
অন্ধকার ভোরে হিমালয়ের বরফঢাকা ঢাল কাঁপছিল হিমেল বাতাসে। চারপাশে শুধু সাদা দিগন্ত, শ্বাস নেওয়া যেন এক যুদ্ধ। প্রতিটি নিঃশ্বাসে বুকের ভেতর শূন্যতার ছায়া জমে যাচ্ছিল। তারিখটা ২৬ সেপ্টেম্বর। ঠিক সেই মুহূর্তে হিমালয়ের অষ্টম সর্বোচ্চ শৃঙ্গে বাংলাদেশের পতাকার লাল-সবুজ আলোড়ন উঠল।
বাবর আলী, কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া ২৬ হাজার ৭৮১ ফুট উচ্চতার মানাসলু জয় করে দেশের ইতিহাসে নাম লেখালেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি অক্সিজেন ছাড়া আট হাজার মিটারি কোনো চূড়ায় পৌঁছালেন। প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই, প্রতিটি নিঃশ্বাস ছিল নিজের সীমা পরীক্ষা করার এক নীরব যুদ্ধ।
এই গল্পে আছেন আরো দুই বিজয়ী। তানভীর আহমেদ ছিলেন সেই ভোরে বাবরের সঙ্গী। জীবনের প্রথম আট-হাজারি অভিযানে মানাসলুর চূড়ায় পৌঁছানো তার জন্য এক অবিস্মরণীয় অর্জন। অন্ধকার, বরফ, ঝড়-সব বাধা পেছনে ফেলে তিনি প্রমাণ করলেন, সাহস আর একাগ্রতা থাকলে প্রথম চ্যালেঞ্জও জয় করা সম্ভব।
তবে এর এক দিন আগে অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর ভোর ৩টায়ও মানাসলুর চূড়ায় ওড়ে বাংলাদেশের পতাকা। মানাসলু বিজয়ী ওই দুঃসাহসী তৌফিক আহমেদ তমাল।
মৃত্যুর মুখোমুখি লড়াই
বাবর আলী, তানভীর আর তমালের জন্য ভোরের আলো ফোটার আগেই হিমালয়ের বরফে ঢাকা ঢালে জীবন-সংগ্রামের মুহূর্ত শুরু হয়েছিল। আট হাজার মিটারের ওপরে মানুষের শরীর স্বাভাবিক থাকে না। অক্সিজেন এতটাই কম যে প্রতিটি শ্বাস যেন শেষ শ্বাসের মতো। মাথা ঝিমঝিম করে, শরীর ভারী, মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত। এই অঞ্চলকেই অভিযাত্রীরা ডাকে ‘ডেথ জোন’। কয়েক ঘণ্টা টিকে থাকা বা শীর্ষে পৌঁছানো, সবই অসম্ভবের সঙ্গে লড়াই।
বাবর আলীর লড়াই ছিল বিশেষ রোমাঞ্চকর। কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া প্রতিটি পদক্ষেপে পেশি অবসন্ন, নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসা, মাথা ঘোরানো, তবু তিনি থেমে যাননি। প্রতিটি ধাক্কা ছিল নিজের সীমা ভাঙা, আত্মাকে জয় করার এক কঠিন পরীক্ষা।
তানভীর আর তমালের জন্যও চূড়ায় ওঠা মানে এক নতুন মাইলফলক। প্রথম আট-হাজারি চূড়ায় পৌঁছানো, বরফ ঝড় আর মৃত্যুর সঙ্গেই একসঙ্গে যুদ্ধ করা, সব মিলিয়ে এটি এক স্বপ্নের অর্জন।
অভিযানের শুরু ও প্রস্তুতি
