
হাজারো বছর আগে, যখন গিজার পিরামিড কেবল আকাশছোঁয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, মানবসভ্যতা তখনো শৈশবকাল পেরোচ্ছে মাত্র। সেই সময়েই আমেরিকার নির্জন, শুষ্ক পাহাড়ি ঢালে জন্ম নিয়েছিল এক ক্ষুদ্র চারাগাছ। আজ সে আর চারাগাছ নয়, দাঁড়িয়ে আছে প্রলয়ংকরী বাতাস, তুষারঝড় আর হাজারো ঋতুচক্র পেরিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার বছরের জীবন্ত ইতিহাস বুকে নিয়ে।
তার নাম ব্রিস্টলকোন পাইন। অনেকের চোখে এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ জীবন্ত বৃক্ষ। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসও একে সবচেয়ে বয়স্ক বৃক্ষের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির এই অমর যোদ্ধার সিংহাসনে এখন হঠাৎই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার আরেক কিংবদন্তি প্যাটাগোনিয়ান সাইপ্রেস বা স্থানীয়দের কাছে আদরের নাম ‘আলার্সে’।
চিরন্তন নিঃসঙ্গতা : ব্রিস্টলকোনের বেঁচে থাকার রহস্য
নেভাদার গ্রেট বেসিন ন্যাশনাল পার্ক কিংবা ক্যালিফোর্নিয়ার হোয়াইট মাউন্টেন ১১ হাজার ফুট উচ্চতার পাথুরে ঢালে, যেখানে অন্য কোনো উদ্ভিদ দাঁড়াতে পারে না, সেখানেই ব্রিস্টলকোন পাইন মাথা উঁচু করে আছে। এ যেন প্রকৃতির সঙ্গে এক অনন্ত পরীক্ষার ফলাফল। এখানে নেই ঘন বন, নেই প্রতিযোগী উদ্ভিদ, নেই ছত্রাক বা কীটপতঙ্গের হামলা। মানুষও খুব কমই পৌঁছায় এই দুর্গম প্রান্তরে। আর সেই কারণেই গাছগুলো বেঁচে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী, নিজের মতো করে, নির্জনে।
তাদের বেঁচে থাকার কৌশলও প্রায় অলৌকিক। প্রতি বছর অতি সামান্য করে মোটা হয় তারা। কাঠ ঘন হওয়ার কারণে কোনো পোকামাকড় বা রোগজীবাণু ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। আরো বিস্ময়কর হলো তাদের ‘স্ট্রিপ বার্কিং’ কৌশল। ধরুন, গাছের গুঁড়ির ৯৫ শতাংশ অংশ মৃত হয়ে গেছে, তবুও বাকি সামান্য জীবন্ত টিস্যু মূল থেকে ডাল পর্যন্ত জল টেনে নিয়ে যায়। ফলে গাছটি সব ঝড়-ঝাপটা সামলে সহস্রাব্দ ধরে টিকে থাকতে পারে। এই অসম্ভব ধৈর্যই তাদের করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘজীবী বৃক্ষ।
সবচেয়ে বিখ্যাত ব্রিস্টলকোনের নাম ‘মেথুসেলা’। ক্যালিফোর্নিয়ার হোয়াইট মাউন্টেনে নিঃশব্দ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা এই গাছটির বয়স প্রায় চার হাজার ৮৫০ বছর। ভাবুন তো যখন ব্যাবিলনীয় সভ্যতা মাত্র ফুলেফেঁপে উঠছে, মিশরে ফেরাউনদের রাজত্ব, তখনই মেথুসেলা আকাশের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। আজও সে দাঁড়িয়ে আছে, শরীরের অধিকাংশ মৃত কাঠ হয়ে গেলেও এক সরু জীবন্ত শিরা এখনো বুকের ভেতর দিয়ে জীবনরস বইয়ে রাখছে। মেথুসেলা শুধু একটি গাছ নয়, যেন সময়ের এক নীরব সাক্ষী।
