
“জীবনে প্রথম সিনেমা দেখতে গেলাম ফেনীর দুলাল সিনেমা হলে। মনে আছে, সিরাজউদ্দৌলা চলছিল তখন। প্রচণ্ড ভিড়, ব্ল্যাকারের উৎপাত, তবুও লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে কোনো রকমে ‘মর্নিং শো’তে ঢুকতে পারলাম। বেশ ভালোই লাগছিল। বিপত্তি বাধল সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে মীর জাফরের বেঈমানির দৃশ্যে। একদল দর্শক উত্তেজিত হয়ে মীর জাফরকে নিশানা করে সিনেমার পর্দায় ‘জুতা’ ছুড়তে শুরু করল। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমিও পা থেকে খুলে একপাটি জুতা পর্দায় ছুড়ে মারলাম। জুতা ছোড়াকে কেন্দ্র করেই হঠাৎ তুমুল মারামারি শুরু হলো। তড়িঘড়ি হল থেকে বেরিয়ে গেলাম। জুতাটাও হারালাম। সেদিন খালি পায়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল।” প্রথম সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন ফেনীর বাসিন্দা কাজী জামাল উদ্দিন। ফেনী শহরের স্টেশন রোডে অবস্থিত ‘দুলাল সিনেমা হল’ ২০২৩ সালে ভেঙে ফেলা হয়। এটি ছিল জেলার সর্বশেষ সিনেমা হল। এর আগে একে একে বন্ধ হয়ে যায় ‘সুরত, কানন, বিলাসীসহ’ জেলার পাঁচটি সিনেমা হল।
সিনেমা দেখা নিয়ে জামাল উদ্দিনের মতো এমন অসংখ্য গল্প ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে। একসময় দেশের প্রতিটি জেলা শহর এবং ক্ষেত্রবিশেষে উপজেলা সদরেও সিনেমা হলের দেখা মিলত। স্থানীয়দের বিনোদনের স্বাদ মেটাত এই সিনেমা হলগুলো। কালের পরিক্রমায় প্রযুক্তির বিকাশের ফলে এবং মানসম্মত সিনেমার অভাবে দর্শক হারাতে থাকলে লোকসানের দরুন ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে দেশের সিনেমা হলগুলো। গত শতকের শেষ দিকেও দেশে এক হাজার ৩০০-এর অধিক সিনেমা হল ছিল। এ শতাব্দীতে এসে কমতে কমতে সেই সংখ্যা বর্তমানে ৭০ থেকে ৭৫-এ ঠেকেছে।
সিনেমা হলের দুরবস্থা কাটাতে হল মালিকদের আর্থিক সহায়তা করার লক্ষ্যে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন সরকার একটি তহবিল ঘোষণা করে। যার পরিমাণ ছিল এক হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই তহবিল গঠনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। যেখানে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা জানানো হয়, পাঁচ কোটি টাকা। একই বছরে ৯ ডিসেম্বর জারি করা আরেকটি প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সীমা বাড়িয়ে ১০ কোটি টাকা ঘোষণা করে। ৯ ডিসেম্বর জারি করা সেই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘নতুন সিনেমা হল নির্মাণ এবং বিদ্যমান সিনেমা হল সংস্কার ও আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে অত্র স্কিমের আওতায় সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা ঋণসুবিধা পাওয়া যাবে।’
সিনেমা হলের নবজাগরণ আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই উদ্যোগ-হল মালিকদের অনীহার কারণে থমকে যায়। হল মালিকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, দেশে মানসম্পন্ন কোনো সিনেমা তৈরি না হওয়ায় দর্শক সিনেমা দেখতে হলে আসে না। এমন পরিস্থিতিতে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করাও সম্ভব হবে না।
বর্তমানে দেশের ২৯টি জেলায় কোনো সিনেমা হল নেই। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই যশোরের মণিহার, বগুড়ার মধুবন ও কেরানীগঞ্জের লায়ন-সম্প্রতি এই তিন মালিক পক্ষ হল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। ক্রমাগত লোকসান সামলাতে না পেরে হলগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিকপক্ষ। এ বছর আরো কয়েকটি হল বন্ধের ঘোষণা আসতে পারে। দেশের সবচেয়ে বড় মাল্টিপ্লেক্স চেইন ‘স্টার সিনেপ্লেক্স’। ঈদের পর হলটিতে চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে পাঁচটি বাংলা ছবি। কোনো ছবিই দর্শক টানতে পারেনি।
এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় সিনেমা আমদানির মাধ্যমে হলগুলোতে দর্শক ফেরানো সম্ভব বলে মনে করছেন হল মালিকরা। তাদের ভাষ্য, ‘একটি শেষ চেষ্টা হিসেবে ভারতীয় সিনেমা বাংলাদেশের হলগুলোতে চালানোর সুযোগ দেওয়া দরকার। এর পরও যদি হলে দর্শক না ফেরে তবে হল বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।’
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে স্বাক্ষরিত সার্কভুক্ত দেশগুলোর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা সাফটা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা আমদানি করা হয়। সেই নীতিমালা অনুযায়ী সার্কভুক্ত কোনো দেশ একটি সিনেমা রপ্তানি করলে আরেকটি সিনেমা আমদানি করতে হয়। এ চুক্তির পরও নানা মাত্রিক জটিলতায় দেশে ভারতীয় সিনেমাসহ বিদেশি সিনেমা আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ২০২৩ সালে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচটি শর্তে দেশের সিনেমা হলগুলোতে উপমহাদেশীয় ভাষার সিনেমা মুক্তির অনুমতি দিয়েছিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। একই বছরের মে মাসে শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ সিনেমা দিয়ে দেশের সিনেমা হলগুলোতে বিদেশি ভাষার সিনেমা প্রদর্শনের যাত্রা শুরু হয়। এরপর একে একে প্রদর্শিত হয় ১০টি বিদেশি সিনেমা, যার মধ্যে একটি নেপালি সিনেমা ছাড়া বাকিগুলো ছিল ভারতীয়। তবে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের প্রভাব পড়ে সিনেমা আদান-প্রদানেও। গত এক বছরে মাত্র একটি ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শিত হয়েছে দেশের সিনেমা হলে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের অক্টোবরে ভারত থেকে আমদানি করা হয়-শ্রদ্ধা কাপুর ও রাজকুমার রাও অভিনীত ‘স্ত্রী-২’ সিনেমাটি। এর বিপরীতে বাংলাদেশের ‘প্রহেলিকা’ সিনেমাটি ভারতে যায়। এরপর এখন পর্যন্ত আর কোনো ভারতীয় সিনেমা আমদানি সম্ভব হয়নি।
প্রশ্ন উঠছে, এভাবে ধুঁকে ধুঁকে আর কত দিন চলবে সিনেমা হল, মালিকরাই বা কত দিন লোকসানের ভার বইবেন? রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ হাতে না নিলে অচিরেই সিনেমা হলের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে বইয়ের পাতায় শুধুই ‘ইতিহাস’ হয়ে থাকবে।