
সশস্ত্র মাওবাদী গেরিলারা সুশৃঙ্খল ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন
তেলেঙ্গানার পাহাড়ি অরণ্যে, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে ক্লান্ত, ছত্রভঙ্গ হয়ে থাকা মাওবাদী শিবিরগুলোতে হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পড়ে এক অপ্রত্যাশিত সংবাদ। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও দলের মুখপাত্র মাল্লোজুলা ভেঙ্কটেশ রাও (৬৯), যিনি ‘অভয়’ নামে পরিচিত-এক ঘোষণাপত্রে লিখেছেন, ‘আমরা অস্ত্র পাশে রেখে আলোচনার পথে হাঁটতে প্রস্তুত।’ মাওবাদীদের ইতিহাসে এ যেন বিস্ময়কর এক মুহূর্ত। যে সংগঠন বছরের পর বছর ধরে ঘোষণা করে এসেছে, ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’, সেই সংগঠনের মুখপাত্রই প্রকাশ্যে অস্ত্রসমর্পণের কথা বলছেন। অভয়ের ভাই মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে এনকাউন্টারে নিহত হন।
অস্ত্রসমর্পণের ঘোষণাপত্রটি লেখা হয় ১৫ আগস্ট, তবে প্রকাশ পায় ১৬ সেপ্টেম্বর। শুধু তা-ই নয়, অভয় এর সঙ্গে জুড়ে দেন এক জিমেইল ঠিকানা, একটি ফেসবুক প্রোফাইল এবং নিজের ছবি। গোপন পার্টির জন্য যা অকল্পনীয়।
ছত্তিশগড় পুলিশ ঘোষণা দেয়, তারা বিবৃতির সত্যতা যাচাই করছে। তেলেঙ্গানার ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ জিতেন্দ্র মন্তব্য করেন, ‘এটা হয়তো মাওবাদীদের মনস্তাত্ত্বিক খেলা আমাদের সতর্কতা কতটা ঢিলে পড়ে, সেটা দেখার কৌশল।’
অভয় বলেছেন, দল সশস্ত্র সংগ্রাম স্থগিত করে জনগণের দৈনন্দিন সংগ্রামে অংশ নেবে। যদি সরকার ইতিবাচক সাড়া দেয়, তবে আলোচনার জন্য একটি প্রতিনিধিদলও গঠন করা হবে। এ ঘোষণার মধ্যেই উঠে আসে এ বছরের মে মাসে ছত্তিশগড়ে ভারতীয় বাহিনীর হাতে এনকাউন্টারে নিহত দলটির প্রধান নাম্বালা কেশব রাওয়ের (বাসবরাজ) কথা। অভয় জানান, আলোচনার উদ্যোগ নিতে বাসবরাজই উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
অথচ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বারবার দাবি করেছে, কোনো আলোচনার পথ খোলা নেই। চলমান ‘অপারেশন
কাগার’-এর লক্ষ্য ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যেই মাওবাদীদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা।
রাজ্য কমিটির পাল্টা অবস্থান
অভয়ের ঘোষণা প্রকাশের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই তেলেঙ্গানা রাজ্য কমিটির মুখপাত্র জগন পাল্টা বিবৃতি দেন। তার ভাষায়, ‘অভয়ের অবস্থান সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, দলের নয়। তিনি শুধু দলকে ক্ষতিই করেননি, বিভ্রান্তিও সৃষ্টি করেছেন।’ জনগণের দাবি, বিজেপি সরকার ফ্যাসিবাদী নীতিতে মাওবাদীদের নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে। তাই দলের সব স্তরের নেতাকর্মীকে সংগ্রাম আরো তীব্র করার আহ্বান জানান তিনি।
মে মাসে বসবরাজ নিহতের পর থেকেই শীর্ষ নেতৃত্বে শূন্যতা তৈরি হয়। এখন দলটিকে পুনর্গঠনের মতো প্রথমসারির জ্যেষ্ঠ নেতৃত্ব খুব বেশি অবশিষ্ট নেই, অভয়ের ঘোষণা তারই প্রমাণ। শোনা যাচ্ছে, মাওবাদী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তিপ্পারথি তিরুপতি সাধারণ সম্পাদক পদে বসেছেন। তেলেঙ্গানা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মাওবাদী পার্টিতে এখনো ১৪ জন তেলেগু নেতা রয়েছেন।
