প্রতীকী ছবি
বয়ঃসন্ধি হলো শিশুর সঠিক বৃদ্ধি ও পেশি বিকাশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। যেখানে শিশুর শরীর প্রজনন সক্ষম করার জন্য পরিপক্ব হয়। এ সময় ছেলেমেয়ে উভয়েরই নানা শারীরিক, মানসিক, আবেগিক ও হরমোনজনিত পরিবর্তন ভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। বয়ঃসন্ধির সূচনা পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণ শুরু হয়। এই হরমোনগুলো শিশুর লিঙ্গের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন কাজ করে। ছেলেদের শারীরিক যে পরিবর্তনগুলো আসে তা প্রাপ্তবয়স্কদের দিকে পরিচালিত করে। সাধারণত ৯ থেকে ১৫ বছর বয়সে ছেলেরা বয়ঃসন্ধিতে প্রবেশ করে।
কেন এ সময় পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন
বয়ঃসন্ধিকালে খেলাধুলা, পড়াশোনা, মনোযোগ বৃদ্ধি ও শেখার দক্ষতা, পেশি বৃদ্ধি, হাড় শক্তিশালী করাসহ সবকিছু সঠিক সময়ে বিকাশে সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া সুষম পুষ্টিকর খাবার ভবিষ্যতে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো ক্রনিক রোগ যেমন-টাইপ-টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ নানা রোগের ঝুঁকি কমাতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
পুষ্টিকর খাবার বয়ঃসন্ধি বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় অতিরিক্ত এবং কম ওজন ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। অপুষ্টি, কম ক্যালরি, নিম্নমানের খাদ্যাভ্যাস-এসব কারণে তাদের বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। অস্টিওপেনিয়া, রক্তস্বল্পতা, ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। অভিভাবকদের খেয়াল করতে হবে তার সন্তান পড়াশোনায় মনোযোগ কেমন, খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছে কি না, অতিরিক্ত ক্লান্তি, ওজন ও উচ্চতা বিকাশ কেমন হচ্ছে। এসব বিষয়ে কোনো সমস্যা হলে দ্রুত পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অর্থ হলো পুষ্টির সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা, যেখানে খাবারের বৈচিত্র্যও থাকবে। এ সময় গোটা শস্য, ফল, শাক-সবজি, চর্বিহীন বা কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য, মটরশুটি, ডিম, মাছ, বাদাম এবং চর্বিহীন মাংসসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া প্রয়োজন। বয়ঃসন্ধিকালে একজন ছেলে কতটা ও কেমন খাবার খাবে, সে বিষয়ে পুষ্টিবিদ লিনা আকতার কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
ক্যালরি : ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের প্রতি পাউন্ড ওজনের জন্য প্রায় ১৩ থেকে ২৭ ক্যালরি প্রয়োজন। ক্যালরি হলো খাদ্যের মাধ্যমে সরবরাহ হওয়া শক্তি প্রকাশের পরিমাপ। ছেলেদের ১২ বছর বয়সে ক্ষুধা বৃদ্ধি বয়ঃসন্ধির ইঙ্গিত দেয়। জীবনের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বয়ঃসন্ধিকালে বেশি ক্যালরির প্রয়োজন হয়। ছেলেদের প্রতিদিন গড়ে ২৮০০ ক্যালরি প্রয়োজন।
প্রোটিন : প্রোটিন শারীরিক বৃদ্ধি, মেরামত ও শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া পেশি, ত্বক, চুল এমনকি মস্তিষ্কের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রোটিন। বয়সের ওপর নির্ভর করে প্রোটিন কতটা প্রয়োজন। সাধারণত ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সের ছেলেদের ৪২.১ গ্রাম এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সের ছেলেদের ৫৫.২ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন হয়। যদি প্রচুর খেলাধুলা বা পরিশ্রম করে তাহলে প্রোটিন আরো প্রয়োজন হতে পারে। প্রোটিনের উৎস হিসেবে ডিম, দুধ বা দই, মাংস, ডাল, বাদাম, বীজ, সয়াবিন খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে।