দক্ষিণের চ্যালেঞ্জার : প্যাটাগোনিয়ার প্রাচীন সাইপ্রেস
চিলির দক্ষিণে প্যাটাগোনিয়ার আর্দ্র রেইনফরেস্ট। সেখানে এক বিশাল বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। কাণ্ড এতটাই মোটা যে কয়েকজন মানুষ হাত ধরাধরি করে ঘিরলেও তা শেষ হয় না। এর গায়ে শ্যাওলা, ছত্রাক, আর শত শত বছরের ধুলোবালি জমে আছে। এটিই সেই গাছ, যাকে ঘিরে বিজ্ঞানজগতে নেমেছে প্রবল কৌতূহল।
চিলির বিজ্ঞানী জনাথন বারিচিভিচ যখন আলার্সে ন্যাশনাল পার্কে এই সাইপ্রেসের কাণ্ডে যন্ত্র বসান, তখনই বোঝা গেল এটি সাধারণ কোনো বৃক্ষ নয়। যন্ত্র দিয়ে ‘কোর স্যাম্পল’ সংগ্রহ করার চেষ্টা করলেন তিনি, যা সাধারণত গাছের বয়স নির্ণয়ে ব্যবহার হয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো, এই গাছের ব্যাস এতটাই অস্বাভাবিক মোটা যে যন্ত্রের সূচ কেন্দ্রে পৌঁছালই না। যেন গাছটি নিজেকে আড়াল করে রেখেছে মানবজিজ্ঞাসার চোখ থেকে।
তবুও বিজ্ঞান থেমে থাকেনি। আংশিক তথ্যকে মডেলিংয়ের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে গবেষকরা অনুমান করেন, গাছটির বয়স সম্ভবত পাঁচ হাজার ৪০০ বছর! মানে এটি মেথুসেলাহকেও (চার হাজার ৮০০ বছর বয়সী ব্রিস্টলকোন পাইন) ছাড়িয়ে যেতে পারে। ভাবুন তো এই বৃক্ষ তখনো জন্মায়নি, যখন পিরামিড নির্মাণ শেষ হয়েছে; তখনো এর পাতায় ঝরে পড়েনি কোনো রোমান সৈন্যের ছায়া।
তবে এই গাছের বয়স নিয়ে সন্দেহবাদীদের সংখ্যা কম নয়। মার্কিন গবেষক পিটার ব্রাউন সতর্ক করে বলেন, ‘এত বড় দাবি করার আগে প্রমাণ আরো শক্ত হতে হবে।’ যদিও তিনি স্বীকার করেন, যা-ই হোক না কেন, এই সাইপ্রেস কমপক্ষে দুই হাজার ৪০০ বছরের পুরোনো। আর সেটাই তো মানবসভ্যতার তুলনায় অবিশ্বাস্য আয়ু।
মৃত্যু নয়, হত্যাই শেষ করে গাছকে
বিজ্ঞানীরা বলেন, গাছ প্রাণীর মতো বার্ধক্যে মরে না। তাদের মৃত্যু ঘটে বাইরের আঘাতে আগুনের তাণ্ডব, পোকামাকড়ের আক্রমণ, ছত্রাকের রোগ বা মানুষের কুঠারের আঘাতে। তাই টিকে থাকার রহস্যটা আসলে পরিবেশে।
ব্রিস্টলকোন পাইন বেঁচে গেছে নির্জন, শুষ্ক, পাথুরে পাহাড়ে; যেখানে জীবনের জন্য হুমকি কম। অন্যদিকে চিলির এই সাইপ্রেস দাঁড়িয়ে আছে একেবারে ভিন্ন পরিবেশে : স্যাঁতসেঁতে রেইনফরেস্ট, চারদিকে শ্যাওলা, কুয়াশা আর বৃষ্টি। এখানে বিপদেরও শেষ নেই, ভেজা কাঠ পচে যেতে পারে, রোগ ছড়াতে পারে, আগুন লেগে যেতে পারে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে কিংবা প্রকৃতির বিশেষ আশ্রয়ে, এই সাইপ্রেস দাঁড়িয়ে আছে সহস্রাব্দ ধরে। যেন পৃথিবী তাকে আলাদা করে রেখেছে এক প্রাচীন রক্ষক, যার গায়ে ইতিহাসের দাগ খোদাই করা।
জলবায়ুর হুমকি : বেঁচে থাকবে তো?
