
আফ্রিকার চে গুয়েভারা খ্যাত টমাস শংকরা
একসময় পৃথিবীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দখলদারির এতটাই বিস্তৃতি ছিল যে, বলা হতো ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনোই অস্ত যায় না’। বিষয়টি এমন, ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে যখন সূর্য অস্ত যেত, আরেক উপনিবেশ আমেরিকায় হতো সূর্যোদয়। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশরা বাকিদের ছাপিয়ে গিয়েছিল এটা ঠিক। তবে ফরাসিরাও খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। আফ্রিকায় ফ্রান্সের উপনিবেশ এতটাই বেশি ছিল যে মহাদেশটির পশ্চিম অংশের নামই হয়ে যায় ‘ফ্রেঞ্চ ওয়েস্ট আফ্রিকা’।
এমনই এক দেশ পশ্চিম আফ্রিকার ‘রিপাবলিক অব আপার ভোল্টা’। দেশটি দখল করার পর নামটি ফরাসিরাই দেয়। ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট আপার ভোল্টা ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। যদিও এই স্বাধীনতা ছিল শুধুই কাগজে-কলমে। সরকার, অর্থনীতি ও সামরিক বাহিনীতে ফ্রান্সের ব্যাপক প্রভাব ছিল। স্বাধীনতার পরও দেশটিতে অস্থিরতা চলতে থাকে। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি আরো নড়বড়ে হতে থাকে। ১৯৬৬ সালে লে. কর্নেল সাঙ্গোলি লামিজানা এক সেনা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মরিস ইয়ামোগোর নির্বাচিত সরকাকে উৎখাত করে নিজেই ক্ষমতায় বসেন এবং ১৯৮০-এর নভেম্বর পর্যন্ত একটানা দেশ শাসন করেন।
শংকরা ক্ষমতায় এসেই প্রথমে দেশের নাম পরিবর্তন করেন
সাঙ্গোলি লামিজানার বিরুদ্ধে জনরোষ ক্রমে তীব্র আকার ধারণ করতে থাকলে সে সুযোগে আরেক সেনা অফিসার কর্নেল সায়ে জেবোর আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসেন। অবশ্য সায়ে জেবোর শাসনকাল তেমন দীর্ঘ হয়নি। ১৯৮২ সালের নভেম্বরে নন-কমিশন্ড সেনা অফিসারদের অভ্যুত্থানে মেজর জিন-ব্যাপটিস্ট ওয়েডেরোগো ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু ১৯৮৩ সালে আরো একটি সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। এবার ক্ষমতায় বসেন ত্রিশোর্ধ্ব যুবক সেনা অফিসার টমাস শংকরা। শংকরা ক্ষমতায় এসেই প্রথমে দেশের নাম পরিবর্তন করেন। ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির দেওয়া ‘রিপাবলিক অব আপার ভোল্টা’ নাম বদলে দেশীয় ভাষায় ‘বুরকিনা ফাঁসো’ রাখেন। বাংলায় এ নামের অর্থ ‘ন্যায়পরায়ণতায় অটল মানুষের দেশ।’
‘নিজস্ব সামর্থ্যরে পূর্ণ ব্যবহার ও বিদেশি সাহায্য বর্জন, বিদেশি উন্নয়ন মডেল বর্জন, নারী উন্নয়ন ও তাদের উন্নয়নের অংশীদার করা এবং সব শ্রেণির মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ’-শংকরা এই চারটি মূলনীতি গ্রহণ করেন এবং এগুলোকে সামনে রেখে কাজ করতে থাকেন। কোনো বিদেশি শক্তির সাহায্য ছাড়া দেশকে এগিয়ে নিতেই শংকরা এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তা ছাড়া ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির রেখে যাওয়া শাসনকাঠামো ভেঙে ফেলাও ছিল তার লক্ষ্য। শংকরার ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৭ সাল-এই স্বল্প সময়ের শাসনকালে বুরকিনা ফাঁসো কোনো বিদেশি সাহায্য গ্রহণ করেনি। এমনকি বিশ্বব্যাংকের সাহায্যও শংকরা গ্রহণ করেননি।
শংকরা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে কৃষির উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগী হন। স্থানীয় সামন্তদের থেকে জমি নিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের মধ্যে তা বণ্টন করে দেন। তার দায়িত্ব গ্রহণের আগে যেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে এক হাজার ৭০০ কেজি গম উৎপন্ন হতো, তিন বছর পর তা তিন হাজার ৮০০ কেজিতে ঠেকে। অর্থাৎ মাত্র তিন বছরের মধ্যেই খাদ্য উৎপাদন ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। পানির অভাব কাটিয়ে উঠতে শংকরা দেশব্যাপী ২৫০টি খাল ও ৩০০টির মতো কূপ খনন করেন। শিক্ষার হার ১৩ শতাংশ থেকে ৭৮ শতাংশ এ উন্নীত করেন। এ ছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি পুনরায় চালু করেন শংকরা। শিশুদের হাম, পীতজ্বর ও মস্তিষ্কের প্রদাহ প্রতিরোধে ১৯৮৪ সালে শংকরা প্রথমবারের মতো টিকাদান কর্মসূচি হাতে নেন। ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা মাত্র ১৫ দিনের এই কর্মসূচিতে প্রায় ২৫ লাখ শিশুকে টিকা দান সম্ভব হয়। শংকরার সব সংস্কার উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘আফ্রিকান-স্বরাজ’। নারীর অধিকার প্রশ্নে শংকরা বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। নারীবিরোধী সব সামাজিক প্রথা বন্ধ করার পাশাপাশি নারীদের সরকারি উচ্চ পদে আসীন করতেও তৎপর ছিলেন তিনি। পাঁচজন নারী শংকরার মন্ত্রিসভা আলোকিত করেছিলেন।
