‘সামুরাই’ বলতেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে অতিমানবীয় এক যোদ্ধার অবয়ব; যিনি তলোয়ার চালানোয় এতটাই দক্ষ যে মুহূর্তেই শত শত যোদ্ধাকে ধরাশায়ী করছেন, অথচ তার শরীরে একটি আঁচড় পর্যন্ত লাগছে না! আমাদের চোখে সামুরাই যোদ্ধাদের এমন ছবি এঁকে দিয়েছিল নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে প্রচারিত এবং ‘শূন্য দশকে’ পুনঃপ্রচারিত ‘সামুরাই এক্স’ কার্টুনটি। কার্টুনে স্বাভাবিকভাবেই একটু বাড়িয়ে-চড়িয়েই সামুরাইদের লড়াইয়ের দক্ষতা উপস্থাপন করা হয়েছে। এটা অবশ্য শিশুমনকে উদ্বেলিত করতেই করা হয়েছে; কিন্তু সামুরাইদের নিয়ে নির্মিত সিনেমায় ইতিহাসের নিরীখেই তাদের চিত্রায়িত করা হয়েছে। তবে এ কথাও সত্যি যে বাস্তবেই সামুরাই যোদ্ধারা ঈর্ষণীয়ভাবে দক্ষ ও লড়াকু ছিলেন। সামুরাইদের নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি আর অদ্ভুত সব গল্প। ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়া এই সামুরাইদের নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি ছিল না কখনোই। আজও নেই। ইতিহাস থেকে লোকগল্প, কার্টুন এবং সিনেমায় স্থান করে নেওয়া সামুরাই যোদ্ধাদের থেকে পাঁচজন অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব আজ।
ভ্যালিগনানো ইয়াসুকে
আফ্রিকার অধিবাসী এই মানুষটির পুরো নাম ছিল আলেসান্দ্রো ভ্যালিগনানো ইয়াসুকে। তিনি ছিলেন জেসুইট ধর্মপ্রচারক। ১৫৭৯ সালে কোনো এক ভাবে তিনি জাপানিদের হাতে চলে আসেন। পরে তাকে দাস হিসেবে নিয়ে আসা হয় জাপানে। কৃষ্ণবর্ণের এই মানুষটিকে উপস্থিত করা হয় তৎকালীন সামুরাই শাসক ওডা নোবুনাগার দরবারে। ইয়াসুকের দৈহিক গড়ন ও উচ্চতার জন্য নিজের একান্ত সঙ্গী ও ব্যক্তিগত রক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন ওডা নোবুনাগা। কিছুদিন পর তাকে সামুরাই পদে ভূষিত করা হয় এবং বহুমূল্য উপহার তাকে প্রদান করা হয়। একটি যুদ্ধে ওডা নোবুনাগার পরাজিত ও নিহত হন। ইয়াসুকের ভাগ্যে জোটে বন্দিজীবন। তবে জেসুইট ধর্ম প্রচারকদের সম্মানে শত্রুপক্ষ পরবর্তী সময়ে তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠায়।
কুসুনুকি মাসাশিগে
তিনি ছিলেন সম্রাট গো-দাইগোর প্রতি অনুগত বিখ্যাত একজন সামুরাই যোদ্ধা এবং সমর কৌশলবিদ। সম্রাটের বিপক্ষে গিয়ে কামাকুরা শগুনাত যখন একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখল করে নিচ্ছিলেন, তখন কুসুনুকি মাসাশিগে মরণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। ১৩৩২ সালে কামাকুরা শগুনাত ওসাকার দক্ষিণে অবস্থিত চিহায়া দুর্গ দখলে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করেন। সে সময় মাত্র দুই হাজার সৈন্যকে সঙ্গী করে শগুনাতের প্রায় এক লাখ সৈনিকের বিপক্ষে লড়াই করে অবিশ্বাস্যভাবে পতনের হাত থেকে দুর্গটি রক্ষা করতে সক্ষম হন।
