২০২০ সালের ডিসেম্বরে তাপমাত্রা নেমেছিল মাইনাস ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে
কল্পনা করুন, রাত নামতেই বাতাস হিম হয়ে ছুরি হয়ে গায়ে বিঁধছে। নিঃশ্বাস ফেলতে কুয়াশার ধোঁয়া, আর চারপাশে নীরব বরফের রাজ্য। এমন দৃশ্য বলতেই আমাদের মনে জাগে সাইবেরিয়া কিংবা আলাস্কার নাম। কিন্তু পৃথিবীর শীতলতম জনবসতিগুলোর তালিকায় ভারতেরই এক ছোট্ট জনপদ ‘ড্রাস’ ঠাঁই করে নিয়েছে। একে অনেকেই ডাকেন ‘ভারতের বরফের উপত্যকা’ বলে।
হিমালয়ের কোলে জমাটবাঁধা উপত্যকা
লাদাখের কারগিল জেলায়, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ৩০০ মিটার উঁচুতে, শ্রীনগর-লেহ সড়কের ধারে, উঁচু পাহাড়ঘেরা এক সরু উপত্যকায় স্থির হয়ে আছে ড্রাস। চারদিকের সুউচ্চ পর্বত যেন ঠান্ডা বাতাসকে আটকে রাখে, ফলে শীত এখানে জমে থাকে কারো ঘুমের মতো নয়, বরং শ্বাপদসম।
আরেকদিকে জোজিলা পাস দিয়ে ধেয়ে আসা বরফশীতল হাওয়া যেন শহরটিকে শীতের অনুশাসনে বশ মানিয়ে রাখে! স্থানীয়রা একে বলে, ‘লাদাখের দুয়ার’। কারণ এখানেই শুরু প্রকৃত লাদাখের কঠোরতা, সৌন্দর্য ও রোমাঞ্চ।
পৃথিবীর শীতলতম জনবসতিগুলোর তালিকায় আছে ভারতের এক ছোট্ট জনপদ ড্রাস
শীত যেন ছয় মাসের ঘন বরফের অবরোধ
ড্রাসে শীত শুরু হয় শরতের পরপরই। বরফ পড়তে থাকে, থামে না সহজে। মাঝ শীতের রাতগুলোতে তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের নিচে ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে। অনেক পুরোনো স্থানীয় রেকর্ডে দাবি আছে, কোনো কোনো সময় শূন্যের ৪০ ডিগ্রিরও নিচে নেমেছে পারদ! অনেকে বলেন, একসময় নাকি প্রায় মাইনাস ৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঠান্ডা নামার ঘটনা ঘটেছিল, যদিও সে তথ্য আধুনিক আবহাওয়া সংস্থার সূত্রে নিশ্চিত নয়। তবু একটা কথা অস্বীকার করা যায় না, ভারতের সবচেয়ে শীতল জনবসতি যে ড্রাস-এ বিষয়ে সংশয় নেই!
