Logo
×

Follow Us

ফিচার

বনদস্যু আতঙ্ক : পেশা ছাড়ছেন বনজীবীরা

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:২৩

বনদস্যু আতঙ্ক : পেশা ছাড়ছেন বনজীবীরা

সুন্দরবনের আত্মসমর্পণকারী একদল জলদস্যু ছবি : সংগৃহীত

সুন্দরবন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য। ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বনে একসময় রাজত্ব করেছে দুটি শক্তি-রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর ভয়ংকর জলদস্যুরা। জনবল ও অস্ত্রবল নির্ধারণ করেছে দলের কাঠামো ও প্রভাব। কিন্তু সহসাই প্রশ্ন জাগে-কারা জলদস্যু হয়, কেন হয়? এ ক্ষেত্রে প্রথম যে কথাটি বলতে হয়, তাহলো সুন্দরবন এলাকার একটি চক্র আছে, যারা এখানে ডাকাত তৈরি করে, টাকা দেয় এবং তাদের দিয়ে বিভিন্ন স্বার্থ হাসিল করে। এমনকি অস্ত্র বিক্রির কথাও বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। জেলেদের কাছ থেকে জলদস্যুরা যে চাঁদা আদায় করে, তার একটি বড় অংশ পান অন্ধকারে থাকা চক্রের মহাজনরা। তারাই জল-বনদস্যুদের পৃষ্ঠপোষক। 

উপকূলের প্রভাবশালী একশ্রেণির মাছ ব্যবসায়ী, যারা এলাকায় ‘কোম্পানি মহাজন’ নামে পরিচিত, এরাই এই বনে সরকারের সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা জিইয়ে রেখেছে। তাদের নির্দেশে জেলেরা নদীতে বিষ ছিটিয়ে মাছ ধরে, দস্যুদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে দেন, প্রায় সময় মুক্তিপণও পাঠান। এতে দস্যুদের হাতে যায় টাকার জোগান, আর বিষে নষ্ট হয় সুন্দরবনের পরিবেশ। প্রভাবশালীদের মধ্যে বড় মাছ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় রাজনীতিবিদ যেমন রয়েছেন, তেমনি আছে প্রশাসন ও সংবাদকর্মীদের মতো চক্র।  

সুন্দরবন এলাকায় এমন এক অদৃশ্য শাসন চলে, যার কারণে নির্যাতিত হয়ে প্রতিশোধ নিতেও অনেকে দস্যু হয়ে যায়। ‘বাবু বাহিনী’র বাবুর কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এক মহাজন তাকে ঋণের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর পর তিনি দস্যু জীবনে আসেন।

সব জলদস্যুর জীবনের গল্প এক না হলেও দস্যুবৃত্তির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থেকেই তারা বাহিনী তৈরি করে ফেলে। সুন্দরবনের আতঙ্ক মজনু বাহিনীর মজনুর কথাই ধরা যাক। তার আসল ব্যবসা ছিল জলদস্যুদের বিভিন্ন জিনিসপত্র সরবরাহ করা। পরে তিনি মোতালেব বাহিনীর একজন অংশীদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। মোতালেব বাহিনীর প্রধান মোতালেব ২০১১ সালে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর মজনু গাজী দলনেতা হন। আরেক আতঙ্ক মাস্টার বাহিনীর প্রধান কাদের মাস্টার জলদস্যু দলে যোগদান করে দলের প্রধান নোয়া মিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে দলের নেতৃত্ব নিয়ে নেন। জাহাঙ্গীর বাহিনীর নেতা জাহাঙ্গীর শিকারি। সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চল, অর্থাৎ চাঁদপাই রেঞ্জের পশুর নদীর দুই পারের এলাকা ছিল জাহাঙ্গীর বাহিনীর সীমানা। জলদস্যু দলের মধ্যে এই জাহাঙ্গীর শিকারিকে সবচেয়ে অত্যাচারী বলে ভয় পেতেন জেলেরা। নোয়া বাহিনীর দলনেতা নোয়া মিয়া পশ্চিম সুন্দরবনের ভারত সীমান্ত থেকে শিবসা নদী পর্যন্ত এই দলের তৎপরতার সীমানা। দলনেতা নোয়া মিয়া ছিলেন মাস্টার বাহিনীর সাবেক প্রধান। নেতৃত্ব নিয়ে সমস্যা শুরু হলে তিনি দলের ভেতরে অভ্যুত্থানের শিকার হন এবং দল থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে তিনি নিজের দল গড়ে তোলেন। 

ছোট ছোট দস্যু দল ছাড়াও বড় দলগুলোর বাইরে সুন্দরবন এবং উপকূলীয় এলাকায় একসময় কতগুলো উপদল তৎপর ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আলম বাহিনী, শান্ত বাহিনী, সাগর বাহিনী, খোকা বাবু বাহিনী, ছোট রাজু বাহিনী এবং কবিরাজ বাহিনী নামে অনেক বাহিনী।

২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনে ৩২টি দস্যু বাহিনীর তিনশোর বেশি সদস্য আত্মসমর্পণ করে। এরপর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পয়লা নভেম্বর দিনটিকে ‘দস্যুমুক্ত সুন্দরবন’ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। কিন্তু আত্মসমর্পণের তিন বছরের আত্মসমর্পণকারীদের মনে হয় তাদের শর্ত মানা হচ্ছে না। 

