Logo
×

Follow Us

ফিচার

বৈপরীত্য ও ভালোবাসার সেতুবন্ধ অরুন্ধতী রায়ের স্মৃতিকথা

Icon

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:১৩

বৈপরীত্য ও ভালোবাসার সেতুবন্ধ  অরুন্ধতী রায়ের স্মৃতিকথা

অরুন্ধতী রায় ছবি : সংগৃহীত

গত ২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে অরুন্ধতী রায়ের স্মৃতিকথা ‘মাদার মেরি কামস টু মি’। এ গ্রন্থের কেন্দ্রে রয়েছে তার অস্থির, তেজস্বী মা মেরি রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক, যিনি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ৮৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন। প্রতিটি স্মৃতিকথাই এক ধরনের হিসাব-নিকাশ। লেখক তার জীবনের সব রূপ ও পরিচয়ের হিসাব মেলান। তিনি জীবনের যেসব রূপ একসঙ্গে কাটিয়েছেন, তার মীমাংসা করেন। এই গ্রন্থে অরুন্ধতী তুলে ধরেছেন মা-মেয়ে সম্পর্ক, একজন সিঙ্গেল মাদার নারীর সংগ্রাম এবং সমাজে তার কর্মের প্রতিফলন, যা গ্রন্থটিকে সাধারণ মানুষের কথ্য করে তুলেছে।

মায়ের মৃত্যুর অভিঘাতে বিদীর্ণহৃদয় অরুন্ধতী সেসব পথেই ফিরে তাকান, যেগুলো তিনি সুদূর অতীতে পেরিয়ে এসেছেন। স্মৃতিকথা শুরু হয় মায়ের জীবনাবসান দিয়ে, তারপর ঘুরপাক খেয়ে ফিরে যায় শুরুর দিকে। মায়ের সঙ্গে সন্তানের ভালোবাসা সহজাত, তবে সেই সন্তান যখন মাকে পর্যালোচনা করেন, মায়ের সংগ্রাম ও অনুভূতির মধ্য দিয়ে ভালোবাসেন, তখন তা বিশেষ হয়ে ওঠে।

‘মিসেস রায়’-যেভাবে তার ছাত্রছাত্রীরা, মেয়ে অরুন্ধতী এবং ছেলে ললিত কুমার ক্রিস্টোফার রায় তাকে সম্বোধন করতেন, ছিলেন প্রকৃতির এক দুর্দমনীয় শক্তি। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ এবং কোট্টায়ামে প্রতিষ্ঠিত ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্পাস ক্রিস্টি হাই স্কুলের (বর্তমানে পল্লী কুডাম) প্রতিষ্ঠাতা। মাদার মেরি কখনোই ‘সবকিছু যেমন চলছে, তেমনই চলতে দাও’ বলার মানুষ ছিলেন না।

কয়েক বছর আগে ওয়েইনাড় সাহিত্য উৎসবে অরুন্ধতী এক লোকারণ্য সভায় বলেছিলেন, মেরি রায় ছিলেন তার চেনা সবচেয়ে অসাধারণ নারীদের একজন। তিনি সহাস্যে যোগ করেন, ‘আর এর অন্যতম কারণ ছিল তিনি একদমই ভালো মা ছিলেন না। তাকে ভালোবাসতে গিয়ে, তার জেদি স্বভাবের প্রশংসা করার জন্য আমার নিজেকে কন্যা পরিচয় থেকে মুক্ত করতে হয়েছিল।’


স্মৃতিকথায় দেখা যায়, মেরি রায় প্রায়ই সন্তানদের ওপর রাগ ঝাড়তেন। তিন বছরের অরুন্ধতী মায়ের নিষ্ঠুর আচরণ সইতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, হাঁপানির শ্বাসকষ্ট মাকে আরো নির্মম করে তোলে। অরুন্ধতী ও দেড় বছরের বড় ভাই মায়ের হাতে নিগৃহীত, তিরস্কৃত, অপমানিত হতে হতে নীরব, পলায়নপর হয়ে যায়। ভাইয়ের মনে কিছু স্মৃতি আছে, তবে তিন বছরের অরুন্ধতীর নেই। মা মেরিই তার পৃথিবী। মাকে সে নিজের সর্বস্ব দিয়ে অসহায়ভাবে ভালোবাসে।