বাবর আলী আর তানভীরের অভিযানের শুরুটা হয়েছিল ৫ সেপ্টেম্বর, কাঠমান্ডু থেকে। পাঁচ দিনের দীর্ঘ পদযাত্রা শেষে তারা পৌঁছান বেসক্যাম্পে। ধাপে ধাপে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর ২৪ সেপ্টেম্বর রাত নামতেই শুরু হয় শেষ চূড়ান্ত আরোহণ। রাতভর বরফে পথচলা, ঠান্ডার কামড় আর পাতলা বাতাসের লড়াই শেষে অবশেষে ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরে তারা দাঁড়ালেন পৃথিবীর শীর্ষের এক কোণ, মানাসলুর মাথায়।
এদিকে গত ১ সেপ্টেম্বর, কাঠমাণ্ডুর কোলাহল ছেড়ে দুর্গমের অভিযানে যাত্রা শুরু করেছিলেন তমাল। সর্বশেষ ২৩ সেপ্টেম্বর ক্যাম্প-০২ থেকে শুরু হওয়া যাত্রা ছিল টানা ছয় হাজার ৬০০ মিটার থেকে আট হাজার ১৬৩ মিটার পর্যন্ত উঠে যাওয়া, তারপর আবার এক দিনে নেমে আসেন বেসক্যাম্পে। মানে, পর্বতারোহণের ভাষায় এক রকম মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিযোগিতা।
ইতিহাসের দুঃসাহস
পর্বতারোহণের ইতিহাস বলছে, একসময় বিজ্ঞানীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, আট হাজার মিটারের ওপরে অক্সিজেন ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব। এমনকি তারা লিখেছিলেন, এমন চেষ্টা মানে আত্মহত্যা। কিন্তু ১৯৭৮ সালে ইতালির রাইনহোল্ড মেসনার ও অস্ট্রিয়ার পিটার হাবেলার প্রথম অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট জয় করে বিশ্বকে চমকে দেন। সেই মুহূর্ত থেকে জন্ম নেয় এক নতুন দর্শন, ‘পিওর মাউন্টেনিয়ারিং’। প্রযুক্তির বদলে কেবল নিজের শরীর, শ্বাস আর মানসিক শক্তিকে ভরসা করে পাহাড় জয়ের পথ।
বাবর আলী সেই দর্শনেরই একজন উত্তরসূরি। তার মানাসলু অভিযান ছিল এই যুগের আরেক দুঃসাহসিক পরীক্ষা।
মানাসলু : আত্মার পাহাড়, মৃত্যুর উপত্যকা নেপালি ভাষায় মানাসলু মানে আত্মার পাহাড়। আট হাজার ১৬৩ মিটার উচ্চতার এই শৃঙ্গ একদিকে অবিশ্বাস্য সুন্দর, অন্যদিকে ভয়ংকর রূপে অপ্রতিরোধ্য। বরফে মোড়া রিজ, অনিশ্চিত আবহাওয়া, হঠাৎ নেমে আসা ঝড় সব মিলিয়ে মানাসলু এক রহস্যময় পরীক্ষাগার, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে দোল খায়।
প্রথমবার এর শীর্ষ জয় হয় ১৯৫৬ সালের ৯ মে। জাপানি অভিযাত্রী তোশিও ইমানিশি ও শেরপা গ্যালজেন নরবু ইতিহাস গড়েছিলেন সে দিন। এরপর ১৫ বছর কেউ আর শীর্ষে পৌঁছাতে পারেননি। আবার ১৯৭১ সালে জাপানিরা এ পাহাড়ে ফিরল। ১৯৯৭ সালে অবশেষে আমেরিকানরা জয় করল মানাসলু। এই দীর্ঘ ব্যবধানই প্রমাণ করে মানাসলু কোনো সাধারণ পর্বত নয়, বরং মানুষের সাহসের সীমানা ঠেলে দেওয়ার এক নিষ্ঠুর পরীক্ষাগার।
কেন এত ভয়ংকর এই শৃঙ্গ?
