
জীবনধারণের জন্য মানুষ সরাসরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। আমাদের খাদ্য, বস্ত্র ও ওষুধপত্রের অফুরন্ত ভান্ডার আসে
প্রকৃতি থেকেই। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য যে উপাদান, সেই অক্সিজেন আমরা বনভূমির বৃক্ষরাজি থেকেই পেয়ে থাকি।
প্রকৃতপক্ষে গাছপালা শুধু আমাদের খাদ্য ও অক্সিজেনই সরবরাহ করে না; কাগজ, রাবার, আঠা, রজন ও ট্যানিনের মতো মূল্যবান উপকরণও আসে বন থেকেই। একইভাবে পশুপাখির মাংস, দুধ, চামড়া, পালক, মধুসহ নানা প্রাণিজ সম্পদও আমরা প্রকৃতি
থেকে সংগ্রহ করি। এককথায়, মানুষের অস্তিত্ব ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীলতার কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমানে পৃথিবী যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটের সম্মুখীন, তার মূল কারণ কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বিরূপ আচরণ। নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও কৃষির আধুনিকীকরণের ফলে পরিবেশের ওপর চাপ বেড়েই চলেছে। যদিও শিল্পায়ন বা নগরায়ণের গতি থামানো বা কমানো সম্ভব নয়। তবে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকেরই একটি দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর এই দায়িত্ব হলো ‘বনায়ন’।
পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, দেশের মোট জমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। তা যদি না থাকে, তাহলে সেখানকার পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা বনবিষয়ক এক প্রতিবেদনে (দ্য স্টেট অব গ্লোবাল ফরেস্ট ২০১৮) জানায়, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের মধ্যে সাড়ে ১৩ শতাংশ জায়গাজুড়ে বনভূমি রয়েছে। তবে বাংলাদেশের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এ তথ্য মানতে রাজি নয়। তাদের দাবি, দেশের মোট আয়তনের মধ্যে ১৭ শতাংশ বনভূমি রয়েছে (বন ও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা)। বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ এবং ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট (ডব্লিউআরআই) এক প্রতিবেদনে জানায়, গত সাত বছরে বাংলাদেশে তিন লাখ ৩২ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশটিতে অধিক পরিমাণে বনভূমি থাকা যদিও কঠিন, তবুও পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে অচিরেই ব্যাপক আকারে বৃক্ষরোপণ জরুরি।
কোনো দেশের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নির্ভর করে ওই দেশের বনাঞ্চলের ওপর। পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার বহুবিধ কারণের মধ্যে বনাঞ্চল ধ্বংস অন্যতম। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৫০ থেকে ৫০০ মিটার পরিমাণ একটি বনভূমি ৩ থেকে ৫০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা কমানোর ক্ষমতা রাখে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে বনায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বনায়ন কর্মসূচি বারবার ঘোষিত হলেও বাস্তবে আমাদের বনভূমির পরিমাণ আশানুরূপভাবে সম্প্রসারিত হয়নি। উল্টো দিন দিন বনভূমি কমে যাচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় গাছপালার সংখ্যা কম হওয়ায় ঘটছে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এর ওপর যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব। সবকিছু মিলিয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
গাছ লাগানো কেন জরুরি?