মেরি যেমন মেয়েকে গড়ে তুলতেন, তেমনি আবার গুঁড়িয়ে দিতেন। তিনি যেমন মেয়েকে চিন্তা করতে শিখিয়েছিলেন, তেমনি আবার তার চিন্তার জন্যই ক্ষুব্ধ হতেন। স্মৃতিকথার শুরুতেই অরুন্ধতী বলেছেন, মায়ের এই বৈপরীত্য বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি নিজেই এক গোলকধাঁধায় পড়ে যান। আর এই অনুসন্ধানই তাকে আজকের অরুন্ধতীতে পরিণত করেছে।

বড় হওয়ার পর অরুন্ধতী বুঝতে পারলেন, মেরির বাস্তবতাও ছিল ভীষণ বৈরী। মেরির বাবা মদাসক্ত ও অত্যাচারী ছিলেন, মেরি ঠিক করেন, প্রথম যে বিয়ের প্রস্তাব দেবে, তাকেই বিয়ে করবেন। বিয়ে করে দেখলেন, স্বামী মদ্যপানে আসক্ত ‘এক অস্তিত্বহীন মানুষ’। এ ছাড়া উদ্ধত ভাই জর্জ ইসাকও ছিলেন প্রতিকূল। ছোটবেলায় অরুন্ধতী মাকে ভালোবাসতেন ‘অযৌক্তিকভাবে, ভয়ে-ভয়ে, নিঃশর্তভাবে’; প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে তিনি চেয়েছিলেন মাকে ভালোবাসতে ‘শীতলভাবে, যুক্তিসংগতভাবে আর নিরাপদ দূরত্বে থেকে’-যদিও প্রায়ই ব্যর্থ হয়েছেন।

বইটির প্রথমাংশে অরুন্ধতী বর্ণনা করেছেন, কীভাবে মা সন্তানদের নিয়ে আসাম থেকে কেরালায় গিয়ে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান গড়েন। মদ্যপ বাবা রাজীব মাইকেল রায় (‘মিকি রায়’) সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন আসামের চা-বাগানে। সংসার জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে মেরি সন্তানদের নিয়ে কলকাতা হয়ে তামিলনাড়ুর উটিতে চলে যান। পরে কেরালার আয়েমেনেম গ্রামে যান, যা কোট্টায়ামের কাছে, মীনাচিল নদীর তীরে অবস্থিত। এটিই মেরির জন্মস্থান। উপার্জনহীন, দরিদ্র পরিবারটি পৈতৃক এক কামরার বাসায় আশ্রয় নেয়। উটিতে পাড়ি দেওয়ার সময় অরুন্ধতীর বয়স ছিল তিন, ললিতের সাড়ে চার। তাদের বাবার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ হয় কেবল বিশের কোঠায় পৌঁছানোর পর। উটিতে মা-সন্তান ত্রয়ীর এই ‘পলাতক জীবন’-এর দিনলিপি লিখেছেন অরুন্ধতী।

একদিন তাদের মামা জর্জ ও নানি হঠাৎ হাজির হন উচ্ছেদ করতে। যুক্তি-এক মেয়ে, যে এক বাঙালি হিন্দুকে বিয়ে করে এবং পরে তালাক দিয়ে সিরীয় খ্রিষ্টান সমাজে কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছে, তার বাবার বাড়িতে থাকার অধিকার নেই। আয়েমেনেমে থাকাকালীন একক মা ও সন্তানদের আত্মীয়স্বজন ও সমাজ, দুই পক্ষ থেকেই অবাঞ্ছিত করে তোলা হয়। এই অংশ ভীষণ হৃদয়বিদারক। অরুন্ধতী সেই তীব্রতা ও অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন, যা পরে ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ গ্রন্থে ফুটে ওঠে।