প্রশ্নটা খুব সাধারণ, এই গাছগুলো কি আগামী শতাব্দীও টিকে থাকবে? কিন্তু উত্তরটা ভয়ংকর জটিল।
ব্রিস্টলকোন পাইন একসময় ছিল প্রায় অজেয়। তাদের নির্জন পাহাড়ি অবস্থান যেন স্বাভাবিক সুরক্ষা বলয় তৈরি করেছিল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের আগুন সেই দুর্গকেও ভেঙে ফেলছে। আগুন আজ আর ছোটখাটো ঝোপ পোড়ানো নয়, বরং পরিণত হচ্ছে দাউ দাউ করা দাবানলে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাহাড় পুড়ে ছাই। এরই মধ্যে বেশ কিছু শতাব্দী প্রাচীন ব্রিস্টলকোন এই আগুনে হারিয়ে গেছে। উপরন্তু ব্লিস্টার রস্ট নামের এক ছত্রাক ছড়ালে এই অমরপ্রায় গাছগুলোও ঝুঁকিতে পড়বে।
চিলির আলার্সে সাইপ্রেসের অবস্থাও স্বস্তিদায়ক নয়। তার চারপাশ এখন পর্যটকে ভরা, মানুষ ভিড় করে আসে ছবি তুলতে, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে, গাছের পায়ের নিচের মাটি ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। শিকড় দুর্বল হয়ে পড়ে। আরেকটি বড় বিপদ হলো জলবায়ুর পরিবর্তন, যে রেইনফরেস্টে এ গাছ টিকে আছে, সেটিই ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। প্যাটাগোনিয়ার বৃষ্টিনির্ভর বন শুকিয়ে গেলে এই মহাবৃক্ষও হয়তো টিকে থাকতে পারবে না।
প্রমিথিউসের মর্মান্তিক গল্প
প্রাচীন বৃক্ষ রক্ষার আলোচনায় এক দুঃখজনক অধ্যায় বারবার ফিরে আসে। ১৯৬৪ সালে নেভাদার হুইলার পিকে গবেষকরা একটি ব্রিস্টলকোন পাইন কেটে ফেলেন। তখন তারা বুঝতেই পারেননি, সেটি ছিল প্রমিথিউস নামের কিংবদন্তি গাছ। পরে যখন রিং গুনে দেখা হলো, হতবাক সবাই এর বয়স অন্তত চার হাজার ৮৬২ বছর! অর্থাৎ মেথুসেলাহ থেকেও প্রাচীন। শুধু একটি বৈজ্ঞানিক ভুলে পৃথিবী হারাল সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত বৃক্ষকে। সেই ঘটনাই আজ সব প্রাচীন গাছকে বাড়তি সুরক্ষার যুক্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
সহস্রাব্দের সাক্ষী
আজও রেকর্ডে সবচেয়ে পুরোনো জীবন্ত গাছ হলো মেথুসেলাহ। কিন্তু যদি সত্যিই চিলির গ্রান আবুয়েলো অর্থাৎ ‘মহা-প্রপিতামহ’ পাঁচ হাজার ৪০০ বছরের পুরোনো প্রমাণিত হয়, তবে পৃথিবীর প্রাচীনতম বৃক্ষের সিংহাসন সরবে দক্ষিণ গোলার্ধে।
তবে সংখ্যার লড়াই আসল বিষয় নয়। এই বৃক্ষগুলো শুধু বয়সের পরিসংখ্যান নয়, তারা আসলে সময়ের নীরব সাক্ষী। মানবসভ্যতার উত্থান-পতন, সাম্রাজ্যের উন্মাদনা, যুদ্ধ, আগুন, প্লাবনসহ সবকিছুর ওপরে দাঁড়িয়ে আছে তারা। কিন্তু আজ জলবায়ু পরিবর্তনের অনিশ্চিত দুনিয়ায় তাদের টিকে থাকা আর নিশ্চিত নয়। আর যদি তারা হারিয়ে যায়, তবে আমরা হারাব শুধু একটি গাছ নয়, হারাব পৃথিবীর সবচেয়ে ধৈর্যশীল ইতিহাস-সংগ্রাহককে।
বাংলাদেশের প্রাচীন বৃক্ষের হুমকি
আমাদের দেশেও শতবর্ষী ও সহস্রাব্দ-প্রাচীন গাছের অস্তিত্ব আছে। রাজশাহীর বটগাছ, চট্টগ্রামের প্রাচীন অশ্বত্থ, অথবা সিলেটের পুরোনো রেইনট্রি। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্যে আছে বৈলাম, সিভেটের মতো আকাশছোঁয়া এবং বহু বছর রাজত্ব করা সব বৃক্ষ। কিন্তু এগুলোও এখন সংকটে। শহরায়ণ ও সড়ক সম্প্রসারণের জন্য গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে নির্মমভাবে। গ্রামীণ প্রান্তরে যেখানে একসময় প্রাচীন বট বা অশ্বত্থ ছিল আড্ডার কেন্দ্র, এখন সেখানেই দাঁড়িয়েছে কংক্রিটের স্তম্ভ। তেমনি পাহাড়ি অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বনভূমি উজার মিলিয়েও প্রাচীন সেই সব উঁচু বৃক্ষ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দেশে প্রাচীন বৃক্ষের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো মানুষই। জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, মাটিক্ষয়ও এই প্রাচীন বৃক্ষদের টিকে থাকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
এই গাছগুলো শুধু ছায়া দেয় না, তারা বহন করে সংস্কৃতি, ইতিহাস আর স্মৃতির ভার। তাই পৃথিবীর মেথুসেলাহ হোক বা বাংলাদেশের কোনো নাম-না-জানা শতবর্ষী বটগাছ, তাদের টিকে থাকা মানে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা।
সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, সায়েন্স ম্যাগাজিন, ইউএস ফরেস্ট সার্ভিস, রকি মাউন্টেন ট্রি রিং রিসার্চ, বিবিসি সায়েন্স ফোকাস