রক্তাক্ত পটভূমি
অপারেশন কাগার শুরু হওয়ার পর ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত চার শতাধিক মাওবাদী নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ছত্তিশগড়ে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ সদস্য উদয় (গজারলা রবি), মোডেম বলকৃষ্ণ, ঝাড়খণ্ডের প্রভেশ সোরেন, রাজ্য কমিটির গৌতম, ভাস্কার, অরুণা প্রমুখ।
প্রতিটি এনকাউন্টারকে সরকার সাফল্য হিসেবে দাবি করলেও মানবাধিকারকর্মীদের প্রশ্নÑএগুলো কি আদৌ সংঘর্ষ, নাকি সাজানো হত্যাকাণ্ড? অভয়ের ঘোষণায় মাওবাদী আন্দোলন যেন নতুন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে। একদিকে শান্তি আলোচনার আভাস, অন্যদিকে অপারেশন কাগারের ছায়া।
রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ
ছত্তিশগড়ের জঙ্গলে টানা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এক ধরনের যুদ্ধ চলছে, যেখানে রাষ্ট্র তার জনগণের ওপর ড্রোনসহ ব্যাপক সমরাস্ত্র ব্যবহার করছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন কাগার’। ভারত সরকারের দাবি-এটি সশস্ত্র মাওবাদী দমনের অভিযান। কিন্তু বাস্তবে এ অভিযানের অন্তরালে উন্মোচিত হচ্ছে ভিন্ন চিত্র। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, ২০২৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৫৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই আদিবাসী। নিহতদের অনেকের মৃত্যু যে ভুয়া ‘এনকাউন্টারে’ হয়েছে, সে অভিযোগও ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
মাটির নিচে সম্পদ, মাটির উপরে প্রতিরোধ
ছত্তিশগড় ভারতের অন্যতম খনিজসমৃদ্ধ রাজ্য। এই অঞ্চলের জমি ও পাহাড়ে লুকিয়ে আছে কয়লা, লোহা, বক্সাইট, হীরাসহ অমূল্য সম্পদ। সরকার দীর্ঘদিন ধরেই দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য এ অঞ্চলের দরজা খুলে দিতে চাইছে। কিন্তু সমস্যা হলো এই অঞ্চলের অধিবাসী আদিবাসী জনগোষ্ঠী। বন-জঙ্গল, পাহাড়-ঝরনা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জমি থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে তারা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সেই প্রতিরোধের প্রধান মুখ হয়ে ওঠে মাওবাদী আন্দোলন। ফলে সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর দমননীতির মূল নিশানা হয়ে ওঠেন মাওবাদীরাই।
ধারাবাহিক হত্যাযজ্ঞের চিত্র
জানুয়ারি ২০২৫-এ নিহত হন সিপিআইয়ের (মাওবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য চালাপতি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেন, এটি নকশালমুক্ত ভারতের পথে বড় সাফল্য। কয়েক মাসের ব্যবধানে ঝাড়খণ্ডে এক অভিযানে নিহত হন নেতা ভিভেকসহ আরো আটজন। সর্বশেষ আবুজমাড়ের জঙ্গলে ৭২ ঘণ্টার তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান ২৭ জন মাওবাদী, যাদের মধ্যে সংগঠনের মহাসচিব নাম্বালা কেশব রাও ওরফে বসবরাজুও ছিলেন।
