
প্রতীকী ছবি
কখনো কি ভেবেছেন, শিশুর চোখে মা-বাবা মানে কী? শুধুই শাসন আর নির্দেশনা দেওয়া একজোড়া মানুষ? নাকি একজন বন্ধু, যে বুঝতে চায়, মনোযোগ দেয়। ঠিক এই জায়গাতেই এসে দাঁড়িয়েছে আধুনিক অভিভাবকত্বের নতুন ধারা। যাকে বলা হচ্ছে ‘জেন্টল প্যারেন্টিং’।
জেন্টল প্যারেন্টিং কী? : এটি কোনো নির্দিষ্ট নিয়মের চাবিকাঠি নয়, এটি মূলত একটি দৃষ্টিভঙ্গি। এই অভিভাবকত্ব পদ্ধতি শিশুদের প্রতি সহনশীলতা, সহানুভূতি ও সম্মানের ওপর গুরুত্ব দেয়। এ ধারায় তাদের বিশ্বাস করা হয়, শিশুদের সঙ্গে কঠোরতা বা শাস্তির মাধ্যমে নয়, বরং তাদের আবেগ ও অনুভূতিকে সম্মান জানিয়ে এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব।
মূলনীতি : অনেকে জেন্টল প্যারেন্টিংকে ভুল বোঝেন, ভাবেন এতে হয়তো শাসনের জায়গা নেই। আসলে বিষয়টি উল্টো। এখানে শৃঙ্খলা আছে, কিন্তু সেটি আসছে সম্পর্কের ভেতর ভয়ের বদলে ভালোবাসা থেকে। শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘শিশু যখন নিরাপদ ও সম্মানিত বোধ করে, তখন সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। জেন্টল প্যারেন্টিং শিশুদের আত্মসম্মান তৈরি করে, দায়িত্বশীল করে।’ বাচ্চা যখন খেলনা ছুড়ে মারে, তখন শুধু বললেই হয় না ‘এটা খারাপ কাজ’। তার বদলে তাকে বোঝানো দরকার, এটা করলে অন্য কেউ ব্যথা পেতে পারে। তাতে বাচ্চা শুধু নিয়ম নয়, সেই নিয়মের কারণও বুঝতে শেখে।
সহানুভূতি ও সম্মান : জেন্টল প্যারেন্টিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সহানুভূতি। এর মানে আপনি সন্তানের অনুভূতি ও দৃষ্টিকোণকে বোঝার চেষ্টা করবেন। এটি তাদের প্রতি সম্মান দেখানো এবং মানসিক চাহিদা পূরণে সাহায্য করে। যদি কোনো শিশু খেলনা ভেঙে কাঁদে, তাহলে তাকে বকা না দিয়ে বরং তার দুঃখকে স্বীকৃতি দেওয়া।
সীমা নির্ধারণ : জেন্টল প্যারেন্টিং মানে এই নয় যে কোনো নিয়ম থাকবে না। বরং এখানে নিয়মগুলো কঠোর শাস্তি ছাড়াই, শান্তভাবে ও যুক্তি দিয়ে বোঝানো হয়। সন্তানের জন্য সুস্পষ্ট সীমা নির্ধারণ করে এর গুরুত্বও তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে।
স্বাধীনতার সুযোগ : এই পদ্ধতি শিশুকে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে এবং ভুল থেকে শিখতে উৎসাহিত করে। এর মাধ্যমে শিশুর নিজের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তৈরি হয়।
যোগাযোগ : জেন্টল প্যারেন্টিংয়ে শিশুদের সঙ্গে খোলামেলা যোগাযোগ স্থাপন করা জরুরি। এতে শিশুরা তাদের মনের কথা সহজেই প্রকাশ করতে পারে এবং মা-বাবাও চাহিদা ভালোভাবে বুঝতে পারেন।
সুবিধা : জেন্টল প্যারেন্টিংয়ের লক্ষ্য হলো শিশুদের এমনভাবে বড় করে তোলা, যাতে তারা আত্মবিশ্বাসী, সহানুভূতিশীল ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যার জন্য ধৈর্য ও বোঝাপড়া উভয়ই প্রয়োজন। এই পদ্ধতিতে বড় হওয়া শিশুরা তাদের
মা-বাবার সঙ্গে একটি শক্তিশালী এবং বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক তৈরি করে। শিশুরা নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে এবং নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে উৎসাহিত হয়, যা তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এটি শিশুদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং নিজেদের অনুভূতিকে ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে। জেন্টল প্যারেন্টিংয়ের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুরা সম্পর্ক গড়ায় বেশি পারদর্শী হয় এবং মানসিকভাবে তারা বেশ স্থিতিশীল হয়।
মনে রাখতে হবে জেন্টল প্যারেন্টিং আদর্শ মা-বাবা হওয়ার রেস নয়। বরং এই পথচলা প্রতিদিন একটু একটু করে শেখার ও শেখানোর। জেন্টল প্যারেন্টিং শুরু হয় আত্মপর্যালোচনা থেকে। অভিভাবককে আগে নিজের আবেগ চিনতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হয়। কারণ শিশুর সবচেয়ে বড় শিক্ষক তার সামনে দেখা অভিজ্ঞতা। শিশুকে মানুষ করার আগে নিজেদের একটু ‘মানুষ’ হতে হয়। বুঝতে হয় সহানুভূতি, কথোপকথন ও সময়ের ভাষা। আর তাতেই গড়ে ওঠে এমন একটি সম্পর্ক, যেখানে আদেশের বদলে থাকে স্নেহময় অনুরোধ, আর শাসনের বদলে থাকে সাহচর্য।