মিনাতো নদীর যুদ্ধে কুসুনুকি মাসাশিগে শক্তিবৃদ্ধি এবং রণকৌশলের অংশ হিসেবে পিছু হটার পরামর্শ দিলে সম্রাট সে পরামর্শ গ্রহণ না করে তাকে সরাসরি সম্মুখ সমরের প্রস্তুতি নিতে বলেন। অসম সে যুদ্ধে তারা শত্রুপক্ষের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলে পরাজয় অনিবার্য হয়ে পড়ে। তখন কুসুনুকি মাসাশিগে সামুরাই ঐতিহ্য মেনে আত্মসমর্পণ না করে নিজের তলোয়ার দিয়ে পেট কেটে আত্মাহুতি দেন। তার সম্মানার্থে টোকিওর ইম্পেরিয়াল প্রাসাদের বাইরে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে, যা আজও স্বমহিমায় টিকে আছে।
টোমোয়ে গোজেন
জাপানে সামুরাই শাসন শুরু হলে নারীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে থাকে। মূলত বহিঃশত্রুর হাত থেকে নিজেকে ও পরিবারকে রক্ষা করার জন্যই এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। সেই প্রশিক্ষিত নারীদেরই একজন ছিলেন টোমোয়ে গোজেন। তবে তিনি নিজেকে ও পরিবারকে রক্ষার কাজে থাকেননি; সরাসরি রণক্ষেত্রে লড়াই করেছেন। ১১৮০ থেকে ১১৮৫ সালে সংগঠিত গেনপেই যুদ্ধে গোজেন এক হাজার অশ্বারোহীর এক সুবিশাল সামুরাই সৈন্যদলকে নেতৃত্ব দেন। সে যুদ্ধে গোজেন তার হাতে নিহত শত্রুপক্ষের অসংখ্য সৈন্যদের বিচ্ছিন্ন মাথা সংগ্রহ করে নিজের কাছে রেখে দেন! কিংবদন্তি রয়েছে, গোজেন শুধু যুদ্ধে পারদর্শীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক রূপবতী নারী। তার ঘন-কালো চুল এবং মোহনীয় রূপ সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করত।
মিয়ামোতো মুসাশি
জাপানের হায়োগো প্রদেশের দক্ষিণাংশের হারিমা অঞ্চলে ১৫৮৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন মিয়ামোতো মুসাশি। প্রথাগতভাবে তিনি কখনোই ভূস্বামীদের সেবক ছিলেন না এবং কখনোই তিনি যুদ্ধে অংশ নেননি। সামুরাই পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় মুসাশিকে অবশ্য সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়েছে। যুদ্ধে যোগ না দিলেও মুসাশি বিভিন্ন দ্বৈত লড়াইয়ে নিয়মিত অংশ নিতেন। ৬০টিরও অধিক দ্বৈত লড়াইয়ে বিজয় অর্জনের পর তিনি সামুরাই শিশুদের জন্য একটি সামরিক প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে শিশুদের তরবারি চালানো, তীর ছোঁড়া, বর্শা নিক্ষেপ ও ঘোড়সওয়ারী শেখানো হতো। মিয়ামোতো মুসাশি তার শেষ বয়সে পশ্চিমের কুমামোটোর রেইগান্ডো নামক এক গুহায় আশ্রয় নেন। সেখানে বসেই তিনি ‘দ্য বুক অব ফাইভ রিংস’ নামে একটি বই রচনা করেন এবং সেখানেই তিনি মারা যান।
তাকেদা শিনগেন
তাকেদা গোত্র ছিল মিয়ামোটো গোষ্ঠীরই একটি বিচ্ছিন্ন অংশ। এই গোষ্ঠীরই প্রধান ছিলেন তাকেদা শিনগেন। ১৫৪০ সালে শিনগেন নিজের পিতাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে গোষ্ঠীপ্রধানের ক্ষমতা দখল করেন। কিছুদিন পর তিনি শিনানো প্রদেশ দখল করতে বেরিয়ে পড়েন। তার আক্রমণের মুখে একের পর এক দুর্গের প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে থাকে এবং তিনি শিনানো প্রদেশ দখল করতে সক্ষম হন। এ যুদ্ধের পরও তাকেদা শিনগেন বেশ কিছু যুদ্ধে জড়িয়েছেন। সেসব যুদ্ধই তাকে বিখ্যাত একজন সামুরাই যোদ্ধা হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে দিয়েছে। ১৫৭৩ সালে শিনগেন এক ভয়ানক ক্ষতর কারণে মৃত্যুবরণ করেন। জাপানে তার স্মরণে প্রতি বছর ১২ এপ্রিল কোফু সিটি ইয়ামানাশিতে পালিত হয় শিনগেন-কো উৎসব।