শুধু তা-ই নয়, জুনের প্রথম সপ্তাহে টানা তিন দিনে নিহত হন আরো অন্তত সাতজন শীর্ষ নেতাÑসুধাকর, ভাস্কর, বন্দি প্রকাশ, পাপা রাওসহ অনেকে। বিজাপুর জেলার ইন্দ্রাবতী জাতীয় উদ্যানে উদ্ধার হয় আরো পাঁচ মৃতদেহ, যার মধ্যে দুজন নারীও ছিলেন।
পুলিশের দাবি, তারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে। কিন্তু বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি বলতে যা ঘটেছে, তা হলো সাপের কামড়, মৌমাছির হুল কিংবা পানিশূন্যতা। একদিকে দিনের পর দিন চলা ‘তীব্র লড়াই’, অন্যদিকে পুলিশের কোনো প্রাণহানি নেই-এমন বর্ণনা প্রশ্ন তোলে এনকাউন্টারগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। মানবাধিকার সংগঠন সিডিআরওর মতে, এগুলো আসলে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, যেখানে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে শুধু মাওবাদীদেরই।
২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিল-এনকাউন্টারে মৃত্যু হলে তাৎক্ষণিকভাবে এফআইআর করতে হবে, স্বাধীন তদন্ত চালাতে হবে এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত বাধ্যতামূলক করতে হবে। তদন্তে নিহতের পরিচয়, মৃত্যুর কারণ, ঘটনার স্থান-কাল নির্ধারণসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য নিতে হবে। কিন্তু ছত্তিশগড়ের ঘটনাগুলোতে এসব প্রক্রিয়ার কিছুই অনুসৃত হয়নি। বিচারপতি মারকানডে কাটজু ও জ্ঞান সুধা মিশ্র ২০১১ সালে বলেছিলেন, ভুয়া এনকাউন্টার আসলে ‘আইন রক্ষাকারীদের হাতে ঠান্ডা মাথায় সংঘটিত খুন।’ আজকের পরিস্থিতি যেন তাদের সেই মন্তব্যেরই প্রতিফলন।
আদালতে জমা দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার কথা থাকলেও রাজ্য সরকার সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। পরিবারগুলো প্রিয়জনের শেষকৃত্য করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত। মানবাধিকারকর্মী বেলা ভাটিয়া বলছেন, এটি সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।
আটক নেতাদের জীবন নিয়ে শঙ্কা
আটক নেতাদের জীবন নিয়ে শঙ্কা
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, সম্প্রতি নিহত কয়েকজন নেতাকে আগেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। এখনো রামান্না, দিলীপ, সিতু, সুনীতা, মহেশ, মুন্নাসহ একাধিক নেতা পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। আশঙ্কা আছে, তাদেরও শিগগিরই ভুয়া এনকাউন্টারের গল্প সাজিয়ে হত্যা করা হতে পারে।
সিডিআরও ও বিভিন্ন গণমানবাধিকার সংগঠনের দাবি-গ্রেপ্তারকৃত মাওবাদীদের অবিলম্বে আদালতে হাজির করতে হবে, প্রতিটি এনকাউন্টারের ওপর বিচার বিভাগীয় তদন্ত চালাতে হবে, নিহতদের মরদেহ সংরক্ষণ করে পুনরায় ময়নাতদন্ত করতে হবে, পরিবারগুলোর কাছে মরদেহ হস্তান্তর নিশ্চিত করতে হবে, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে, ভুয়া এনকাউন্টারের মাধ্যমে নয়, মানবাধিকারকর্মী ও সাধারণ মানুষকে অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা দিতে হবে; জল, বন, ভূমি ও খনিজ সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার নীতি বন্ধ করতে হবে এবং আদিবাসী উচ্ছেদ থামাতে হবে।
