Logo
×

Follow Us

ফিচার

নারী-পুরুষের কাজে প্রভাব ফেলে এসির তাপমাত্রা

Icon

জাকিয়া সুলতানা

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:৩১

নারী-পুরুষের কাজে প্রভাব ফেলে এসির তাপমাত্রা

ছবি : সাম্প্রতিক দেশকাল

ভাদ্রের তাল-পাকা গরমে ঘেমে-নেয়ে অফিসে ঢুকেই এসির তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে দিলেন বখতিয়ার চৌধুরী। কিছুক্ষণ বাদে তাহমিনা হক এসে সেই তাপমাত্রা তুলে দেন ২৫ ডিগ্রিতে। এতে বখতিয়ার কিছু না বললেও একটু বিরক্তই হন। যে অফিসগুলোতে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করেন, সেখানে এসি বন্ধ আর চালু করা নিয়ে এমন নীরব যুদ্ধ চলে। এ ক্ষেত্রে ইউএস অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একটি মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছে এবং তা হলো, অফিসে এসির তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা। তবে ২০১৫ সালে নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুসারে, অফিস ভবনের ভেতরে তাপমাত্রার এই মানদণ্ড ঠিক করা হয়েছে ‘১৯৬০-এর দশকে তৈরি করা থার্মাল কমফোর্ট মডেল’ অনুযায়ী।

অফিসের অতিরিক্ত ঠান্ডা পরিবেশ যে অস্বস্তি তৈরি করতে পারে তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। অফিসের তাপমাত্রা কাজের উৎপাদনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে নারীদের কাজে। অফিসে এসির তাপমাত্রা যত বাড়ানো হবে, অর্থাৎ ঠান্ডা যত কম হবে নারীর কাজ করার সক্ষমতা তত বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ও জার্মানির বার্লিন সোশ্যাল সায়েন্স সেন্টারের নতুন এক যৌথ গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণায় দেখা যায়, তাপমাত্রা বেশি হলে নারীরা গাণিতিক এবং কথা বলার মতো কাজগুলোয় আরো ভালো করেন। কিন্তু তাপমাত্রা যখন কম থাকে তখন পুরুষদের পারফরম্যান্স ভালো হয়। বার্লিন সোশ্যাল সায়েন্সেস সেন্টারের গবেষক এবং গবেষণা প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ড. অ্যাগনে কাজাকাইট বলেন, অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় ঘরের ভেতরে বা যেকোনো আবদ্ধ পরিবেশে বেশি তাপমাত্রা পছন্দ করেন। তবে এর সঙ্গে যে তাদের কাজের উৎপাদনশীলতাও জড়িত, সে বিষয়ে আগে কেউ কিছু বলেনি। আমরাই প্রথম দেখিয়েছি যে লিঙ্গভেদে তাপমাত্রা কমানো-বাড়ানো নিয়ে যুদ্ধ কেবল আরামের জন্য নয়, বরং এর সঙ্গে তাদের উৎপাদনশীলতা আর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মক্ষমতাও প্রভাবিত হয়।

এ বিষয়ে পরীক্ষা চালানোর সময় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন তাপমাত্রায় বিভিন্ন পরীক্ষা দিতে বলা হয়। একেক সময় তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস করা হয়। প্রতিটি সেশনে অংশগ্রহণকারীদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনটি ভিন্ন মৌখিক এবং গণিতের কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছিল। কক্ষের তাপমাত্রা এবং মৌখিক ও গাণিতিক কাজগুলোয় অংশগ্রহণকারীদের নম্বরের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। তবে কগনিটিভ রিফ্লেকশন টেস্ট অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক পরীক্ষায় পুরুষ ও নারীদের মধ্যে এই তাপমাত্রার তারতম্য কোনো প্রভাব ফেলেনি।

গবেষক কাজাকাইট বলেন, ‘পুরুষরা কম তাপমাত্রায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল এবং নারীরা উচ্চ তাপমাত্রায় উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো পারফর্ম করেছে।’ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টম চ্যাং অফিসের তাপমাত্রা আরামের বাইরে দৈনন্দিন কাজের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে কি না তা বিবেচনা করে এই গবেষণাটি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, ‘এই গবেষণাটি এত মনোযোগ পেয়েছে, কারণ অফিসে তাপমাত্রা বাড়ানো-কমানো নিয়ে যে যুদ্ধ রয়েছে, সেটা সমন্বয় করা প্রয়োজন।’

