প্রতীকী ছবি
মানবজীবনের কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই-আমরা নিজেরাই অর্থ খুঁজে বেড়াই, অর্থহীন মহাবিশ্বের অর্থ খুজি, যা আমাদের মস্তিষ্ককে একটি নিরর্থক প্রক্রিয়ায় চালিত করে। এই খোঁজ আমাদের মস্তিষ্ককে এমনভাবে চালিত করে, যেন আমরা নিজের অস্তিত্বকে মূল্যবান প্রমাণ করতে চাই। এটা আসলে এক ধরনের মানসিক প্রতিরক্ষা কৌশল। আমাদের সব জ্ঞান ও মূল্যবোধ অর্থহীন ও বিকৃত, কারণ তা একটি শূন্য অস্তিত্বকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি চিন্তা ও প্রতিটি অনুভূতি মস্তিষ্কের জটিল কার্যকলাপের ফল। এটি শুধু আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল রাখে না, বরং আমাদের চেতনা, স্মৃতি, আবেগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো উচ্চতর কার্যক্রমগুলোও নিয়ন্ত্রণ করে।
জ্ঞানীয় বিকৃতি (Cognitive Distortion) হলো এমন চিন্তার ধরন, যা বাস্তবতাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে। মস্তিষ্ক ও বিকৃত জ্ঞানের সম্পর্ক একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা জ্ঞানীয় স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়। এই সম্পর্ক বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণ করে যে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা এবং গঠনগত পরিবর্তন কীভাবে আমাদের চিন্তাভাবনার ধরন ও বাস্তবতার উপলব্ধি প্রভাবিত করতে পারে।
মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কোরটেক্স অংশটি যুক্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়া বা কিছু ধরনের নিউরোডিজেনারেটিভ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রিফ্রন্টাল কোরটেক্সের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এই দুর্বল কার্যকারিতা যেকোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে, কিন্তু এটি সব ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বিকৃত চিন্তার কারণ নয়।
অ্যামিগডালা মস্তিষ্কের একটি অংশ, যা আমাদের আবেগ বিশেষ করে ভয় এবং উদ্বেগের সঙ্গে যুক্ত। যখন অ্যামিগডালা অতিরিক্ত সক্রিয় থাকে, তখন ব্যক্তি সবকিছু বা প্রতিটি ঘটনার প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে পড়তে পারে। এটিই ‘মেন্টাল ফিল্টারিং’র জন্ম দিতে পারে।
‘মেন্টাল ফিল্টারিং’ বা ‘মানসিক ছাঁকনি’ হলো একটি জ্ঞানীয় বিকৃতি বা কগনিটিভ ডিসটরশন, যা একজন ব্যক্তিকে কোনো পরিস্থিতি বা অভিজ্ঞতার নেতিবাচক দিকগুলোর ওপর মনোযোগ দিতে প্রভাবিত করে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি ইতিবাচক দিকগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারে। এটি এক ধরনের মনোযোগের পক্ষপাতিত্ব (attentional bias), যেখানে মন কেবল নেতিবাচক দিকগুলোই খুঁজে বের করে।
ধরুন, একটি গ্রুপ প্রজেক্টে আপনি এবং আপনার দল একটি কঠিন সমস্যার সমাধান করেছেন। প্রজেক্টের শেষে আপনার বস পুরো দলের প্রশংসা করলেন এবং বিশেষ করে আপনার একটি নির্দিষ্ট দিক নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করলেন। কিন্তু তিনি হালকাভাবে আরেকটি ছোট বিষয়ে উন্নতির পরামর্শ দিলেন। একজন মানসিক ছাঁকনির শিকার ব্যক্তি এই প্রশংসা উপেক্ষা করে শুধু উন্নতির পরামর্শ নিয়েই আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারে।
হিপ্পোক্যাম্পাস মস্তিষ্কের একটি অংশ, যা স্মৃতি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত। হিপ্পোক্যাম্পাসের ক্ষতি বা অস্বাভাবিকতা স্মৃতিভ্রংশের কারণ হতে পারে, যা ব্যক্তিকে ভুল তথ্য বা বিকৃত স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করতে পারে।
মস্তিষ্কের রাসায়নিক যেমন-ডোপামিন, সেরোটোনিন ও নোরএপাইনফ্রিন আমাদের আবেগ, মেজাজ ও চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে। যদিও সিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রে ডোপামিনের অতিরিক্ত নিঃসরণের হাইপোথিসিস আছে, এটি সরাসরি সব বিভ্রান্তি ও বিকৃত চিন্তার কারণ নয়।
মস্তিষ্ক কেবল গঠনগতভাবে স্থির নয়, বরং পরিবর্তনশীল। বারবার একই ধরনের নেতিবাচক চিন্তা করলে মস্তিষ্ক সেই চিন্তার জন্য নতুন স্নায়ু পথ বা নিউরাল পাথওয়ে তৈরি করে, যা চিন্তাকে দৃঢ় করে। অর্থাৎ যদি একজন ব্যক্তি বারবার অতি সাধারণীকরণ করে, তবে তার মস্তিষ্কে একই ধরনের চিন্তার অভ্যাস তৈরি হতে পারে। এটি এক ধরনের স্ব-পুনর্বলক (self-reinforcing) প্রক্রিয়া, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানীয় বিকৃতিকে শক্তিশালী করতে পারে।
মস্তিষ্কের কাঠামো ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া আমাদের চিন্তা ও বাস্তবতার উপলব্ধিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। জ্ঞানীয় বিকৃতি কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এটি আমাদের মানসিক প্রতিরক্ষা ও অভ্যাসের ফল। তবে সচেতনতা, বিশ্লেষণ ও মানসিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই
বিকৃতিগুলোকে চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অর্থহীনতার মাঝেও অর্থ খোঁজার এই মানবিক প্রচেষ্টা আমাদের অস্তিত্বের গভীরতা ও জটিলতাকে তুলে ধরে।