রোজকার বেঁচে থাকার সংগ্রাম
প্রশ্ন আসে, এমন ভয়ংকর ঠান্ডায় মানুষ থাকে কীভাবে? এখানকার ঘরবাড়ি সাধারণ নয়, পাহাড়ি পাথরের মোটা দেওয়াল, কাঠের নিরোধক, জানালায় মোটা কাপড়, নিচে বিশেষ মাটির সংরক্ষণ ব্যবস্থা। গবাদি পশু থাকে আলাদা উষ্ণ খোঁয়াড়ে। শীতের আগেই কাঠ, খাবার, পশুখাদ্য মজুত করতে হয়। রাতে হিম বাতাস বাড়লে পরিবারগুলো জড়ো হয়ে বসে কাঠের আগুনের পাশে। গরম খাবারের মধ্যে থাকে মাখন-চা, ডালজাতীয় পুষ্টিকর পদ, আর ঐতিহ্যবাহী উষ্ণ খাবার, যা কঠিন শীতেও শক্তি জোগায়।
ড্রাসে পৌঁছাতে হলে শ্রীনগর থেকে জোজিলা পাস পেরিয়ে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথে আসতে হবে। শীতে তুষারপাতের কারণে রাস্তা অনেক সময় বন্ধ থাকে, তাই অধিকাংশ পর্যটক মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আসে। শহরে ছোট গেস্টহাউস, হোমস্টে, কয়েকটি পর্যটক লজ ও খাবারের দোকান আছে। খাবারে থাকে পাহাড়ি রুটি, দুধ চা, ডাল, শুকনা মাংসসহ স্থানীয় উষ্ণ খাবার।
এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা পশুপালন, পর্যটন, সামান্য কৃষিকাজ, উলের পোশাক ও হস্তশিল্প বিক্রি। আর অনেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত। পর্যটকরা সাধারণত ড্রাস ভ্যালি, মানমান টপ, কারগিল ওয়ার মেমোরিয়াল, সুরু ভ্যালি ও বাজরাংড্রোম হিমবাহ দেখতে যায়। তবে শীতের সময় এখানে বেঁচে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ, বিদ্যুৎ সংযোগ ঘনঘন বিচ্ছিন্ন হয়।
কারগিল ওয়ার মেমোরিয়াল
কোন কোন মানুষ বাস করে এখানে
ড্রাসের মানুষ মূলত দুই জাতিগোষ্ঠীর-শিনা (সংখ্যায় ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ) এবং পুরিগ/বালতি (৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ)। মোট জনসংখ্যা ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ২১ হাজার ৯৮৮ জন। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। ধর্মীয় পরিচয়ে এখানকার ৯৯ শতাংশ মানুষ মুসলিম। শিনা জনগোষ্ঠী অধিকাংশ সুন্নি এবং পুরিগ-বালতি জনগোষ্ঠী শিয়া। কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত কিছু মানুষও বসবাস করে। এটিই লাদাখের একমাত্র এলাকা, যেখানে সুন্নি মুসলিম জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
অপরূপ, কঠোর, তবু মোহময়
গভীর শীত ড্রাসকে করে তোলে এমন এক ভূখণ্ড, যেন প্রকৃতি নিজের শক্তির পরিচয় দিতে জেগে ওঠে। বছরের অর্ধেক বরফাবদ্ধ এই শহর বসন্ত এলে এক অনন্য রূপে জেগে ওঠে। সবুজে সেজে ওঠে উপত্যকা, ফুল ফোটে আর বরফগলা ঝরনা নেমে আসে পাহাড় বেয়ে।
ইতিহাস ও যুদ্ধে ড্রাসের নাম
১৯৯৯ সালের কারগিল সংঘাত-এই নাম উচ্চারণ করলেই ড্রাসের কথা মনে পড়ে। যুদ্ধের দুর্বিষহ দিনগুলোতে ড্রাস ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধাঞ্চলগুলোর একটি। আজও রাস্তার পাশে কারগিল ওয়ার মেমোরিয়াল দাঁড়িয়ে আছে, ইতিহাসের পাতায় অমর এক অধ্যায়ের স্মারক হয়ে।
ড্রাসে শীত শুরু হয় শরতের পরেই
শেষ কথা-ভারতেও আছে ‘বরফের নরক’
শুধু পরিসংখ্যান নয়, ড্রাস মানুষের সহনশীলতার প্রতীক। এখানে শীত একটা ঋতু নয়, বরং জীবনের সঙ্গে লড়াই, অভ্যস্ততা, প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যে বেঁচে থাকার শিল্প। সাইবেরিয়ার ওইমিয়াকনের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় শীতলতম জনবসতিগুলোর আলোচনায় ড্রাসের নাম আজও জ্বলে ওঠে। যদিও আধুনিক আবহাওয়া তথ্য সেই দাবির পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয় না। কিন্তু যারা ড্রাসে শীত কাটিয়েছে, তাদের কাছে এটাই পৃথিবীর শেষ সীমানার মতো।
সূত্র : ইন্ডিয়া মেটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট (আইএমডি), উইকিমিডিয়া (উইকিপিডিয়া);
ডাউন টু আর্থ ম্যাগাজিন
