
একই সকালে দুটি পৃথিবী জেগে ওঠে-একটি ঘরের ভেতর, আরেকটি অফিসের পথে। দুটিই সামলান একজন নারী। যিনি কখনো ঘড়ির কাঁটায় সময় মাপেন, কখনো সন্তানের ক্লাসের সময় ধরেন, কখনো অফিসের প্রেজেন্টেশনের ডেডলাইন পূরণ করেন। এই দ্বৈত ভূমিকার নাম-কর্মজীবী নারী। কিন্তু সমাজ কি সত্যিই প্রস্তুত তাদের এই দুই দিককে সমানভাবে মূল্য দিতে?
দায়িত্ব না সম্মান?
বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা গত এক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের তথ্য মতে, শহরাঞ্চলে কর্মজীবী নারীর হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। এই সংখ্যা শুনতে আশাব্যঞ্জক, কিন্তু গল্পটা এর চেয়ে অনেক জটিল। অধিকাংশ কর্মজীবী নারী এখনো ‘দুই পাল্লার ভারসাম্য’ সামলান-একদিকে ঘর, অন্যদিকে চাকরি। সকাল থেকে রাত অবধি রান্না, সন্তান, অফিস, মিটিং-সব মিলিয়ে তারা যেন অবিরাম এক ম্যারাথনে দৌড়াচ্ছেন। তবুও সমাজের চোখে ‘নারী’ মানেই ‘পরিবারের দায়িত্ব’-এ ধারণা বদলায়নি খুব একটা। পুরুষ যদি অফিস শেষে বিশ্রাম নেয়, সেটা স্বাভাবিক; কিন্তু নারী যদি ক্লান্ত হন, তাহলে প্রশ্ন ওঠে-‘তুমি এত ব্যস্ত কেন?’ এই মানসিকতাই প্রমাণ করে, কর্মজীবী নারী আজও সমাজের অনুচ্চারিত বিচারসভায় প্রশ্নবিদ্ধ।
তুলনার ফাঁদ
একজন নারী যদি ঘরে থাকেন, তাকে বলা হয় ‘গৃহিণী’; যদি বাইরে কাজ করেন, তাকে বলে ‘কর্মজীবী নারী’। অথচ দুই ক্ষেত্রেই পরিশ্রম, দায়িত্ব আর মানসিক চাপ সমান। কিন্তু সমাজ প্রায়ই এই দুই ভূমিকাকে তুলনায় ফেলে দেয়-যেন একটিকে সম্মান দিলে অন্যটি কমে যায়। বাস্তবে একজন নারী ঘরে থাকুন বা বাইরে কাজ করুন, দুজনেই সামাজিক কাঠামোর অপরিহার্য অংশ। কিন্তু কর্মজীবী নারীকে এখনো স্বামী-সন্তানের প্রতি অবহেলা করে কর্মজীবন বেছে নেওয়া নারী হিসেবে দেখা হয়, যা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির গভীর পক্ষপাতের প্রতিফলন।
কর্মক্ষেত্রের বাস্তবতা
নারীর কর্মজীবনে প্রবেশ শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নয়, আত্মপরিচয়েরও এক নতুন সংজ্ঞা। কিন্তু সেই পথে বাধা কম নয়। বাংলাদেশে নারীরা এখন ব্যাংক, আইটি, মিডিয়া, প্রশাসন এমনকি সামরিক বাহিনীতেও কাজ করছেন। কিন্তু সুযোগের পাশাপাশি রয়েছে বৈষম্য। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় পুরুষ ও নারীর বেতনের পার্থক্য এখনো ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। একই পদে, একই কাজের পরও নারীরা কম বেতন পান-এটাই বাস্তবতা।
লিঙ্গবৈষম্য-চোখে দেখা না গেলেও থেকে যায়
অফিসে পদোন্নতির সময় অনেক নারীকেই শুনতে হয়, ‘তুমি তো বাচ্চা সামলাও, সময় দিতে পারবে?’-এই প্রশ্নটা যতটা সাধারণ, ততটাই অন্যায্য। কর্মক্ষেত্রে এমন ‘অদৃশ্য বৈষম্য’ এখনো বিদ্যমান। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে অনেক নারী সন্তান জন্মের পর চাকরি ধরে রাখতে পারেন না, কারণ মাতৃত্বকালীন ছুটি বা নমনীয় কাজের সময়সীমা এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানে যথাযথভাবে কার্যকর নয়।
মাতৃত্বকালীন ছুটি ও নীতিগত কাঠামো
বাংলাদেশের শ্রম আইনে নারীদের জন্য ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি নির্ধারিত আছে। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানে এই আইন মানা হয় না। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে, অনেক নারী গর্ভধারণের খবর দিলে পরোক্ষভাবে চাপের মুখে পড়েন। এই প্রেক্ষাপটে কর্মক্ষেত্রে নারী-সহায়ক নীতির প্রয়োজন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। নিরাপদ অফিস পরিবেশ, হয়রানি প্রতিরোধ নীতি, ডে-কেয়ার সুবিধা ও নমনীয় সময়-এগুলো শুধু ‘অতিরিক্ত সুবিধা’ নয়, বরং নারী কর্মীদের মৌলিক অধিকার।
সমাজের পরিবর্তিত মানসিকতা
তবে সব অন্ধকারের মাঝেও আশার আলো জ্বলছে। শহুরে পরিবারগুলোতে এখন অনেক পুরুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহকর্ম ভাগ করে নিচ্ছেন, সন্তান পালনে অংশ নিচ্ছেন। ধীরে ধীরে হলেও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে। কর্মজীবী নারী এখন শুধুই পরিবারের উপার্জনকারী নন, তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশ, সমাজের পরিবর্তনের চালিকাশক্তি।
দুই জগতের ভারসাম্য
কর্মজীবী নারীর গল্প আসলে শুধু তার নয়-এটা একটি সমাজের বিবর্তনের গল্প। যে সমাজ নারীকে কেবল ‘সহায়ক’ নয়, বরং ‘সহযাত্রী’ হিসেবে দেখতে শিখছে। নারীর কর্মজীবন কখনো পরিবারের বিপরীতে নয়, বরং সেটাই হতে পারে পরিবারের প্রকৃত শক্তি। কিন্তু এর জন্য দরকার সমান দৃষ্টিভঙ্গি, সমান সুযোগ এবং সম্মানের বাস্তব প্রয়োগ।