শৈশবে মদন মোহন তর্কালঙ্কারের লেখা ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল’ কবিতাটি শোনেননি এমন মানুষ কম। একইভাবে দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের ‘পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি পাখির ডাকে জেগে।’ গান, কবিতায় এমন অজস্র অনুষঙ্গ খুঁজলে পাওয়া যাবে। আশির দশকেও পাখির এই আধিক্য সারা দেশেই ছিল। বিশেষত গ্রামের কৃষক রাতের সময়কাল নির্ধারণ করত বাজ পাখির ডাকে। প্রহরে প্রহরে বাজ পাখির ডাক ছিল ‘ন্যাচারাল ঘড়ি।’ শৈশবেও পাখির ডাকে ঘুম ভাঙার বা বিকেলে গাছগাছালিতে পাখির আশ্রয় নেওয়ার সময়ের যে শব্দ তা যেকোনো অর্কেস্ট্রাকে হার মানাবে। সেই দিন এখন আর নেই। এখন আর আগের মতো পাখির ডাকে অনেকের ঘুম ভাঙে না। গাছের ডালে বসে ক্লান্ত দুপুরে শিস দেয় না ফিঙে, ময়না, টিয়াসহ নানা প্রজাতির পাখি। বিল বা পুকুরে শাপলা পাতার উপর ভর করে মাছের প্রতীক্ষা করে না বুচি বক। পুকুরে পানকৌড়ির ডুবোডুবি বা মাছরাঙার শিকারের প্রতীক্ষা আর চোখে পড়ে না। ‘কাকডাকা ভোর’ শব্দটিও এখন শোনা যায় না।
এই ধান, গান, পাখপাখালির দেশ থেকে কোথায় গেল সব পাখি? ঢাকার কাক এখন সেভাবে দেখা যায় না, জাতীয় পাখি দোয়েলও প্রায় নিরুদ্দেশ। পাখি কমে যাওয়ার কারণ সম্প্রতি ব্যাখ্যা করেছে পাখি গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের এ ব্যাখ্যা শুনলে বিস্মিত হতে হবে। তারা বলছেন, গত ৩০ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে ভয়ংকরভাবে কমছে পাখির সংখ্যা। গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের পাখি জরিপ ও গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক। পাখি গণনার কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘৩০ বছরে পাখি কীভাবে কমেছে সেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ৩০ বছর আগে যেখানে একটি হাওর এলাকায় আমরা ছয় লাখ পাখি পেয়েছিলাম। এ বছর একই সময় সেখানে গুনে পেয়েছি মাত্র এক লাখ পাখি।’ এটা শুধু একটা হাওর বা নির্দিষ্ট এলাকার চিত্র না।
দেশের এমনও অনেক জলাশয় রয়েছে, যেখানে একসময় লক্ষাধিক পাখি দেখা যেত, এখন সেখানে মাত্র ৪০-৫০টি পাখি পাওয়া যাচ্ছে। গবেষক ও পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাখি কমছে এশিয়া মহাদেশে। এশিয়ার মধ্যে পাখি কমছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়। আর এর মধ্যেই এই হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। জলজ পাখি ছাড়া অন্য পাখি গণনা, জরিপ বা পরিসংখ্যান হয়নি বাংলাদেশে। তবে বেশ কিছু তথ্য ও কারণ উল্লেখ করে তারা বলছেন, দেশে জলজ পাখির পাশাপাশি কমছে শহর ও গ্রামের বনাঞ্চলে থাকা নানা জাতের পাখি। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন, অব্যাহত উন্নয়নের ফলে পাখির আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাওয়া ও কৃষিকাজে রাসায়নিক দ্রব্য বিষ ব্যবহারের ফলে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে পাখি।
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন আইইউসিএনের কর্মকর্তা ও পাখি বিশেষজ্ঞ সারোয়ার আলম দীপু বলেছেন, ‘গত ২২ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুধু টাঙ্গুয়ার হাওরেই ৫৯ শতাংশ পাখি কমে গেছে।’ প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন আইইউসিএন সর্বশেষ পাখি নিয়ে জরিপ করেছে ২০১৫ সালে। সে সময়ের জরিপে বাংলাদেশে ৬৫০ প্রজাতির অস্তিত্ব খুঁজে পায় সংস্থাটি। আইইউসিএন বলছে, এসব পাখির ১০০ বছরের মধ্যে ১৯ প্রজাতির পাখি চিরতরে হারিয়ে গেছে।
আমরা লক্ষ করেছি, দেশে কাঠামোগত উন্নয়নের নামে যেভাবে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, এটা পুরোপুরি অপরিকল্পিতভাবে। এই সড়ক করার ফলে আমাদের প্রাণ-প্রকৃতি এখন হুমকির মুখে পড়েছে। সড়ক নির্মাণের ফলে গ্রাম অবধি গাড়ি, কালো পিচঢালা সড়ক হয়েছে। গ্রামের গ্রাম্যতা ভেঙেচুড়ে শহুরে কালচার ঢুকানো হয়েছে। ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতি, আঞ্চলিক ভাষা থেকে পর্ব ও পার্বন একদম হারিয়ে যাওয়ার পথে। সড়ক নির্মাণের ফলে আমাদের জল-জংলার দেশের হাওর-বাঁওড়-নদী খাল ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে।
