Logo
×

Follow Us

ফিচার

একটি সাবমেরিনের রহস্যময় অন্তর্ধান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা

Icon

রফিকুর রহমান প্রিয়াম

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:৩১

একটি সাবমেরিনের রহস্যময় অন্তর্ধান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস। বঙ্গোপসাগরের গভীরে এক নীরব ঘাতক নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছিল। তার নাম পিএনএস গাজী, পাকিস্তান নৌবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং একমাত্র দূরপাল্লার সাবমেরিন। করাচি থেকে প্রায় চার হাজার ৮০০ কিলোমিটারের এক বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিয়ে তাকে পাঠানো হয়েছিল এক ভয়ংকর মিশনে, যার ওপর নির্ভর করছিল যুদ্ধের গতিপথ। গাজীর এই অন্তিম যাত্রার কাহিনি শুধু একটি সামরিক ব্যর্থতার গল্প নয়, এটি এক গভীর রহস্য এবং একটি নতুন জাতির জন্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

গাজী সাবমেরিনটি ২৮টি পর্যন্ত আধুনিক টর্পেডো বহন করতে পারত। এর প্রধান কাজ ছিল শত্রু জাহাজে টর্পেডো হামলা চালিয়ে সেগুলোকে ডুবিয়ে দেওয়া। টর্পেডো ছাড়াও গাজীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ছিল সমুদ্রে মাইন পাতার মাধ্যমে শত্রুপক্ষের বন্দর বা নৌচলাচলের পথ অবরুদ্ধ করে দেওয়া। 

গাজীর প্রধান লক্ষ্য ছিল একটিই, প্রতিপক্ষের বিমানবাহী রণতরি আইএনএস ভিক্রান্তকে খুঁজে বের করে ধ্বংস করা। ভিক্রান্ত ছিল পূর্বাঞ্চলীয় নৌবহরের কেন্দ্রবিন্দু, একটি ভাসমান বিমানঘাঁটি, যা সাগরের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারত। পাকিস্তান হাইকমান্ড জানত, ভিক্রান্তকে যদি ডুবিয়ে দেওয়া যায়, তবে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যাবে। এটি হতো এক মাস্টারস্ট্রোক, যা পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীকে অবরুদ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারত। এই বিশাল ঝুঁকি মাথায় নিয়েই গাজী তার শিকারের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিল।

কিন্তু ১৪ নভেম্বর করাচি বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করার পর গাজী যেন সমুদ্রের গভীরে মিলিয়ে গেল। তার ক্রুদের নির্দেশ ছিল ২৬ নভেম্বর তারিখে একবার নৌ সদর দপ্তরে নিজেদের অবস্থান জানাতে। কিন্তু সেই কাক্সিক্ষত বার্তা কখনোই আসেনি। দিন গড়িয়ে সপ্তাহ পার হলো, কিন্তু গাজীর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। নৌ সদর দপ্তরে উদ্বেগ বাড়ছিল। কী ঘটছিল সেই পুরোনো সাবমেরিনটির ভেতরে? দীর্ঘ যাত্রার ধকল, নাকি যান্ত্রিক ত্রুটি? নাকি আরো গভীর কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল সে?

এরপর এলো ৩ ডিসেম্বরের সেই রহস্যময় রাত। চূড়ান্ত যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার ঠিক মুহূর্তে বিশাখাপত্তনম উপকূলের কাছে সমুদ্রের গভীরে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটল। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে উপকূলের বাড়িঘরের জানালাগুলোও কেঁপে উঠেছিল। পরদিন সকালে জেলেরা সাগরে তেল ভাসতে ও কিছু ধ্বংসাবশেষ দেখতে পায়। একটি লাইফ ভেস্ট পাওয়া যায়, যাতে লেখা ছিল সাবমেরিনটির আগের নাম, ‘ইউএসএস ডিয়াবলো’। ৯৩ জন নাবিকসহ পিএনএস গাজী এখন সমুদ্রের নিচে এক শীতল সমাধিতে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু কীভাবে ঘটল এই বিস্ফোরণ? এই রহস্যের জট আজও খোলেনি। একটি পক্ষ দাবি করে, তাদের একটি ডেস্ট্রয়ারের ছোড়া ডেপথ চার্জের আঘাতেই গাজী ধ্বংস হয়। কিন্তু পাকিস্তানি নৌবাহিনী এবং অনেক নিরপেক্ষ বিশ্লেষকের মতে, ঘটনাটি ছিল একটি অভ্যন্তরীণ দুর্ঘটনা। তাদের তত্ত্ব অনুযায়ী, হয় মাইন পাতার সময় কোনো মারাত্মক ভুল হয়েছিল অথবা সাবমেরিনের ব্যাটারি চার্জের সময় উৎপন্ন হাইড্রোজেন গ্যাসে বিস্ফোরণ ঘটে। ধ্বংসাবশেষের ছবিতে দেখা যায়, সাবমেরিনের বাইরের অংশ ভেতরের দিকে না ঢুকে, বরং বাইরের দিকে বেঁকে গেছে, যা অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণের দিকেই জোরালোভাবে ইঙ্গিত করে। শিকারি কি তবে নিজের অস্ত্রে নিজেই ঘায়েল হয়েছিল? উত্তরটি হয়তো গাজীর সঙ্গেই সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে গেছে।

কারণ যা-ই হোক না কেন, গাজীর এই আকস্মিক অন্তর্ধান ছিল যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পূর্বাঞ্চলে প্রতিপক্ষের নৌবহরের জন্য গাজীই ছিল একমাত্র সত্যিকারের হুমকি। তার অনুপস্থিতিতে বঙ্গোপসাগর প্রতিপক্ষের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়ে যায়।

গাজীর প্রধান শিকার, সেই বিমানবাহী রণতরি ভিক্রান্ত, তখন নির্ভয়ে তার ধ্বংসলীলা শুরু করল। ৪ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী ১০ দিন ধরে ভিক্রান্তের বিমানগুলো চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা ও মোংলা বন্দর এবং সামরিক স্থাপনার ওপর নিরলসভাবে বোমাবর্ষণ করে। এতে আকাশ ও সমুদ্রপথে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য সব ধরনের রসদ, সৈন্য বা রসদ সরবরাহের পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এক কথায়, পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য এক দুর্ভেদ্য নৌ-অবরোধ তৈরি হয়।

এই অবরোধ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কফিনে শেষ পেরেক। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে, ৯৩ হাজার সৈন্যসহ পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড এক অসহায় অবস্থায় আটকা পড়ল। তাদের জন্য পালানোর কোনো পথ ছিল না, সাহায্য আসারও কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সমুদ্র, যা ছিল তাদের একমাত্র লাইফলাইন, তাই হয়ে উঠল তাদের কারাগার। এই কৌশলগত শ্বাসরোধের ফলেই পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে এবং ১৬ ডিসেম্বর তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

একটি সাবমেরিনের নীরব সমাধি একটি নতুন দেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। পিএনএস গাজীর রহস্যময় অন্তর্ধান বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে, যার আসল সত্যিটা আজও সমুদ্রের অতল গভীরে চাপা পড়ে আছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