Logo
×

Follow Us

ফিচার

পৃথিবী রক্ষার নামে করপোরেট প্রতারণা

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৫৪

পৃথিবী রক্ষার নামে করপোরেট প্রতারণা

প্রতীকী ছবি

আজকাল প্রায় সব কোম্পানির বিজ্ঞাপন, প্যাকেজিং বা পাবলিক মেসেজে পরিবেশবান্ধব, টেকসই বা সবুজ-শব্দগুলো খুব পরিচিত হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞাপন আর চকচকে ক্যাম্পেইনের আড়ালে বড় বড় কোম্পানিগুলো একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের পরিবেশবান্ধব হিসেবে তুলে ধরছে, যেন তারাই পৃথিবী বাঁচানোর সবচেয়ে বড় যোদ্ধা। কিন্তু এই সবুজের আড়ালে কি সত্যিই পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা লুকিয়ে আছে, নাকি পুরোটাই লোকদেখানো? তবে এই প্রবণতার একটি বিশেষ নাম আছে, ‘গ্রিনওয়াশিং’। 

গ্রিনওয়াশিং আসলে কী?

গ্রিনওয়াশিং হলো এমন একটি কৌশল, যেখানে একটি কোম্পানি বিজ্ঞাপন এবং বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে নিজেদের পরিবেশগতভাবে টেকসই ও ‘সবুজ’ হিসেবে তুলে ধরে, অথচ বাস্তবে তাদের দাবিগুলো সঠিক নয়। এই কৌশল কিছু কোম্পানি ব্যবহার করে গ্রাহকদের আসল সত্য থেকে দূরে রাখতে। অর্থাৎ তাদের ব্যাবসায়িক মডেল ও কার্যক্রম আসলে পরিবেশের অনেক ক্ষতি ও দূষণ করছে, সেই দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতেই এই ‘সবুজ’ প্রলেপ দেওয়া হয়।

কেন এটা গুরুতর সমস্যা

প্রথমত, এতে ভোক্তারা প্রতারিত হন। আমরা ভাবি, ইকো, গ্রিন, সাসটেইনেবল লেখা বোতল বা প্যাকেট কিনে ভালো কিছু করছি। কিন্তু বাস্তবে হয়তো সেই পণ্য তৈরিতেই নদী দূষিত হচ্ছে বা বায়ুমণ্ডলে ছড়াচ্ছে বিপুল কার্বন।

সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, গ্রিনওয়াশিং বাস্তব সমাধানকে ধীর করে দেয়। আমরা যদি মিথ্যা প্রচারণায় বিশ্বাস করি, তাহলে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং অপ্রয়োজনীয় প্লাস্টিক উৎপাদন কমানোর মতো জরুরি পদক্ষেপগুলো ঢাকা পড়ে যায়। এর আরেকটি বড় কারণ হলো, সাধারণ ভোক্তারা সঠিক তথ্য পান না। বোতলজাত পানীয় থেকে শুরু করে এয়ার ট্রাভেল, কোন পণ্যটি কিনবেন, সেই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তারা ভুল করেন।

কোম্পানিগুলো কেন এই প্রতারণা করে

কোম্পানিগুলো তাদের সুনাম রক্ষা এবং ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা বিজ্ঞাপনে খরচ করে। এর মাধ্যমে তারা সমাজের কাছে তাদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রমের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে চায়। তারা গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে এবং প্রায়ই সরকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ মহলে নিজেদের সমর্থক তৈরি করতে এই কৌশল ব্যবহার করে, যাতে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে।

কোথায় বেশি দেখা যায় এই প্রতারণা

গত কয়েক বছরে তেল ও গ্যাস খাতে, বিশেষ করে গ্যাস কোম্পানিগুলোর মধ্যে গ্রিনওয়াশিংয়ের প্রবণতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প ৩০ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তন রোধের পদক্ষেপগুলোকে ধীর করার জন্য একটি সুপরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত অভিযান চালাচ্ছে, আর গ্রিনওয়াশিং তারই অংশ।

আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো প্লাস্টিক এবং প্যাকেজিং শিল্প। সম্প্রতি প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ফলে সুপারমার্কেট এবং অন্যান্য ফাস্ট-গুডস কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যগুলোকে যতটা সম্ভব ‘সবুজ’ দেখানোর চেষ্টা করছে।

বিভিন্ন পণ্যের জন্য অনেক ব্র্যান্ড এখন পরিবেশ নিয়ে ভোক্তাদের উদ্বেগকে কাজে লাগাচ্ছে এবং পণ্য বিক্রি করতে আরো বেশি ‘সবুজ’ বিজ্ঞাপন ব্যবহার করছে। এর অর্থ এই নয় যে, একটি কোম্পানির প্রতিটি ‘সবুজ’ দাবিই ভুল বা বিভ্রান্তিকর, তবে তাদের দাবি করা অনেক তথ্যই বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।

কীভাবে বুঝবেন কেউ ‘গ্রিনওয়াশিং’ করছে

ব্র্যান্ডগুলো অনেক সহজ উপায়ে গ্রিনওয়াশিং করে, যেমন তাদের পণ্যের প্যাকেজিংয়ের নকশা। 

সবুজ ছবি ও ফন্ট ব্যবহার করা, অথবা ‘প্রাকৃতিক’ দেখতে প্যাকেজিং ব্যবহার করা। এ রকম সহজ কৌশলগুলো দেখে অনেক ভোক্তা প্রভাবিত হন এবং সেই পণ্য বেশি দামে কিনতেও রাজি হন। পণ্যগুলোকে প্রায়ই ‘ইকো’ বা ‘টেকসই’ বলা হয়, অথচ এই শব্দগুলোর কোনো বাস্তব অর্থ থাকে না। যদিও এই ধরনের দাবির জন্য কিছু নির্দেশিকা আছে, তবে সেগুলো প্রায়ই মানা হয় না। যেকোনো দোকানে বা বিলবোর্ডে তাকালেই দেখবেন, অনেক পণ্য এভাবে ‘সবুজ’ বাজার ধরতে চাইছে।

একটি উদাহরণ

২০১৯ সালে তেল কোম্পানি ‘ইচ’ একটি প্রচারণা চালায় ‘চড়ংংরনরষরঃরবং ঊাবৎুযিবৎব’। সেখানে তারা নিজেদের নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের গল্প শোনায়। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, তাদের মোট ব্যয়ের ৯৬ শতাংশ এখনো তেল ও গ্যাসে! পরিবেশবাদী সংস্থা ঈষরবহঃঊধৎঃয এই বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করে।

সমাধান কী হতে পারে

আমরা বিশ্বাস করি যে, সব বিজ্ঞাপনের সঠিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন এবং বিদ্যমান আইনগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। যেমনÑতামাকের প্যাকেটে সতর্কবার্তা থাকে, তেমনভাবে তেল ও গ্যাস কোম্পানির বিজ্ঞাপনেও থাকতে হবে ‘জলবায়ুর জন্য বিপজ্জনক’ সতর্কবার্তা। এতে মানুষ যেমন সচেতন হবে, তেমনি ভুয়া সবুজ প্রচারণার মুখোশও খুলে যাবে।

এই ধরনের সতর্কীকরণ লেবেল সাধারণ মানুষকে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে শিক্ষিত করতে সাহায্য করবে। আমরা যখন ভাবি ‘সবুজ পণ্য কিনে ভালো কাজ করছি’, তখনই কোনো না কোনো করপোরেট জায়ান্ট সেই সচেতনতার সুযোগ নিচ্ছে। তাই এখন সময় প্রশ্ন করার, সবুজ রংটা আসলেই কি সবুজ, নাকি কেবল রঙের প্রলেপ।


সূত্র :  ক্লায়েন্ট আর্থ

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