Logo
×

Follow Us

ফিচার

সৈকতের বালিতে পারমাণবিক শক্তি

Icon

রফিকুর রহমান প্রিয়াম

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১১:০৭

সৈকতের বালিতে পারমাণবিক শক্তি

জিরকন

কক্সবাজারের যে ঝলমলে বালুকাবেলায় প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ পর্যটক খালি পায়ে হেঁটে বেড়ায়, সেই বালির নিচেই লুকিয়ে আছে এক গোপন শক্তি। অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যি, বাংলাদেশের এই সমুদ্রসৈকত এক অমূল্য পারমাণবিক সম্পদের ভান্ডার। এই বালুকণায় মিশে আছে দুটি বিরল তেজস্ক্রিয় উপাদান, থোরিয়াম ও ইউরেনিয়াম।  

বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের (বিএইসি) বিজ্ঞানীরা চার দশক ধরে এই সম্পদ নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা নিশ্চিত করেছেন, এই পারমাণবিক উপাদানগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নেই, বরং এগুলো ‘মোনাজাইট’ ও ‘জিরকন’ নামক দুটি ভারী খনিজের ভেতরে শক্তভাবে আবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।

                                              মোনাজাইট

কী পরিমাণ সম্পদ লুকিয়ে আছে?

গবেষকরা দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত, মোট ১৭টি এমন খনিজ ভান্ডার চিহ্নিত করেছেন। হিসাব করে দেখা গেছে, এই ভান্ডারগুলোতে সব মিলিয়ে প্রায় ১৭ লাখ ৬০ হাজার টন অর্থনৈতিকভাবে মূল্যবান খনিজ মজুত রয়েছে।

এর মধ্যে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পদ হলো :

মোনাজাইট (থোরিয়ামের প্রধান উৎস) : ১৭,০০০ টন  

জিরকন (ইউরেনিয়ামের উৎস) : ১,৫৮,০০০ টন  

পরিমাণ যা-ই হোক, এই খনিজগুলোর উপস্থিতিই বাংলাদেশকে বিশ্বের পারমাণবিক মানচিত্রে একটি বিশেষ স্থান দিয়েছে।

অদ্ভুত বৈপরীত্য : দেশে আছে থোরিয়াম, আমরা কিনছি ইউরেনিয়াম

এই বিপুল সম্পদের আবিষ্কার এক অদ্ভুত, কিন্তু বাস্তবচিত্র তৈরি করেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত এই কেন্দ্রটি চলবে ইউরেনিয়াম জ্বালানিতে, যা আমাদের পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে।  

অথচ, আমাদের দেশের মাটির নিচে যে পারমাণবিক সম্পদ (মোনাজাইট) মজুত আছে, তা হলো থোরিয়াম। আশ্চর্যের বিষয় হলো, রূপপুরের বর্তমান চুল্লিতে এই থোরিয়াম জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। থোরিয়াম হলো ভবিষ্যতের জ্বালানি; আমাদের প্রতিবেশী ভারত ও চীন এই থোরিয়ামভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে।  

সহজ কথায়, আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাচ্ছি এক জ্বালানির, আর আমাদের ঘরে পড়ে আছে আরেক জ্বালানির বিশাল ভান্ডার।

৪০ বছর ধরে বালির নিচে কেন এই অমূল্য রত্ন?

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এত মূল্যবান সম্পদ থাকতেও কেন গত ৪০ বছরে তা উত্তোলন করা হলো না? অনেকে মনে করেন, এই খনিজ হয়তো লাভজনক নয় বা এ নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। কিন্তু আসল কারণটি অর্থনৈতিক নয়, বরং সম্পূর্ণ কৌশলগত ও আইনগত।

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের ‘রপ্তানি নীতি ২০২১-২৪’ অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের ‘তেজস্ক্রিয় পদার্থ’ দেশ থেকে রপ্তানি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যেহেতু মোনাজাইট (থোরিয়াম) এবং জিরকন (ইউরেনিয়াম) উভয়ই তেজস্ক্রিয় খনিজ, তাই এগুলো চাইলেই কোনো কোম্পানি বিদেশে বিক্রি করতে পারবে না।  

বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন (বিএইসি) কেবল এই সম্পদের আবিষ্কারকই নয়, দেশের সংবিধান অনুযায়ী পারমাণবিক উপাদানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ও রক্ষকও তারা। ফলে এই সম্পদ উত্তোলনের পথে মূল বাধাটি হলো আইনের এই অদৃশ্য দেওয়াল।  

গল্পে নতুন মোড় : বেসরকারি খাতের প্রবেশ

সম্প্রতি এই দীর্ঘ অচলাবস্থার গল্পে নতুন এক মোড় এসেছে। এভারলাস্ট মিনারেলস নামক একটি অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেড (ASX: EV8) ২০২৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে খনিজ উত্তোলনের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।  

তবে তারা কক্সবাজারের সৈকতে নয়, বরং গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর চরে জমে থাকা বালির মধ্যে খনিজ অনুসন্ধান করবে। মজার ব্যাপার হলো, তাদের উত্তোলনের লক্ষ্যবস্তুর তালিকায় এই কৌশলগত খনিজ ‘মোনাজাইট’-এর নামও রয়েছে।  

এতেই তৈরি হয়েছে নতুন এক জটিল প্রশ্ন। যদি তেজস্ক্রিয় খনিজ রপ্তানি করাই নিষিদ্ধ হয়, তবে একটি বিদেশি কোম্পানি কেন এটি উত্তোলনে আগ্রহী হলো? তাদের লাভ কী?  

বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এর সমাধান একটিই হতে পারে। কোম্পানিটি হয়তো বালির মধ্যে থাকা অন্যান্য সাধারণ খনিজ (যেমন-ইলমেনাইট বা গারনেট) রপ্তানি করার অনুমতি পাবে। কিন্তু চুক্তির শর্ত হিসেবে, খনি থেকে পাওয়া সব তেজস্ক্রিয় ও কৌশলগত খনিজ (মোনাজাইট ও জিরকন) বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের (বিএইসি) হাতে তুলে দিতে হবে।

ভবিষ্যতের জ্বালানি আমানত

এই বিশ্লেষণ আমাদের একটি পরিষ্কার সিদ্ধান্তে নিয়ে আসে। সৈকতে পড়ে থাকা এই ১৭ হাজার টন মোনাজাইট কোনো ব্যর্থ অর্থনৈতিক প্রকল্প নয়; এটি বাংলাদেশের একটি ‘জাতীয় কৌশলগত আমানত’।

রূপপুর কেন্দ্র হয়তো আমদানীকৃত জ্বালানি দিয়ে আমাদের আজকের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাবে, কিন্তু ৫০ বছর পর যখন এই জ্বালানির নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে থাকবে না, তখন এই সৈকতের বালিতে লুকিয়ে থাকা থোরিয়ামই হতে পারে বাংলাদেশের প্রকৃত জ্বালানি স্বাধীনতার চাবিকাঠি। এই বালুকণা শুধু সৈকতের সৌন্দর্য নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যতের শক্তির এক নীরব ভাণ্ডার।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