আজকের ছত্তিশগড় কেবল একটি রাজ্য বা আন্দোলনের গল্প নয়। এটি একদিকে রাষ্ট্রীয় দমননীতির নগ্ন রূপ, অন্যদিকে সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞার চিত্র। ভুয়া এনকাউন্টারের সংস্কৃতি শুধু মাওবাদীদের নয়, প্রশ্ন তুলছে ভারতের গণতান্ত্রিকব্যবস্থার অস্তিত্ব নিয়েই।
যে কারণে অস্ত্রসমর্পণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০১০ সালের পর থেকে মাওবাদী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি লক্ষ করলে দেখা যায়, পুরোনো নেতৃত্ব প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতাই হয় এনকাউন্টারে নিহত, নয়তো কারাগারে। কেউ কেউ আত্মসমর্পণ করেছেন; যেমন-ঝাড়খণ্ডের সুধাকর সারেন্ডার করেছিলেন। অমিতাভ বাগচীর মতো নেতারা কারাগারে বন্দি। নতুন প্রজন্মে কিছু তরুণ মুখ থাকলেও তাদের মধ্যে সেই সংগঠন পরিচালনার দক্ষতা বা রাজনৈতিক পরিপক্বতা অনুপস্থিত।
মাওবাদী পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের এক সাবেক সদস্য জানান, সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যে নেতৃত্ব উঠে এসেছিল, তারা মূলত বামপন্থি ছাত্র-যুব আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক মেধাবী কর্মী। গ্রামের লাখো মানুষকে সংঘবদ্ধ করে তারা সশস্ত্র সংগ্রামের ভিত গড়ে তোলেন। তাদের মধ্যে ছিল সাংগঠনিক বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের হাতে সেই শক্তি নেই। ফলে পুরোনো নেতারা শেষ হয়ে গেলে পার্টি মূলত নেতৃত্বহীন অবস্থায় ভেঙে পড়ে। অন্যদিকে আদিবাসী অঞ্চলের যে কর্মীরা স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠক হিসেবে খুব ভালো, তাদের সীমাবদ্ধতা হলো বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। তারা নিজেদের অঞ্চলে দুর্দান্ত সংগঠক হলেও সর্বভারতীয় স্তরে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি তৈরি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। গণপতি, কিষাণজি, কোবাদ গান্ধী, যারা একসময় সারা দেশে নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন, সেই মানের নেতৃত্ব আজ আর নেই।
পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৌম্য মণ্ডলের মতে, মাওবাদীদের এই বিপর্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তন। তিনি বলেন, “একসময় সরকারের পক্ষে গ্রামীণ উন্নয়নের কাজ করা সম্ভব ছিল না। রাস্তা, স্কুল ও হাসপাতালের অভাবেই মাওবাদীরা ‘জনতার উন্নয়ন’ করে জনপ্রিয়তা পেত। কিন্তু ২০০০ সালের পর মূলধনী বিনিয়োগে গ্রামীণ অবকাঠামো দ্রুত পরিবর্তিত হয়। বড় রাস্তা, মোবাইল টাওয়ার, বিদ্যুৎ, বাজার-এসব গ্রামে ঢুকে পড়ে। তরুণ প্রজন্ম আর গ্রামের ভেতরে বেকার থেকে মাওবাদী বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে না; তারা যাচ্ছে ব্যাঙ্গালোর-হায়দরাবাদের মতো শহরে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে। ফিরে আসছে টাকা হাতে, কিনছে বাইক, বানাচ্ছে পাকা ঘর। ফলে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেওয়ার প্রণোদনা দুর্বল হয়ে পড়ছে।”