সেই সময় সিরীয় খ্রিষ্টান সমাজে মেয়েরা সম্পত্তির অধিকার পেত না। মেরি নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন পৈতৃক সম্পত্তিতে সমান অধিকারের দাবিতে। আদালত তাদের উত্তরাধিকারে সমান অধিকার নিশ্চিত করে। কোট্টায়ামে রোটারি ক্লাবের ঘর নিয়ে মেরি শুরু করেন স্কুল, যা তাকে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত করে।

স্মৃতিকথার দ্বিতীয়ার্ধে অরুন্ধতী যান দিল্লিতে, স্কুল অব প্ল্যানিং অ্যান্ড আর্কিটেকচারে পড়তে। তখন তার বয়স ১৬; মায়ের বিরুদ্ধে গিয়েই পরিবার থেকে পালিয়ে যান। সাত বছর মায়ের সঙ্গে দেখা করেননি, মা-ও খবর নেননি। পরে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ ম্যাগাজিনে তার প্রবন্ধ দেখে ফোন নম্বর জোগাড় করতে পেরেছিলেন। অরুন্ধতী নিজের খরচায় পড়াশোনা করেন। তিনি বিয়েও করেন প্রথম প্রেমিক গেরার্ড দা কুনহা ওরফে জেসিকে। তখন তারা উপকূলীয় শহর গোয়ায় বসবাস করতেন। সেখানে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে থাকেন। ফিরে আসেন দিল্লিতে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব আরবান অ্যাফেয়ার্সে চাকরি পান। স্বতন্ত্র চলচ্চিত্রকার প্রদীপ কৃষাণের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনিই অরুন্ধতীকে ‘মেসি সাহিব’ (১৯৮৫) নামের ঔপনিবেশিক ভারত সম্পর্কিত একটি চলচ্চিত্রে অন্যতম নারী চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। পরবর্তীকালে তারা বিয়েও করেন। জীবনে আর্থিক স্থায়িত্ব আসার পরও চলে যান প্রদীপ ও তার সন্তানদের সঙ্গে গড়ে তোলা আপাত সুখের ঘর ছেড়ে।

স্মৃতিকথায় নিজের ব্যক্তিগত জীবনের-চলচ্চিত্র নির্মাণ, লেখালেখি, গণবুদ্ধিজীবিতা, গণ-আন্দোলনে অংশগ্রহণ-সব ইতিহাস লিখেছেন অরুন্ধতী। প্রতিবার জীবন সন্ধিক্ষণে এসে তিনি বুঝেছেন, তার শিক্ষা ও বেড়ে ওঠার পটভূমি তাকে বিকল্প দিয়েছে, যা দেশের লাখ লাখ মানুষের নাগালের বাইরে। এ জন্য এবং তার ইস্পাতদৃঢ় মেরুদণ্ডের জন্য তিনি কৃতজ্ঞ তার মায়ের প্রতি। তিনি লিখেছেন, ‘যত অস্থির ও দুর্বলই হোক না কেন আমার পরিস্থিতি, আমি কোনো দিন তা ভুলিনি।’ আর প্রতিটি বাঁকবদলে মায়ের ছায়া অরুন্ধতীকে পথ নির্ধারণে সাহায্য করেছে।

দীর্ঘ নীরবতার পর মা-মেয়ের পুনর্মিলন হয়। তখন শুরু হয় জীবনের সেই ধাপ, মাকে ভালোবাসার চেষ্টা করা ‘শীতলভাবে, যুক্তিসংগতভাবে, আর নিরাপদ দূরত্বে থেকে।’ বছরের পর বছর অরুন্ধতী নিজেকে অভিনেত্রী, অ্যাক্টিভিস্ট, চিত্রনাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক হিসেবে গড়ে তুলছিলেন; মায়ের উপস্থিতি ছিল ‘আশ্রয় ও ঝড়’ দুটি মিলিত রূপেই।

