Logo
×

Follow Us

ফিচার

মানবাকৃতির রোবটের শ্রমবাজারে প্রবেশ শুরু

Icon

মো. ইমরানুর রহমান

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:৫২

মানবাকৃতির রোবটের শ্রমবাজারে প্রবেশ শুরু

প্রতীকী ছবি

একসময় বিজ্ঞান কল্পকাহিনির পাতায়, চলচ্চিত্রে বা গবেষণাগারের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকা মানবাকৃতির (হিউম্যানয়েড) রোবট আজ বাস্তবজীবনে শ্রমিকের মতো কাজ শুরু করেছে। মানুষের মতো হাঁটে, বস্তু তুলতে পারে, দরজা খোলে, ভার বহন করে, এমনকি উৎপাদন লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজও করে-এমন রোবট এখন শত শত সংখ্যায় শিল্প-কারখানায় মোতায়েন করা হচ্ছে।

ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চীনা রোবট নির্মাতা ইউবি-টেক রোবোটিকস। ২০২৫ সালের শেষে এসে প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চিত করেছে যে তাদের সর্বাধুনিক হিউম্যানয়েড রোবট ওয়াকার এসটুর শতাধিক ইউনিট এরই মধ্যে চীনের বিভিন্ন অটোমোবাইল কারখানা, গুদাম ও অ্যাসেম্বলি লাইনে কাজ করছে। এই ঘোষণা বিশ্বব্যাপী শ্রমবাজারে মানুষের সঙ্গে রোবটের সহাবস্থানের নতুন অধ্যায়কে সামনে নিয়ে এসেছে।

ইউবি-টেক জানিয়েছে, তারা মধ্য নভেম্বর থেকে উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি করেছে এবং শুধু ২০২৫ সালেই কোম্পানিটি ৮০ কোটি ইউয়ান (১১ কোটি ৩০ লাখ ডলার) মূল্যের অর্ডার পেয়েছে। 

মানবাকৃতির রোবটের জন্য এটিকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সংকেত হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই অর্ডারগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি শীর্ষ চীনা প্রতিষ্ঠানের ২৫ কোটি ইউয়ানের অর্ডার, সিচুয়ানের একটি কোম্পানির ১৫ কোটি ৯০ লাখ ইউয়ান, গুয়াংশির একটি প্রকল্পের ১২ কোটি ৬০ লাখ ইউয়ান ও হুবেইয়ের একটি কোম্পানির ১০ কোটি ইউয়ানের চুক্তি।

কোম্পানির পরিকল্পনা অনুযায়ী, ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ ৫০০টি ওয়াকার এসটু রোবট শিল্পক্ষেত্রে সরবরাহ করা হবে এবং তারা বলছে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন প্রায় নিশ্চিত। ওয়াকার এসটুর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো, এর স্বয়ংক্রিয় ব্যাটারি-স্ব্যাপিং সিস্টেম, যা রোবটকে বিরতিহীন ২৪ ঘণ্টা কাজের সক্ষমতা দেয়। রোবট নিজেই ব্যাটারি খুলে নতুন ব্যাটারি লাগাতে পারে, কোনো মানবসাহায্য ছাড়াই। এর মানবসদৃশ জয়েন্টগুলো ভার বহন, স্ক্রু লাগানো, সূক্ষ্ম হ্যান্ডলিং এবং গুদাম পরিবহনের মতো কার্যক্রম মানুষের গতিশীলতা অনুসরণ করে সম্পন্ন করতে সক্ষম।

শিল্পমালিকরা বলছেন, এই রোবটগুলো শুধু শ্রম বিকল্প নয়, বরং উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ভবিষ্যৎ অবকাঠামো। মানবাকৃতির রোবটের দ্রুত বাণিজ্যিক সাফল্য একে এখন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে দাঁড় করিয়েছে। টেসলার অপটিমাস, অ্যাজিলিটি রোবোটিকসের ডিজিট কিংবা ফিগার কোম্পানির ফিগার জিরোওয়ান-সবাই নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