গাছ লাগানোর মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল থেকে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করা যায়, যা গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমাতে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে এক ট্রিলিয়ন গাছ লাগালে বায়ুমণ্ডলের এক-চতুর্থাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করা সম্ভব।
নতুন বনাঞ্চল তৈরি বা পুরোনো বনাঞ্চলের সম্প্রসারণ অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর নতুন আবাসস্থল তৈরি করে, যা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাছের শিকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে, যা বৃষ্টিপাত এবং বন্যার ফলে মাটির ক্ষয়ে যাওয়া রোধ করে।
বনাঞ্চল মেঘ তৈরি এবং বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে, যা স্থানীয় ও আঞ্চলিক জলচক্রকে প্রভাবিত করে। নতুন গাছ লাগানোর মাধ্যমে শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বাড়ানো সম্ভব বলে কিছু গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। গাছ লাগানোর মাধ্যমে মরুকরণ প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেওয়া সম্ভব।
গাছ বাঁচানোর গুরুত্ব
পুরোনো এবং পরিণত গাছ নতুন চারা গাছের তুলনায় অনেক বেশি কার্বন শোষণ ও সঞ্চয় করতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাংকসের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পুরোনো, পরিণত গাছ তার জীবদ্দশায় নতুন চারা গাছের চেয়ে অনেক বেশি কার্বন সঞ্চয় করে। কারণ এদের বায়োমাস বেশি থাকে, এতে করে এরা দীর্ঘ সময় ধরে কার্বন শোষণ করে।
পুরোনো বনাঞ্চলগুলো একটি জটিল এবং স্থিতিশীল বাস্তুতন্ত্রের অংশ। এখানে অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকে। পরিণত বনের মাটি অনেক বেশি জৈব পদার্থসমৃদ্ধ হয় এবং এর পানি ধারণক্ষমতাও অনেক বেশি থাকে। এটি বন্যা প্রতিরোধে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বজায় রাখতে সাহায্য করে। বিশ্বের বেশির ভাগ জীববৈচিত্র্য পুরোনো এবং অক্ষত বনাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত। রেইনফরেস্ট, যেমন-অ্যামাজন, বিশ্বের অর্ধেকের বেশি প্রজাতির আবাসস্থল। এই বনগুলো ধ্বংস হলে অগণিত প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ে। বন ধ্বংসের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে।
বিশ্বের অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বনের ওপর নির্ভরশীল। বন তাদের খাদ্যের উৎস, ওষুধের ভান্ডার এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বন ধ্বংস তাদের জীবন ও সংস্কৃতিকে হুমকির মুখে ফেলে। শক্তিশালী ঝড়, বন্যা ও ভূমিধস প্রতিরোধে পুরোনো বনাঞ্চলগুলো প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনগুলো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে।
গবেষণা ও বিশ্লেষণ কী বলছে?
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বৈশ্বিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বিজ্ঞানীরা ও পরিবেশবিদরা ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৩০ শতাংশ স্থল ও সমুদ্র অঞ্চলকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন। এর মূল উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান বাস্তুতন্ত্রগুলোকে রক্ষা করা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান, যেমন-বনায়ন ও বনাঞ্চল সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
একটি বিতর্ক রয়েছে যে, নতুন গাছ লাগানো এবং পুরোনো বন রক্ষা করা এই দুটির মধ্যে কোনটি বেশি কার্যকর। একটি গবেষণা জার্নাল ঝপরবহপব অফাধহপবং-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রক্ষা-জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি থেকে অনেক বেশি সাশ্রয়ী ও দ্রুত কার্যকর।
পরিশেষে বলতে পারি, গাছ লাগানো এবং গাছ বাঁচানো এই দুটি বিষয় পরিবেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। যদি আমাদের লক্ষ্য হয় দ্রুত কার্বন শোষণ করা এবং বিদ্যমান বাস্তুতন্ত্রগুলোকে রক্ষা করা, তাহলে গাছ বাঁচানো নিঃসন্দেহে বেশি জরুরি। বন ধ্বংস হলে যে ক্ষতি হয়, তা পূরণ করতে কয়েক শতাব্দী লেগে যেতে পারে, অবশ্য যদি আদৌ তা সম্ভব হয়।
অন্যদিকে যদি আমাদের লক্ষ্য হয় অবক্ষয়িত ভূমি পুনরুদ্ধার করা, মরুকরণ রোধ করা, শহরাঞ্চলে তাপমাত্রা কমানো বা নতুন বনাঞ্চল তৈরি করা, তাহলে গাছ লাগানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেসব এলাকায় বন ধ্বংস হয়ে গেছে বা যেখানে বন ছিল না, সেখানে নতুন গাছ লাগানো অপরিহার্য। আসলে এই দুটি বিষয়কে আলাদা করে দেখার বা বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। দুটি বিষয়কে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে দেখা উচিত।