অরুন্ধতীর প্রথম উপন্যাস ‘গড অব স্মল থিংস’ তাকে ৩৬ বছর বয়সে এনে দিয়েছিল বিপুল খ্যাতি ও বুকার পুরস্কার। তবে তার আগে ১২ বছরের জীবন ছিল কষ্ট ও সংগ্রামের। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, বস্তারে মাওবাদীদের সঙ্গে অভিযাত্রা, হিন্দুত্ববাদ ও মুসলিম-বিদ্বেষের প্রতিবাদ, কাশ্মীরের ঘটনাবলি, ‘মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’-সব মিলিয়ে একজন স্পষ্টবাদী, তেজস্বিনী, প্রতিবাদী গণবুদ্ধিজীবীর ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

গণবুদ্ধিজীবী বলতে বোঝায় এমন এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীকে, যারা কেবল জ্ঞানচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন; বরং সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুক্তি, অধিকার ও ন্যায়ের সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তারা নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের জীবনের সঙ্গে নিজেদের ভাবনাকে যুক্ত করেন এবং জ্ঞানচর্চাকে কেবল পেশাগত দায়িত্ব নয়; বরং রাজনৈতিক ও নৈতিক দায় হিসেবে বিবেচনা করেন।

এই স্মৃতিকথা হলো অরুন্ধতীর শিকড়ের গল্প-একজন লেখক, নিভৃতচারী ব্যক্তি, গণবুদ্ধিজীবী এবং ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্য বলার সাহসের উৎস। তিনি পাঠকদের জন্য নিজের ব্যক্তিগত খসড়া শেয়ার করেছেন। লক্ষ্য হলো, ভালোবাসার দ্বৈততা গুছিয়ে তোলা নয়; জীবনকে সুন্দর সাজানো অংশে পরিণত করাও নয়। স্মৃতিকথা হলো ভালোবাসার স্মৃতি ও ব্যক্তিগত যন্ত্রণার মধ্যকার ফারাক ঘুচিয়ে দেওয়ার এক সেতুবন্ধ।

গ্রন্থে তিনি স্বীকার করেছেন, মায়ের মৃত্যুতে যে অতল দুঃখ অনুভব করেছেন, তার ভাই তেমন কিছুই অনুভব করেননি। এই বিপুল শোক তার কাছে রহস্যময়। এখানেই তিনি বৃহৎ পরিসরে ভাবেন-নিজেকে বোঝা গেলে হয়তো বিশ্ব ও দেশকেও বোঝা যেত-কীভাবে অনেক মানুষ তাদের নিপীড়কদেরই পূজা করে; আর তাদের কী করতে হবে, কী পরতে হবে, কী খেতে হবে-এমনকি কীভাবে ভাবতে হবে, সেই নির্দেশদাতাদের প্রতিও কৃতজ্ঞবোধ করে।

‘মাদার মেরি কামস টু মি’ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি আমাদের আহ্বান জানান, মা ও মেয়ে, আত্মীয়তা ও বন্ধুত্ব, জাতিসত্তা ও ব্যক্তিসত্তা, দেশপ্রেম ও প্রগতি সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করতে। তার নীতি হলো জটিলতা ও বৈপরীত্যকে আলিঙ্গন করা, কোনো পরিপাটি মোড়কে সাজানো নয়। অরুন্ধতী স্বচ্ছতা খোঁজেন, তবে শিক্ষণীয় উপদেশ পাঠকের কণ্ঠে চাপিয়ে দেন না। বইটি সুচারু বিন্যাসে গড়া এক অনুসন্ধান-মানব বাস্তবতার গভীরে লুকিয়ে থাকা জটিল বন্ধনের প্রতিফলন; এর উদ্দেশ্য সমাধান নয়। তিনি বলেন, ‘হয়তো কিছু কিছু বিষয় না বোঝাই ভালো...আমি তো সেই অধরা পর্বতের পক্ষে, সেই অজেয় চন্দ্রালোকের পক্ষে।’ এ কারণেই তার স্মৃতিকথায় বাস্তব জীবন ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে, যা পাঠকের মনে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা দেয়।

মাদার মেরি কামস টু মি। অরুন্ধতী রায়। স্ক্রিবনার। ৩৫২ পৃষ্ঠা। ৩০ ডলার / ৮৯৯ রুপি [হার্ড কাভার]

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