Logo
×

Follow Us

ফিচার

কার্বন সিঙ্ক : পৃথিবীর অদৃশ্য প্রহরী

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:২৯

কার্বন সিঙ্ক : পৃথিবীর অদৃশ্য প্রহরী

আমাদের এই পৃথিবী যেন এক বিশাল জীবন্ত সত্তা, আর এই সত্তার সুস্থ থাকার পেছনে রয়েছে অসংখ্য প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো ‘কার্বন চক্র’। কোটি কোটি বছর ধরে এই চক্র নিখুঁতভাবে পৃথিবীর জলবায়ু ও প্রাণ ধারণের পরিবেশকে স্থিতিশীল রেখেছে। তবে আধুনিক মানব কার্যকলাপের ফলে এই ভারসাম্য আজ চরম হুমকির মুখে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা এত বেড়ে গেছে যে জলবায়ু পরিবর্তন এখন ভয়াবহ এক হুমকি। এই পরিস্থিতিতে কার্বন সিঙ্ক বা কার্বন শোষকের ধারণাটি আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এরাই যেন পৃথিবীর অদৃশ্য প্রহরী, যারা প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে রক্ষা করছে।

কার্বন সিঙ্ক কী?

কার্বন সিঙ্ক এমন প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম প্রক্রিয়া, যা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য তা সংরক্ষণ করে রাখে। কল্পনা করুন, বায়ুমণ্ডলে যত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস আছে, তার কিছুটা এমন কিছুতে আটকা পড়ছে, যা একে আর পরিবেশে ফিরিয়ে না দিয়ে নিজের মধ্যে ধারণ করে রাখছে। এই ধারণ করে রাখা জিনিসগুলোই হলো কার্বন সিঙ্ক। যেমন-গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড নিয়ে সালোকসংশ্লেষণ করে বড় হয়, মহাসাগর কার্বন গ্যাস শোষণ করে নিজের গভীরে লুকিয়ে রাখে, আর মাটিও এর গভীরে কার্বন ধরে রাখে।

অন্যদিকে কার্বন সোর্স হলো সেই সব উৎস, যা বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছেড়ে দেয়। যখন আমরা কয়লা, তেল বা গ্যাস পোড়াই, গাড়ি চালাই, কলকারখানা থেকে ধোঁয়া বের হয় বা কোনো আগ্নেয়গিরি থেকে গ্যাস বের হয় তখন কার্বন সোর্সগুলো সক্রিয় হয়।

হাজার হাজার বছর ধরে কার্বন সিঙ্ক এবং কার্বন সোর্সের মধ্যে এক দারুণ ভারসাম্য ছিল। যখন সোর্স থেকে কার্বন 

ডাই-অক্সাইড বের হতো, সিঙ্কগুলো তা সহজেই শোষণ করে নিত। ফলে বাতাসে কার্বনের মাত্রা প্রায় একই রকম থাকত।

সমস্যাটা কোথায়

শিল্পবিপ্লবের পর থেকে এ দৃশ্য পাল্টে গেছে। আমরা এত বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াচ্ছি, বন কেটে ফেলছি যে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। আমাদের প্রাকৃতিক কার্বন সিঙ্কগুলো এত বিপুল পরিমাণ কার্বন শোষণ করতে পারছে না। ফলে গ্রিন হাউস গ্যাসগুলো পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই উষ্ণায়নই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ। 

কারা এই অদৃশ্য প্রহরী

মহাসাগর : আমাদের নীল সমুদ্র শুধু মাছ আর প্রবালের বাড়ি নয়, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কার্বন সিঙ্ক। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন 

ডাই-অক্সাইডের প্রায় ২৫ শতাংশ একাই শুষে নিয়েছে এই মহাসাগর। এই বিশাল কাজটি করে মূলত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সামুদ্রিক শৈবাল ও ব্যাকটেরিয়া, যাদের আমরা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বলি। এরা গাছের মতোই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। মজার ব্যাপার হলো, স্থলভাগের সব গাছ আর বন মিলে যতটা কার্বন শোষণ করে, ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন একাই প্রায় ততটা শোষণ করতে পারে!

মহাসাগর কেবল কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করেই থেমে থাকে না। এটি কার্বনকে তার গভীরে বিভিন্ন উপায়ে সংরক্ষণ করে। কিন্তু আমাদের মহাসাগরও আজ বিপদে। প্লাস্টিক দূষণ ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনদের কাজ করার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে, কারণ তারা খাবার ভেবে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা খেয়ে ফেলছে। আর বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে গিয়ে সমুদ্রের পানি ক্রমে আরো অমøীয় হয়ে উঠছে। 

মাটি : পৃথিবীর মাটি প্রতি বছর মানবসৃষ্ট সব কার্বন নির্গমনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শোষণ করে। মাটির গভীরে থাকা জৈব পদার্থ, যেমন-মৃত গাছপালা বা প্রাণীর অংশ, কার্বনকে আটকে রাখে। বিশেষ করে ‘পিটল্যান্ড’ (জলাভূমি যেখানে পচন ধরা গাছপালা জমে থাকে) এবং ‘পারমাফ্রস্ট’ (চিরহিমায়িত মাটি) কার্বনের বিশাল উৎস। এই পিটল্যান্ড ও পারমাফ্রস্ট হাজার হাজার বছর ধরে বিপুল পরিমাণ কার্বন সঞ্চয় করে রাখে।