প্রাণঘাতী তুষারধস : মানাসলুতে প্রায় প্রতি বছরই তুষারধস প্রাণ কেড়ে নেয়। ২০১২ সালে এক রাতেই ১১ আরোহী তুষারধসে প্রাণ হারিয়েছিলেন।
অতল ফাটল : পুরু বরফের নিচে লুকিয়ে থাকা হিমবাহের ফাটল মুহূর্তেই গিলে ফেলতে পারে ক্লান্ত অভিযাত্রীকে।
ডেথ জোনের অক্সিজেন সংকট : আট হাজার মিটারের ওপরে প্রতিটি শ্বাস নিতে গিয়ে মনে হয় ফুসফুস আগুনে জ্বলছে। শরীর ভেঙে পড়ে, মন বিভ্রান্ত হয়, সামান্য ভুল মানেই সর্বনাশ।
মৃত্যুর উপত্যকা থেকে আত্মার পাহাড়ে : পশ্চিম-মধ্য নেপালের মানসিরি হিমালে অবস্থিত এই শৃঙ্গকে হিমালয়ের সবচেয়ে ভয়ংকর আট-হাজারিদের একটি ধরা হয়। উচ্চতায় এটি অষ্টম হলেও প্রাণঘাতী পর্বতের তালিকায় মানাসলুর অবস্থান চতুর্থ।
মানাসলু আর বাংলাদেশ : বাংলাদেশিদের জন্য মানাসলু কোনো অচেনা নাম নয়। ২০০৮ সালে এম এ মুহিত ও নূর মোহাম্মদের প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তিন বছর পর, ২০১১ সালে মুহিত একা শিখরে পৌঁছান। যদিও সহযাত্রী নিশাত মজুমদার তখন ব্যর্থ হন। ২০২২ সালেও নিশাতের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা সফল হয়নি। সেই ইতিহাসকে নতুন রূপ দিলেন তিন বাংলাদেশি তৌফিক আহমেদ তমাল, বাবর আলী ও তানভীর আহমেদ।
তাদের পদচিহ্নে এখন জেগে উঠেছে নতুন এক দিগন্ত, যেখানে পাহাড় আর পতাকা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। আত্মার পাহাড় মানাসলুর শীর্ষে এই জয় শুধু দুজন আরোহীর নয়, এটি গোটা জাতির আত্মবিশ্বাসের উজ্জ্বল প্রতীক।
বাংলাদেশের গর্ব
বাবর আলী দেশের অন্যতম শীর্ষ পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের সাধারণ সম্পাদক। চিকিৎসক পেশার পাশাপাশি তিনি এখন মৃত্যুকে জয় করা সাহসী অভিযাত্রী। তানভীর আহমেদও একই ক্লাবের মাউন্টেনিয়ারিং সম্পাদক।
বাবার আলী এর আগে জয় করেছেন এভারেস্ট, লোৎসে ও অন্নপূর্ণা-১। তবে অক্সিজেনের সহায়তায়। এবার মানাসলু জয় তাকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায়, যেখানে ভরসা কেবল নিজের শ্বাস আর ইচ্ছাশক্তি।
যদিও এটি তানভীরের প্রথম আট-হাজারি অভিযান, এর আগে তিনি জয় করেছেন হিমালয়ের বহু কঠিন শৃঙ্গ, যেমনÑআমা দাবলাম, আইল্যান্ড পিক ও ভারতের বাঘিরথি-২। প্রতিটি অভিযানই ছিল তার বড় স্বপ্নের প্রস্তুতি। তৌফিকের এই অভিযান আরো বিশেষ, কারণ এটি সম্পূর্ণ নিজের অর্থায়নে। পর্বতারোহণের ইতিহাসে বাংলাদেশের জন্য এটি এক দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা।
বাবর, তানভীর ও তমাল যে পথ খুলে দিলেন, তা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা। সীমাহীন সাহস ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে অসম্ভব কিছু নেই। আগামীর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তারা আবারও উঠে যাবে হিমালয়ের অন্য শৃঙ্গ, আর প্রতিটি শীর্ষে উড়বে লাল-সবুজ পতাকা, বাংলাদেশের গর্ব।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে
মানাসলুর শীর্ষে দাঁড়িয়ে যেন নতুন এক দিগন্ত খুলে গেল তিন বাংলাদেশির সামনে। বিজয়ের আনন্দে ভিজলেও তাদের চোখ এখন আরো দূরে। আরো উঁচু, আরো চরম চ্যালেঞ্জের দিকে। পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা মিললে লাল-সবুজের পতাকা বারবার উড়বে পৃথিবীর ছাদে।
এই সাফল্য প্রমাণ করে দিল, সীমাহীন সাহস আর ইচ্ছাশক্তি থাকলে অসম্ভব বলে কিছু নেই। বাবর, তানভীর আর তমাল যে পথ খুলে দিলেন, সেটি আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণার আলো হয়ে থাকবে। সামনে অপেক্ষা করছে আরো বহু শিখর, আরো বহু চ্যালেঞ্জ। হয়তো একদিন ১৪টি আট-হাজারিই গর্বের সঙ্গে ছুঁয়ে আসবে বাংলাদেশ। আর প্রতিটি শীর্ষেই জেগে উঠবে একই গান, ‘আমরা পারি, আমরা পারব।’