিনের দুঃসাহসিক অভিযান, আর অ্যাপোলো ১১–এর ইতিহাস—সবকিছু মিলে চাঁদ আজও রোমাঞ্চের প্রতীক। একসময় যা ছিল কেবল গল্প, তা-ই এখন বাস্তব বিজ্ঞান। আর এবার হয়তো চাঁদ হয়ে উঠবে মানবজাতির পরবর্তী ঘর, নতুন দিগন্তে যাত্রার সিঁড়ি।