তবে আধুনিক কৃষিকাজ, জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তন মাটিকেও হুমকির মুখে ফেলছে। অতিরিক্ত চাষের ফলে মাটির জৈব কার্বন নষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পারমাফ্রস্ট গলে যাচ্ছে। ফলে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মাটির নিচে আটকে থাকা কার্বন, বিশেষ করে মিথেন গ্যাস (যা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস), বায়ুমণ্ডলে মিশে যাচ্ছে।

বন  : বনভূমি যে কার্বন শোষণ করে, তা আমরা সবাই জানি। গাছপালা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড টেনে নেয় এবং নিজেদের শরীরে কাণ্ড, ডালপালা, পাতা ও শিকড়ে সঞ্চয় করে। বিশ্বের বনগুলো প্রতি বছর প্রায় ২.৬ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে।

কিন্তু বনের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সত্ত্বেও আমরা প্রতিনিয়ত বন উজাড় করে চলেছি।

ছত্রাক : আমাদের পায়ের নিচের মাটির গভীরে এক বিশাল অদৃশ্য জগৎ বাস করে, সেটা হলো ছত্রাক বা ফাঙ্গাস। 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছত্রাকগুলো প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমনের এক-তৃতীয়াংশের বেশি শোষণ ও সংরক্ষণ করে! বিশেষ করে ‘মাইকোরাইজাল ছত্রাক’ নামের এক ধরনের ফাঙ্গাস গাছের শিকড়ের সঙ্গে মিশে থাকে। এরা গাছের কাছ থেকে খাবার নেয় এবং বিনিময়ে গাছকে মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান শোষণে সাহায্য করে। আর এই প্রক্রিয়ায় কার্বনের একটা বড় অংশ মাটির জৈব পদার্থে রূপান্তরিত হয়ে জমা হয়।

আধুনিক চাষের পদ্ধতি যেমন বারবার গভীর লাঙল দেওয়া এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার এই উপকারী ছত্রাকগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

হাতি ও অন্যান্য বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী : শুনতে কিছুটা অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু হাতিদের মতো বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীরাও প্রাকৃতিক কার্বন শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে হাতিরা বনভূমিতে গাছপালা খেয়ে ফেলে। এর ফলে বনের ঘন ঝোপঝাড় কমে যায় এবং দাবানলের ঝুঁকি কমে। যখন তারা গাছপালা মাড়িয়ে চলে, তখন সেই উদ্ভিদের কার্বনকে মাটির গভীরে প্রবেশ করায়, যেখানে এটি অনেক বেশি সময় ধরে আটকে থাকতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, যে বনভূমিতে হাতি বিচরণ করে, সেখানে কার্বন সঞ্চয়ের হার হাতিবিহীন বনের চেয়ে বেশি হয়। 

ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ : সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রাকৃতিক কার্বন সিঙ্কগুলোর কার্যকারিতাকে ব্যাহত করছে।  সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ার কারণে এর কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। উষ্ণ জল ঠান্ডা জলের চেয়ে কম কার্বন গ্যাস ধরে রাখতে পারে। 

দাবানলের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়ছে। এতে গাছপালা পুড়ে গিয়ে সঞ্চিত কার্বন আবার বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসছে। এমনকি অ্যামাজন রেইনফরেস্টের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনগুলোও চাপে আছে, কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে যে তারা কার্বন শোষকের বদলে কার্বন উৎস হয়ে ওঠার ঝুঁকিতে আছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে পারমাফ্রস্ট দ্রুত গলে যাচ্ছে এবং এর মধ্যে আটকে থাকা বিপুল পরিমাণ মিথেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে মিশে যাচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করছে।

আমাদের কী করা উচিত?

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বন সিঙ্কগুলোকে রক্ষা করা এবং তাদের ক্ষমতা বাড়ানো এখন আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।  কয়লা, তেল, গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার বাড়াতে হবে। গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে এবং ব্যাপক হারে নতুন গাছ লাগাতে হবে। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলে থাকা ম্যানগ্রোভ বনগুলো (নীল কার্বন সিঙ্ক নামে পরিচিত) রক্ষা করা খুবই জরুরি। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষাকারী কৃষি পদ্ধতি যেমন, মাটি না কোপানো চাষ (নো-টিল ফার্মিং), জমিতে ফসলের অবশেষ রাখা (কভার ক্রপিং) এবং জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।  

প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করতে হবে এবং সমুদ্রের যে অংশগুলোতে প্রাণীরা নিরাপদে থাকতে পারে, সেগুলোর সংখ্যা বাড়াতে হবে। বিভিন্ন দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কার্বন সিঙ্ক সমৃদ্ধ দেশগুলোকে তাদের পরিবেশ রক্ষায় প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজের মতো নতুন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন করতে হবে, যা সরাসরি বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড টেনে নিতে পারে।

প্রকৃতির এই ‘অদৃশ্য প্রহরী’দের সম্মান ও সংরক্ষণ করতে না পারলে মানবজাতিকে আরো ভয়াবহ জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