Logo
×

Follow Us

ফিচার

আগ্রাসনবিরোধী ‘আট স্তম্ভ’ যে গল্প বলে

Icon

সৈয়দ ফরহাদ

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:২৯

আগ্রাসনবিরোধী ‘আট স্তম্ভ’ যে গল্প বলে

‘আট স্তম্ভ’ শোষকের আঘাতে আর বুলেটে জর্জরিত শোষিতের দেহকে তুলে ধরে। পলাশীর মোড়ে পৌঁছাতেই চোখে পড়ল আটটি স্তম্ভ। মোড়ের ঠিক মাঝখানটায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশ দিয়ে ছুটে চলেছে যানবাহন। কানে আসছে হর্নের শব্দ। রাস্তা পার হচ্ছে স্কুলফেরত কিশোর-কিশোরী। ওদের হাসি আর গল্প মিশে যাচ্ছে শহরের কোলাহলে। যানবাহনের দিদ্বিদিক ছুটে চলা, রাস্তার মোড়ের বাজার, মানুষের হৈ-হট্টগোল, এসব কিছুর মধ্যেও স্তম্ভগুলোর নীরবতা যেন নিজেই এক ভাষা। প্রতিরোধের ভাষা।

ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘরের এদিকটা থেকে রাস্তা পার হয়ে বাজারের দিকে গেলাম। রিকশার যাত্রীদের কেউ কেউ মাথা উঁচু করে দেখে নিচ্ছে, এক স্কুলড্রেস পরা কিশোরী আঙুল তুলে বলল, ‘এই দেখ দেখ’।

কিছু রিকশা এদিক-ওদিক মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। এক রিকশাচালকের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই এগিয়ে গেলাম। আট স্তম্ভের দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মামা, এই জিনিসটা কী?’ খুব সহজ ভাষায় বললেন, ‘ওই যে হাসিনার সময়, মাইরা ফেলাইছিল যে? তার লাইগা এইডা বানাইছে।’ নাম জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, রিপন দেওয়ান।

সাধারণ মানুষের স্মৃতি আর ভাষার মধ্যে তার প্রতিরোধ সংগ্রাম ঠিক এভাবেই টিকে থাকে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন সালমান রহমান, স্থানীয় একটি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। রাস্তার মোড়ে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। বললেন, ‘আবরারকে পিটিয়ে মারে ছাত্রলীগ। তার স্মৃতিতে এটা বানানো হয়।’ তার চোখে ছিল শ্রদ্ধা আর একই সঙ্গে ক্ষোভের মিশেল। এই দুজনের উত্তর আমাদের মনে করিয়ে দেয় স্তম্ভগুলো শুধুই স্থাপত্য নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের স্মৃতির মূর্ত প্রতীক। 

এই আগ্রাসনবিরোধী ‘আট স্তম্ভ’ তৈরি হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র শহীদ আবরার ফাহাদ স্মরণে।

২০১৯ সালের অক্টোবরে, বর্তমানে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে নিহত হন বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ। কেন এমন অকালমৃত্যু হলো আবরার ফাহাদের?

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তৎকালীন ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পানিচুক্তির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন আবরার ফাহাদ। আর এই কারণে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয় তার। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে।

ঠিক তার পরের বছর, ২০২০ সালে এই আট স্তম্ভের প্রথম পরিকল্পনা করেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। সে সময়ের স্মৃতি নিজের ফেসবুক পোস্টে তিনি তুলে ধরেন এভাবে-‘আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভের প্রাথমিক খসড়া। ৫ অথবা ৬ অক্টোবর, ২০২০। গ্রাম থেকে আখতারকে এ খসড়া পাঠিয়ে রেখেছিলাম, কিন্তু সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলে গ্রাম বা যে যেখানে ছিল সেখান থেকে আমরা ঢাকায় এসেছিলাম আট স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার জন্য। আট স্তম্ভের সূত্রে পরবর্তী সময়ে আমাদের রাজনৈতিক বয়ান ও কৌশলে অনেক বিবর্তন ঘটেছিল।’

তার ওই পোস্টে তিনি আরো লেখেন ‘সে সময়ের ক্যাম্পাসের অ্যাক্টিভিস্ট বিশেষত তৎকালীন ছাত্র অধিকার পরিষদ ও পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির কর্মীদের সাহসিকতা ও অব্যাহত লড়াইয়ের ফলে শহীদ আবরার ফাহাদ ও আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ এখন জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। গত সাত-আট বছরের ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের সকল সহযোদ্ধাকে সালাম।’

কী বলছে আট স্তম্ভ? 