সৌম্য আরো বলেন, “মোবাইল ফোনও মাওবাদীদের কৌশলকে ভেঙে দিয়েছে। আগে পুলিশ বা সেনা ঘাঁটিতে আক্রমণের পর দীর্ঘ সময় গোপন থাকা যেত। এখন স্মার্টফোনের যুগে যেকোনো গ্রামীণ যুবক ছবি তুলে লোকেশন পাঠিয়ে দিতে পারে পুলিশকে। এমনকি মাওবাদী ক্যাডাররাও ফোন ব্যবহার করে ধরা পড়ছে। ফলে গোপন সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে মাওবাদীরা কয়েক বছর ধরে মরিয়া হয়ে ‘পিস টক’ বা শান্তি আলোচনার আহ্বান জানাচ্ছে। ক্রিকেটার, চলচ্চিত্র তারকা, বুদ্ধিজীবী, এনজিও-সবাইকে কাছে টেনে সরকারকে আলোচনায় বসাতে চেয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘কোনো শান্তি আলোচনা হবে না, আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে।’ সরকারের কৌশল হলো সরাসরি যোদ্ধাদের নয়, নেতৃত্বকে টার্গেট করা। মাথা কেটে দিলে শরীর ভেঙে পড়বে।”
বাসবরাজের মৃত্যুর পর পরিস্থিতি কার্যত স্পষ্ট। তার মতো নেতৃত্ব না থাকলে পার্টি ছোট ছোট ছত্রভঙ্গ গোষ্ঠীতে টিকে থাকতে পারে বটে, কিন্তু সর্বভারতীয় গেরিলা যুদ্ধ চালানো সম্ভব নয়। ইতিহাসেও দেখা গেছে, ভারতের মাওবাদী আন্দোলনে কোনো অঞ্চল একবার ধ্বংস হলে তা পুনরুজ্জীবিত হয়নি; বরং নতুন অঞ্চলে বিস্তার ঘটেছে। সুতরাং দণ্ডকারণ্য বা ঝাড়খণ্ডে সংগঠন ভেঙে গেলে আর পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা নেই অচিরেই।
এখনো হয়তো কিছু আত্মরক্ষামূলক প্রতিরোধ চলবে, কিছু আত্মসমর্পণ বা গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু মূল সেন্ট্রাল কমিটি ও নেতৃত্ব ভেঙে পড়ায় এই যুদ্ধ ধীরে ধীরে নিভে যাবে। মাওবাদী আন্দোলন, একসময় যে আন্দোলন লাখ লাখ আদিবাসীকে সংগঠিত করেছিল, আজ তা ইতিহাসের কোণে সরে যাচ্ছে, একটি দীর্ঘ অধ্যায়ের সমাপ্তির পথে।
ভবিষ্যতের রাজনীতি
ভারতের মাওবাদী আন্দোলন যদি অস্ত্র নামিয়ে গণরাজনীতির পথে হাঁটে, তবে কী ঘটতে পারে? ভারতীয় রাজনীতির বহুমাত্রিক বাস্তবতা ও গ্রামীণ সমাজের রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে মাওবাদীদের সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে সেই সব আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যাদের সমস্যাকে তারা বছরের পর বছর তুলে ধরেছে। জমির অধিকার, বনজ সম্পদ রক্ষা, খনিজ সম্পদের লুটপাট প্রতিরোধ, পরিবেশ ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুতি-এসব ইস্যুই হয়ে উঠতে পারে তাদের সংগ্রামের অগ্রভাগ। এ বিষয়গুলো শুধু আদিবাসীদের নয়, মধ্যবিত্ত পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজকেও একত্রিত করতে পারে। এখন যেসব অঞ্চলে মাওবাদী সশস্ত্র সংগ্রামের জুজুর ভয় দেখিয়ে রাষ্ট্র সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দিতে চায়নি; এখন সেখানে ক্যামেরা নিয়ে মিডিয়া হাজির হয়ে যাবে। আর এখানেই ভয় ভারত রাষ্ট্রের। এ কারণেই তারা মাওবাদীদের অস্ত্রসমর্পণ করে গণরাজনৈতিক ধারার রাজনীতিতে আসতে দিতে চায় না। তারা চাইছে মাওবাদীদের নিশ্চিহ্ন করে লুটেরা-মাফিয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে শেষ প্রতিরোধটুকুও ভেঙে দিতে। আর এ জন্য ভারত রাষ্ট্র কার্যত দণ্ডকারণ্যে গণহত্যা চালাচ্ছে। আর এই ফ্যাসিস্ট আচরণ একই সঙ্গে তার পতনের ধ্বনিও শোনাচ্ছে। তবে তা কোন পথে হবে, কখন হবে, সেটা আমাদের অজানা।