২০২১ সালের ১ নভেম্বর গণমাধ্যমে তারা অভিযোগ করেছিল, তিন বছর আগে তারা আত্মসমর্পণ করলেও মামলা তুলে নেওয়ার অন্যতম প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা বহাল থাকায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে এখন তারা আদালতে আদালতে ঘুরছেন। 

সুন্দরবনের দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে ছয় বছর ধরে মামলা মোকদ্দমা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে। তিনি বলেছেন, সরকার তাদের তখন পুনর্বাসনের জন্য এক লাখ টাকা করে দিয়েছিল। কিন্তু মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের অন্যতম যে প্রতিশ্রুতি ছিল, সেটা হয়নি।

মামলা বহাল থাকায় আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। অধিকাংশ আত্মসমর্পণকারীর অভিযোগ এক। তারা সরকারি সাহায্য কিছু পেয়েছেন; কিন্তু মামলার উকিলের জন্য অর্থ জোগাড় করতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। মামলার প্যাঁচ থেকে তাদের মুক্তি দিলে তারা অন্য কাজে চলে যেত। এমন কথা বারবার বললেও তাদের মামলা তুলে নেওয়া হয়নি। মামলার জটিলতায় তারা হতাশ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে অনেকে স্বাভাবিক জীবন থেকে আবার ফিরে যাচ্ছে পুরোনো পেশায়। তবে এখন নতুন নতুন বাহিনীও ঢুকছে। শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে বনজীবী মেহনতী মানুষের। এখন সুন্দরবনে আবার দস্যু আতঙ্ক বিরাজ করছে, যা বনের ওপর নির্ভরশীল জেলে ও মৌয়ালদের শঙ্কিত করেছে। গত বছরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সরকার পতনের ডামাডোলের সুযোগে দুলাভাই বাহিনীসহ সুন্দরবনে আবার সক্রিয় হয়েছে অন্তত ১৪টি দস্যুদল। নতুন দস্যু বাহিনীর উত্থান এবং আগের আত্মসমর্পিত দস্যুদের ফিরে আসার যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে সুন্দরবনের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হচ্ছে। দস্যুরা জেলেদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, মাছ ও মধু ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও এরই মধ্যে দস্যুদের উৎপাতে বনজীবীরা পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন।

দস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার ভয়ে সুন্দরবনে যেতে ভয় পাচ্ছেন জেলে ও মৌয়ালরা। দস্যুদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সূত্র বলছে, গত তিন মাসে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ জনেরও বেশি জেলে ও মৌয়াল অপহরণের শিকার হয়েছেন। মুক্তিপণের জন্য তাদের কাছে দাবি করা হয়েছে ১০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে কোস্ট গার্ড সফল অভিযানের মাধ্যমে জেলে-বাওয়ালিদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুন্দরবনসংশ্লিষ্ট একাধিক জেলে ও বনজীবীরা বলছেন, বর্তমানে বিভিন্ন নামে নতুন বনদস্যু বাহিনী গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে করিম শরীফ বাহিনী, দয়াল বাহিনীসহ অন্তত পাঁচ-সাতটি ডাকাতদল রয়েছে। এই বনদস্যুরা সুন্দরবনের গহিনে নৌকায় অবস্থান করে। বনের বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে এদের ডেরা। সুযোগ বুঝে এই বনদস্যুরা মাছ ধরার ট্রলার কিংবা বনজীবীদের জিম্মি করে। অপহরণের পর বনদস্যু বাহিনীর ডেরায় নিয়ে করা হয় নির্যাতন। অনেকেই মুক্তিপণ দিয়ে সেখান থেকে ছাড়া পেয়েছেন।

অপহরণের শিকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার চেয়ারম্যান মোড়ের এক জেলে বলেন, ‘সুন্দরবনের যে কয়টি দস্যু বাহিনী এই মুহূর্তে সক্রিয় রয়েছে তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মাছ ধরার ট্রলারে হামলা করে অপহরণ করে। এরা এতটাই কুখ্যাত যে মুক্তিপণের টাকা না দিলে নির্মম নির্যাতন চালায়। এরা কাউকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করে না।’   

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘বনদস্যুরা সাধারণত বনজীবী কিংবা জেলে বাওয়ালিদের ছদ্মবেশে সুন্দরবনের প্রবেশ করে দস্যুতায় জড়িয়ে পড়ে। এসব বনদস্যুর ডাটাবেইস তৈরি করে তাদের ডিজিটালাইজড করতে হবে, যাতে সহজেই তাদের চিহ্নিত করা যায়। তাদের চিহ্নিত করে সুন্দরবনে যাওয়া আটকাতে হবে। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে এবং পরিবারের প্রতিও নজর রাখতে হবে। সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর টহল ও নজরদারি বাড়াতে হবে। তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটি শুধু একটি নিরাপত্তার ইস্যু নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সংকটের দিকেও ইঙ্গিত করছে। যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এই প্রাকৃতিক সম্পদ ও এর ওপর নির্ভরশীল মানুষের ভবিষ্যৎ আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