ইলন মাস্ক দাবি করছেন, অপটিমাস ভবিষ্যতের উৎপাদন শিল্পের স্থায়ী কর্মী হয়ে উঠবে, যদিও এখনো এটি মূলত পরীক্ষামূলক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। অ্যামাজনের গুদামে ডিজিট পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও বাণিজ্যিক স্থাপন সীমিত, আর ফিগার জিরোওয়ান মানুষের মতো ব্যাখ্যা-ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে, যদিও বড় স্কেলে স্থাপন এখনো হয়নি।

তুলনামূলকভাবে ইউবি-টেকই প্রথম দেখাতে পেরেছে, মানবাকৃতির রোবট শুধু ল্যাব ডেমো নয়, বরং পুরো শিল্পপ্রক্রিয়ার কার্যকর অংশ হতে পারে। শ্রম সংকট, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং ঝুঁকিপূর্ণ পুনরাবৃত্তিমূলক কাজের চাপ বাড়ার কারণে বিশ্বজুড়ে শিল্প-কারখানাগুলো রোবটে ঝুঁকছে। মানবাকৃতির রোবটের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, মানুষের মতো চলাফেরা করতে পারায় বিদ্যমান কারখানার নকশা পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। কোনো কর্মী বদল নেই, ছুটি নেই, আঘাত বা শিফট পরিবর্তনেরও দরকার পড়ে না।

তাপ, শব্দ বা গ্যাসযুক্ত পরিবেশেও রোবটগুলো স্থিতিশীলভাবে কাজ করতে পারে এবং ধারাবাহিক মান বজায় রাখে। তাই ফক্সকন, বিওয়াইডি, গিলি, ডংফ্যাংয়ের মতো প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে এসব রোবট স্থাপনে এগিয়ে এসেছে। বৈশ্বিক শ্রমবাজারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখন-এই রোবট কি মানুষের চাকরি কেড়ে নেবে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের চাকরি হারানো নয়, বরং কাজের ধরন বদলে যাওয়াই বড় বাস্তবতা। বিপজ্জনক, একঘেয়ে ও শ্রমঘন কাজ রোবট করবে এবং মানুষ যাবে নজরদারি, ডিজাইন, কন্ট্রোল ও উচ্চ-প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার মতো দায়িত্বে। দক্ষতার প্রয়োজন দ্রুত বদলাবে, তাই বিভিন্ন দেশে রি-স্কিলিং অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ছে। যেসব দেশ দ্রুত নীতি গ্রহণ করতে পারবে, তারাই পরবর্তী শিল্পবিপ্লবে এগিয়ে থাকবে।

গবেষণা বলছে, আগামী ১০ বছরে মানবাকৃতির রোবট শিল্পের মূল্য ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। উৎপাদন শিল্পে বিপ্লব, শ্রম খরচের পুনর্গঠন,রোবট-অর্থনীতি সৃষ্টি এবং এআই-ভিত্তিক শ্রম ব্যবস্থাপনার প্রসার, সব মিলিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি রোবটকেন্দ্রিক নতুন বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করা রোবট আর ভবিষ্যৎ নয়, বরং এটাই বর্তমান। বিজ্ঞান কল্পকাহিনি থেকে বাস্তবে আসতে মানবাকৃতির রোবটের সময় লেগেছে কয়েক দশক। কিন্তু শিল্প-কারখানায় তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে এত সময় লাগছে না।

ইউবি-টেকের ওয়াকার এসটু দেখিয়ে দিয়েছে, মানুষকে নকল করা নয়, বরং মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার জন্যই ভবিষ্যতের রোবট তৈরি হচ্ছে। বিশ্বের শ্রমবাজারে শুরু হয়েছে এক নতুন অধ্যায়, যেখানে রোবট শুধু যন্ত্র নয়, বরং কর্মক্ষেত্রের নতুন সহকর্মী।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