Logo
×

Follow Us

ফিচার

টক্সিক পজিটিভিটি

ভালো থাকার অতিরিক্ত চাপ

Icon

মনিরা তাবাস্‌সুম

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:১২

ভালো থাকার অতিরিক্ত চাপ

সব সময় হাসিখুশি থাক, সব ঠিক হয়ে যাবে, থিংক পজিটিভ-এই কথাগুলো আমাদের জীবনের প্রতিদিনের মন্ত্র। কিন্তু যদি সেই ‘ইতিবাচকতা’ই একসময় চাপ হয়ে দাঁড়ায়? কেউ তার কষ্ট, রাগ বা হতাশা প্রকাশ করলেই বলি, নেতিবাচক কথা বলো না-এই কথাটা কি সত্যিই ভালো কিছু? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত ইতিবাচকতা কখনো কখনো হয়ে উঠছে বিষাক্ত আর একেই বলা হচ্ছে ‘টক্সিক পজিটিভিটি’, যা আমাদের স্বাভাবিক অনুভূতিগুলোকে দমিয়ে রাখে। আজকের সময়ে এসে সবাই চাই ইতিবাচক থাকতে, আশাবাদী মন নিয়ে জীবন কাটাতে। কিন্তু যখন সেই ‘পজিটিভ’ থাকার ব্যাপারটাই অন্যের অনুভূতিকে অস্বীকার করে কিংবা নিজের ভেতরের ব্যথা চেপে রাখতে বাধ্য করে, তখন সেটিই হয়ে ওঠে ‘টক্সিক পজিটিভিটি’।

ইতিবাচকতার উল্টো দিক : মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ সব সময় ভালো থাকতে পারে না-এটিকে অস্বীকার করাটাই বিপদ ডেকে আনে। যখন অন্যের কষ্ট শুনে বলি, ‘নেতিবাচক ভাবনা বাদ দাও’, তখন আসলে তার বাস্তব অনুভূতিকে অগ্রাহ্য করি। এতে মানুষ নিজেকে আরো একা মনে করে। নিজের দুঃখ বা রাগ প্রকাশ করার জায়গাটা হারায়। এই ‘ভালো আছি’র সংস্কৃতিই অনেক সময় মানসিক স্বাস্থ্যকে সংকটে ফেলে দেয়। হতাশা, উদ্বেগ কিংবা ব্যর্থতার মতো অনুভূতিগুলো তখন অবদমিত হয়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় সুখের মুখোশ : ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে সুখী জীবনের প্রদর্শনের এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সবাই সুখী, সফল, নির্ভার-এমন এক ভান চারপাশে তৈরি হয়েছে। এই চিত্রটাই অন্যদের মনে তৈরি করে অপরাধবোধ-‘আমি কেন ওর মতো সুখী নই?’ মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যখন সামাজিক মাধ্যমে সবাই শুধু হাসির ছবি, ভ্রমণের গল্প কিংবা ‘লাভ ইউ মাই লাইফ’ পোস্ট করে, তখন বাস্তব জীবনের কষ্টগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়। এতে অন্যরা নিজেদের কষ্টকে লজ্জার মনে করতে শুরু করে। ফলে তারা কষ্টগুলো আরো চেপে রাখে। আর এটাই টক্সিক পজিটিভিটির শিকড়।

কর্মক্ষেত্রেও ‘চাপের হাসি’ : করপোরেট দুনিয়ায় ‘অলওয়েজ হ্যাপি’ নীতিটাই যেন নীরব বাধ্যবাধকতা। টার্গেট মিস করলেও হাসিমুখে থাকতে হবে, মানসিক চাপের কথা বলা মানে দুর্বলতা। নীরবতা, হাসি আর ভেতরের যন্ত্রণা সব মিলিয়ে জন্ম নেয় মানসিক ক্লান্তি। মনোবিজ্ঞানীরা পরামর্শ দেন, এই চাপ থেকে মুক্তির প্রথম ধাপ হলো অনুভূতিকে স্বীকার করা। দুঃখ, রাগ, ভয় সবই মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতি। এগুলো অস্বীকার না করে প্রকাশের জায়গা তৈরি করাটাই সুস্থতার পথ।

‘সব সময় ভালো থাকতে হবে’ ধারণাটিই ভুল : টক্সিক পজিটিভিটি মানে জীবনের নেতিবাচক দিককে উপেক্ষা করা। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী জ্যানেট পেনফিল্ড বলেন, ‘ইতিবাচক চিন্তা তখনই শক্তি দেয়, যখন তা বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে বলা হয়। কিন্তু যখন সেটি বাস্তব কষ্টকে ঢেকে দেয়, তখন সেটাই হয়ে যায় বিষ।’

স্বীকৃতি, সহানুভূতি আর মানবিকতা : বেঁচে থাকার মানে কেবল সুখী থাকা নয়, বরং অনুভব করা। দুঃখও যেমন আমাদের শেখায়, তেমনি ভয় বা ব্যর্থতাও মানুষকে শিক্ষা দেয়। একজন বন্ধুর কান্নার সামনে হাসি নয়, বরং সহানুভূতি প্রকাশই মানবিকতা। কেউ যখন তার কষ্টের কথা বলে, তখন তাকে থামিয়ে না দিয়ে শুনতে হবে। ‘তুমি কষ্টে আছ, আমি বুঝতে পারছি’-এই কথাটুকুই দিতে পারে অনেক প্রশান্তি।

নিজের অনুভূতিকে স্থান দাও : জীবন সব সময় উজ্জ্বল নয়। তবু শিখে গেছি, ‘চলো, পজিটিভ থাক।’ কিন্তু এখন হয়তো সময় এসেছে একটু থেমে নিজের মনকে জিজ্ঞেস করার, আমি আসলে কেমন আছি? টক্সিক পজিটিভিটি থেকে বেরিয়ে আসা মানে নেতিবাচক হওয়া নয়; বরং বাস্তবিক হওয়া। ইতিবাচক থাকা ভালো, কিন্তু তার মানে এই নয় যে জীবনের কষ্ট মুছে ফেলতে হবে। বরং সত্যিকারের ইতিবাচকতা মানে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