জনসংখ্যা বাড়ার ফলে উষর বিলে নির্মাণ হচ্ছে গ্রাম। জমি কমে যাওয়ায় অল্প জায়গায় বেশি ফসল ফলানোর জন্য দেশে ঢুকেছে হাইব্রিড ফসল। এসব ফসল একবার ফলার পরে জমি এত ফলনে অপারগ হয়, কমে যায় তার উর্বরতা। উর্বরতা বাড়াতে প্রয়োগ করা হয় সার। আর কীট-পতঙ্গ দমনে ব্যবহার করা হয় তীব্র বিষ। এই সার ও বিষ বর্ষার জলে মিশে ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। এই পানি পান করে নিঃশেষ হচ্ছে পাখিসহ
বন-বনানীর বিভিন্ন প্রাণী। এ ছাড়া জলাশয়, বন-বনানী ধ্বংস হওয়া পাখির আশ্রয় কেন্দ্র আর আগের মতো নেই। ফলে জলজ পাখি যেমন কমছে, সঙ্গে অন্যান্য জাতের পাখিও কমে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জের হাওরে ১৯৯৩-৯৪ সালে পাখি গণনায় এই বিলে চার লাখ পাখি পাওয়ার রেকর্ড আছে। সেটা এখন গিয়ে নেমেছে মাত্র ৪০টি পাখিতে। পাখি কমে যাওয়ার এই চিত্র নিঃসন্দেহে শঙ্কার বিষয়। একইভাবে উপকূলীয় জেলা ভোলা, পটুয়াখালী, শনির হাওরসহ বিভিন্ন বিলে থাকা পাখির সংখ্যা দিন দিন কমছে।
১০ বছর আগেও যে ঢাকা কিংবা সারা দেশে যে পরিমাণ পাখি দেখা যেত, তা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। প্রজাতি বিলুপ্ত না হলেও অনেকাংশেই কমেছে পাখির সংখ্যা। একটা সময় রাজধানী ঢাকায় নিয়মিত পাখির ডাক শোনা যেত। শহরের আনাচকানাচে শালিক, কাক, চুড়ুইসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি লক্ষ করা যেত। কিন্তু বাসস্থান, খাদ্যের সংকট এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ নানা কারণে কাকসহ অনেক প্রাণীই ঢাকা শহর থেকে বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক চক্র বা বাস্তুসংস্থান বিপন্ন হয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকা শহর থেকে যে পাখি কমছে, সেটা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। নেই কোনো গবেষণাও। তবে ঢাকার কাক নিয়ে দুই ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে গবেষকদের কথায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ১০ বছর আগেও ঢাকায় পাখির যে সংখ্যা দেখা যেত তা নেই। কাকের সংখ্যা এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। নগরীতে যে পরিমাণ কাক সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনের কাছে দেখা যেত এখন তা আশঙ্কাজনক হারে কমে কমে গেছে। কোনো কোনো পাখি গবেষকের ধারণা, এভিয়ান ফ্লু বা বার্ড ফ্লু ভাইরাসের কারণে গত কয়েক বছরে রাজধানী ঢাকার অনেক কাক বিলুপ্তির পথে।
আবার খাদ্য ও বাসস্থানের কারণেও অনেক কাক হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন অনেক গবেষক। কাক-চিল-কোকিলসহ বিভিন্ন পাখি তাদের বাসা তৈরি করে বড় বড় পুরোনো সব গাছে। বৃক্ষ ও খাদ্য সংকট প্রকট হয়ে দাঁড়ানোর কারণে কমছে কাক কিংবা চিল, শালিক, ফিঙ্গে, দোয়েলসহ নানা জাতীয় পাখির সংখ্যা। বার্ডস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলাদেশের পাখি জরিপকারী ইনাম আল হক পাখি কমার পেছনে দুটি কারণ চিহ্নিত করেন।
তার মতে, এই অঞ্চলে উন্নয়নের ফলে পতিত জমি, জলাধার ও বনাঞ্চল কমেছে। অন্যদিকে কৃষিকাজে বিষ ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের ফলে পাখি কমছে দিন দিন। যত উন্নয়ন হবে মানুষের জমির ওপর চাপ পড়বে। জমি নিয়ে আবাস গড়লে পাখির আবাস কমবে-এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া আমরা বিষ প্রয়োগ করে ফসল ফলাচ্ছি, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করছি, তাতে পাখিরাও উৎখাত হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে বর্তমানে দেশি হাঁস পালন শুরু হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে। অন্যদিকে গো-চারণ ভূমি হিসেবে হাওর অঞ্চলকে ব্যবহার করার প্রভাব পড়ছে পাখির ওপর। এ ছাড়াও আমাদের দেশে জলাভূমির সংখ্যা মারাত্মক হারে হ্রাস পাচ্ছে। একই সঙ্গে কমছে গভীরতাও-এসব কারণেই কমে যাচ্ছে পাখি। এরপর পাখি শিকার তো আছেই। মানুষ পাখি শিকারে দ্বিধা করে না। বিষ দিয়ে পাখি শিকারের নজিরও রয়েছে। এসব শিকারের পাখি কারা খায়? দেশের বড় বড় মানুষের ডাইনিং টেবিলে শোভা পায় এসব পাখির মাংস। শিকারি ও খাদক দুই-ই এর জন্য সমান দায়ী। যে পর্যন্ত মানুষের নিঃশ্বাস নিতে প্রাণ-প্রকৃতি কত দরকারি-এ ধারণা পৌঁছবে না, সে পর্যন্ত পাখি ও প্রকৃতির শুশ্রƒষাও যে দরকার এটাও মানুষ বুঝবে না। এ জন্য সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