আট স্তম্ভ দিচ্ছে আটটি বার্তা-সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, গণ প্রতিরক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, দেশীয় শিল্প-কৃষি-নদী-বন-বন্দর রক্ষা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা।

এই স্তম্ভ নিয়ে আমরা আলাপ করেছিলাম, স্তম্ভের চূড়ান্ত নকশাকার স্থপতি নাজমুল হক নাইমের সঙ্গে। তিনি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক।

তিনি আমাদের জানান, প্রতিটি পিলার এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন দেখে মনে হয় সুপার ন্যাচারাল কিছু শূন্যে ভেসে আছে। পিলারের নিচের অংশে আছে কালো একটি বেইস, যা শোকের প্রতীক। পিলারগুলো কিছু কালো সাপোর্ট দিয়ে সেই বেইসের সঙ্গে সংযুক্ত। যেন রাতের বেলা এদের ভেসে থাকা কিছু প্রতীকী অবয়ব মনে হয়। যারা অসম্ভব সাহসের প্রতীক। উপরের জং ধরা মেটালের অংশে আছে অনেক ছিদ্র, যা শোষকের আঘাতে আর বুলেটে জর্জরিত শোষিতের দেহকে তুলে ধরে। জং ধরা মেটাল মনে করায় আবরারের মতো অসংখ্য শহীদ আর নির্যাতিতদের কথা, যাদের রক্ত শুকিয়ে গেলেও তারা আমাদের মনে ভাস্বর হয়ে আছে অনন্ত অসীম কালের জন্য। রাতের বেলা সেই ক্ষতবিক্ষত দেহই আবার ঠিকরে বের করে আলো, যা নতুন পথিকদের পথ দেখায়। উপরের দিকে ছুড়ে দেওয়া আলো মনে করায় তাদের অনন্ত অসীমের পথে যাত্রার কথা, যা দূর থেকেও অনুপ্রেরণা জাগায়।

তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, স্থান হিসেবে পলাশীর মোড়কে বিবেচনা করার বিশেষ কোনো কারণ আছে কি না?

উত্তরে তিনি বলেন, ‘পলাশী যেহেতু বুয়েটসংলগ্ন, এটা এখানে হওয়াটাই যুক্তিসংগত। আগের যে মনুমেন্টটি ২০২০-এ বানানো হয়, সেটি এখানেই ছিল। তৎকালীন সরকার সেটা ভেঙে দেয়। তা ছাড়া পলাশীর আলাদা আবেদন আছে বুয়েটিয়ানদের কাছে। এটা ঢাবি বুয়েটের সংযোগ স্থল, অনেক মানুষ এই পথ দিয়েই যাওয়া-আসা করে করে।’ তার কাছে আমরা আরো জানতে চেয়েছিলাম, এই ‘আট স্তম্ভ’ নির্মাণে স্থাপত্যশিল্পের বিশেষ কোনো ধারা অনুসরণ করা হয়েছে কি না?

তিনি বলেন, ‘স্থাপত্যের মূল ব্যাপারটাই হলো জ্যামিতিক ফর্ম, টেক্সচার, লাইট, ম্যাটেরিয়াল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। এগুলো স্থাপত্যের ভাষা, বর্ণমালা। এগুলোর সব এই প্রজেক্টে অ্যাপ্লাই করা হয়েছে। এগুলো দিয়েই গল্প বলার চেষ্টা করেছি।’

ফেরা যাক পলাশীর মোড়ে। স্তম্ভগুলো মধ্য দুপুরের সূর্যের তেজকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে আছে। জানান দিচ্ছে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে মাথা নত না করার বার্তা। চলতি পথে কেউ কেউ এখানে থমকে যায়, কিছু সময়ের জন্য মগ্ন হয় আট স্তম্ভের স্পর্ধিত উচ্চারণে। প্রতিটি দৃষ্টি যেন বলে, ‘আমরা ভুলিনি’।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