শংকরাকে পদক পরিয়ে দিচ্ছেন ফিদেল কাস্ত্রো
রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমাতে শংকরা সরকারি কাজে ব্যবহৃত সব মার্সিডিজ গাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ‘রেনল্ট-৫’ মডেলের গাড়ি ব্যবহার করতে অনুমোদন দেন। ‘রেনল্ট-৫’ ছিল সে সময় দেশটির সবচেয়ে কম দামি গাড়ি। শংকরা নিজের এবং সব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন হ্রাস করেন। ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার ও প্রথম শ্রেণির এয়ার টিকিট সুবিধাও তুলে নেন তিনি। সরকারি চাকরিজীবীদের সারা বছরের বেতন থেকে এক মাসের বেতন জন-উন্নয়নমূলক প্রকল্পে দান করতে বাধ্য করেন। শংকরা নিজ অফিসে এসি ব্যবহার করতেন না। এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘গরিব দেশের একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসি ব্যবহার করার মতো বিলাসিতা দেখানোর সুযোগ আমার নেই।’ সরকারি দপ্তরগুলোতে তার ছবি ঝোলানোর ঘোরবিরোধী ছিলেন শংকরা। এ বিষয়ে কেউ প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন, ‘এখানে ৭০ লাখ টমাস শংকরা আছে।’
চে গুয়েভারার সঙ্গে হাস্যজ্বল শংকরা
শংকরার রাষ্ট্র পরিচালনা এবং চিন্তাধারা তাকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী--সমাজতান্ত্রিক দেশ ও রাজনৈতিক কর্মীদের মাঝে ‘আফ্রিকার চে গুয়েভারা’ খ্যাতি এনে দেয়। মৃত্যুর ছয় দিন আগে ১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর চে গুয়েভারার ২০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শংকরা তার স্বরাজ চিন্তা নিয়ে একটা বক্তৃতাও দেন। কিউবা ও ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে শংকরার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৯৮৪ সালে শঙ্করকে কিউবার সর্বোচ্চ পদকে সম্মানিতও করা হয়।
১৯৮৭ সালের ১৫ অক্টোবর ‘জাতীয় বিপ্লবী কাউন্সিলের’ এক বৈঠকে ১২ জন সহযোগীসহ শংকরাকে হত্যা করা হয়। শংকরাকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন তারই প্রধান সহযোগী ব্লেইসে কম্পাওরই। খুনের দিনই ব্লেইসে কম্পাওরই ক্ষমতায় বসেন। যদিও শংকরার হত্যাকাণ্ডে ব্লেইসে কম্পাওরই যুক্ত ছিলেন, কিন্তু এর পেছনে ফ্রান্সের হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংঘটিত বাম আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে শহীদ ও তাদের সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু বছর ধরে গবেষণাধর্মী কাজ করে আসছেন ভারতীয় সাংবাদিক ও সমাজকর্মী অর্ক ভাদুড়ি। টমাস শংকরার বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকালকে অর্ক ভাদুড়ি বলেন, ‘বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানুষের চিরন্তন অনুপ্রেরণার একটি নাম শহীদ কমরেড টমাস শংকরা। আফ্রিকার জনগণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে যুগে যুগে তিনি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে অবস্থান করবেন। শংকরাকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দ্বারা নিয়োজিত ঘাতকরা হত্যা করেছে ঠিকই, কিন্তু তার রাজনীতি, আদর্শকে তারা খুন করতে পারেনি। মার্কসবাদী বিপ্লবী শংকরার উত্তরসূরি হিসেবে ইব্রাহিম ত্রাওরে উঠে এসেছেন। তার আপসহীন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা গোটা আফ্রিকাকে অনুপ্রাণিত করছে। যে মানুষ প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে মিছিলে হাঁটেন, তার হাতে থাকে শহীদ কমরেড টমাস শংকরার ছবি। বিশ্বের যেখানেই সাম্রাজ্যবাদের শিকলে আঘাত করে মুক্তিকামী জনতা, সেখানেই মুক্তির মশাল হিসেবে উপস্থিত থাকে শংকরার বিপ্লবী স্মৃতি ।’