গবেষকদের পরামর্শ, যে কর্মক্ষেত্রগুলোতে পুরুষ ও নারী সহাবস্থান করেন, তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে অফিসের ভেতরের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হওয়া উচিত। কাজাকাইট বলেন, অফিস ম্যানেজমেন্টের উচিত, তাপমাত্রার দিকে আরো মনোযোগ দেওয়া। কর্মীরা কী বলেন, সেটা শোনা এবং তাদের অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত, কারণ এটি তাদের উৎপাদনশীলতার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।

সমস্যা হলো, বেশির ভাগ অফিস ষাটের দশকের একটি পুরোনো সূত্র অনুসারে চলে। ওই সূত্র অনুযায়ী তাপমাত্রা সেট করার ক্ষেত্রে মূলত কর্মীদের মেটাবোলিজম রেট বা হজমশক্তিকে একটি রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে নেওয়া হয়েছে। ৪০ বছর বয়সী এবং প্রায় ৭০ কিলো ওজনের একজন ব্যক্তির শরীরে খাবার হজম করতে যে তাপ উৎপাদনের প্রয়োজন, এই সূচকটি দিয়ে সেটি গণনা করা হয়েছে।

কিন্তু নারীদের মেটাবোলিজম সাধারণত পুরুষদের তুলনায় ধীরগতির হয়, অর্থাৎ নারীদের কম তাপ হারাতে হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সামান্য উষ্ণ পরিবেশ প্রয়োজন। আরেকটি মূল কারণ, নারীদের গঠন পুরুষদের তুলনায় কিছুটা ছোট হয় এবং তাদের শরীরের চর্বি বেশি থাকে, যার কারণে খাবার হজমের শক্তি আসে চর্বি থেকে এবং এটি পেশী থেকে আসা শক্তির তুলনায় ধীরে কাজ করে। এ কারণে নারীদের শরীরে হজম প্রক্রিয়ায় তাপ কম উৎপন্ন হয়। তাই তাদের বেশি ঠান্ডার প্রয়োজন নেই।

বর্তমান সূত্রটি অর্ধ শতাব্দী আগের শ্রমশক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে বেশির ভাগ পুরুষদের নেওয়া হয়েছে। আরেকটি বিষয়, যা গবেষণায় উঠে আসেনি, সেটা হলো নারীরা সাধারণত আরামদায়ক ঢিলেঢালা পোশাক পরেন, যা তাদের ঠান্ডা লাগার একটি বড় কারণ। কিন্তু অনেক অফিসে পুরুষদের স্যুট-টাই পরে থাকতে হয়।

গবেষকরা গবেষণায় অফিসে এসির তাপমাত্রা আরামদায়ক রাখার ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য কমানোর পাশাপাশি বিশ্ব উষ্ণায়ন মোকাবিলায় গ্রীষ্মকালেও অফিসগুলোকে কিছুটা উষ্ণ তাপমাত্রায় রাখার সুপারিশ করেছেন। একই সঙ্গে গবেষকরা শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপের অন্যান্য মানদণ্ড এই মডেলে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। যেমন ওজন ও বয়সের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা অনুভবে হেরফের হয়। স্থূল মানুষের গরম লাগার প্রবণতা বেশি, আবার বয়স্ক ব্যক্তিদের হজম প্রক্রিয়া খুব ধীরগতিতে হয়।

কে কোন তাপমাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন সেটার নিখুঁত কোনো মানদণ্ড নেই। আবার কোনো একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা নিয়ে সবাইকে একমত করাও সম্ভব নয়। কারো খুব ঠান্ডা লাগতে পারে, ওই একই মাত্রায় অনেকের আবার গরম লাগতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি আন্তর্জাতিক দল, ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া এসির একটি আদর্শ তাপমাত্রা কী, তা নির্ধারণ করেছে। গবেষণা দলটি যাচাই করে দেখেছে, দিনের বেলায় যদি অফিস বা কোনো আবদ্ধ স্থানের ভেতরের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে না নামে এবং ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর না ওঠে তাহলে সেই তাপমাত্রাকে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ বলা যেতে পারে। এই সীমার বাইরে গেলেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

গবেষকরা জানিয়েছেন, তাপমাত্রার ক্ষেত্রে যদি একটি মাত্র নিখুঁত পরিমাপ বেছে নিতে বলা হয়, সে ক্ষেত্রে তা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে। ভারতের ব্যুরো অব এনার্জি এফিশিয়েন্সির একটি গবেষণা অনুযায়ী, এসির তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রিতে রাখা সবচেয়ে ভালো। এ ছাড়া এসির তাপমাত্রা যত বাড়ানো হয়, প্রতি ডিগ্রিতে ৬ শতাংশ করে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। তাই এসি ২৪ ডিগ্রিতে চালিয়ে রাখলে বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয় হয়। সূত্র : বিবিসি

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