ফল ও সবজি : বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের (২০০০ ক্যালরি) ২ কাপ ফল এবং আধকাপ সবজি খাওয়া উচিত। ফল ও সবজি থেকে বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ ও ফাইটোকেমিক্যাল পাওয়া যায়, যা তাদের দ্রুত বিকাশ ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি : বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের ক্যালসিয়ামের চাহিদা ১৩০০ থেকে ১৫০০ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিন ডি ৬০০ থেকে ৮০০ আইইউ। হাড়ের ভর এবং পরবর্তী সময়ে অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে দুধ, পনির, দই, ডিম, বাদাম, চর্বিযুক্ত মাছ, ছোট কাঁটাযুক্ত মাছ, মাশরুম, ব্রকোলি খেতে হবে। এ ছাড়া যেসব খাবারে ক্যালসিয়াম বেশি আছে সয়াবিন, টোফু, ফরটিফায়েড সিরিয়াল, ফরটিফায়েড দুধ, কমলার রস, গুড়, ওটমিল, তাহিনী, বাদাম ও বাদামের মাখন, শালগম, সরিষা শাক, ছোলা, বিনস, শুকনো ডুমুর, পেঁপে ইত্যাদি। আর সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ডি আছে দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যে। ভিটামিন ডি একটি পুষ্টি, যা শরীর সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে উৎপন্ন হয় এবং পাচনতন্ত্রের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু খাবার থেকে ক্যালসিয়াম শোষণ করে। এটি শরীরকে অন্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম শোষণ করতে এবং হাড় শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
শক্তির জন্য শস্য : বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের প্রতিদিন ৬ আউন্স শস্যজাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। শস্য জাতীয় খাবার হলো চাল, গম, ভুট্টা ও আলু, যা আমাদের শরীরের শক্তির প্রধান উৎস। এই ধরনের খাবার থেকে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন বি এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়।
আয়রনসমৃদ্ধ খাবার : ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে ছেলেরা তাদের ওজনের দ্বিগুণ লম্বা হয়। ফলে এ সময় তাদের আয়রনের প্রয়োজন বেশি, যা প্রায় ১১ মিলিগ্রাম। আয়রনের ভালো উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে চর্বিহীন মাংস, কলিজা, মাছ, ডিম, শিম ও ডাল, সবুজ শাক-সবজি (পালং শাক, কলমি শাক ও কচুশাক), বাদাম ও বীজ, শুকনা ফল (খেজুর) এবং আয়রন-ফোর্টিফায়েড সিরিয়াল।
চর্বি : মোট ক্যালরির ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকর চর্বি রাখা উচিত এবং সম্পৃক্ত চর্বির চেয়ে অসম্পৃক্ত চর্বি বেছে নেওয়া উচিত। স্বাস্থ্যকর অসম্পৃক্ত চর্বির মধ্যে রয়েছে জলপাই তেল, বাদাম, বীজ, ভুট্টা, সূর্যমুখী, টুনা, ঠান্ডা পানির মাছ ইত্যাদি। এ ছাড়া তৈলাক্ত মাছ সপ্তাহে দুই দিন খাওয়া উচিত। এতে রয়েছে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, যা মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য উপকারী।
তরল খাবার : এ সময়ে পর্যাপ্ত পানির চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ এ সময় তারা খেলাধুলা করে এবং পড়াশোনার চাপে থাকে। ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সে কিশোরদের জন্য ২.৪ লিটার পানি প্রয়োজন। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সে ছেলেদের ৩.৩ লিটার পানির চাহিদা থাকে। পানি ছাড়াও তারা ফলের রস, দুধ, স্যুপ ইত্যাদি তরল খাবার খেতে পারে। তবে অস্বাস্থ্যকর কার্বোনেটেড ড্রিংকস, জুস খাওয়া যাবে না।
