আন্দিজ পর্বতমালার বুক চিরে উঠে যাওয়া রেললাইন ধরে ট্রেন গালেরা স্টেশনে পৌঁছায়
পৃথিবীর নিচু সমতলভূমি পেরিয়ে যখন রেলগাড়ি উঠে যায় মেঘের মাথার ওপরে, তখন মনে হয় যেন ধাতব এক ড্রাগন আছড়ে পড়ছে আকাশের দোরগোড়ায়। বাতাস পাতলা হয়ে আসে, কানে চাপ ধরে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তবু জানালার বাইরে তুষার ঢাকা পর্বত, তামাটে উচ্চভূমি আর আকাশের নীরবতা দেখে মনে হয় এ যেন রোমাঞ্চের অন্য রাজ্য। রেলপথ যেখানে মানুষের উপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ করে, প্রকৃতি যেখানে প্রতিটি সেতু আর টানেলকে ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়, সেসব জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পাঁচ রেলস্টেশন।
তাং-গুলা (তিব্বত, চীন) ৫,০৬৮ মিটার
মেঘের ওপর ভেসে থাকা এক নির্জন প্ল্যাটফর্ম-এটাই তিব্বতের তাং-গুলা রেলওয়ে স্টেশন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেলস্টেশন। এর উচ্চতা এমন, এখানে দাঁড়ালে প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন খরচ হয়ে যায় পাহাড়ের কাছে। জমাট হাওয়া, তীব্র ঠান্ডা আর অক্সিজেনের স্বল্পতায় মানুষের শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই এই পথে চলা বিশেষ ট্রেনে থাকে অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা। চারদিকে শুকনো ধূসর মালভূমি, দূরে বরফের রেখা, আর মাথার ওপর রুক্ষ আকাশ-সব মিলিয়ে স্টেশনটিকে আরো রহস্যময় করে তোলে। কোনো জনবসতি নেই, দোকান নেই, কোলাহল নেই, কেবল নীরবতার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা রেললাইনের ধাতব ধ্বনি। এ যেন পর্বতের হৃদয়ের ভেতর মানুষের রেখে যাওয়া এক ছোট্ট ধ্বনি, যেখানে পৌঁছাতে পারলেই মনে হয় মাটির ওপরে নয়, আকাশের দেশেই পা রাখা হয়েছে।
গালেরা (পেরু) ৪,৭৮১ মিটার
আন্দিজ পর্বতমালার বুক চিরে উঠে যাওয়া রেললাইন ধরে যখন ট্রেন গালেরা স্টেশনে পৌঁছায়, তখন মনে হয় ট্রেনটি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। চারদিকের খাড়া পর্বতশ্রেণি আর সিঁদুররঙা পাথুরের ঢাল ঘিরে রেখেছে স্টেশনটিকে। স্টেশনটির পাশে রয়েছে আন্দিজের বিখ্যাত ‘গালেরা টানেল’, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার ওপরে। এ কারণে এটিকে কৌশলগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। বাতাস এখানে এতটাই শুকনো ও ঠান্ডা যে নিঃশ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় বুকে কাঁচ ঢুকে যাচ্ছে। তবুও পাহাড়ের সেই বিস্তৃত নীরবতা, আকাশের সেই অতল নীল আর মেঘের ছায়া গালেরাকে এক অনন্য উচ্চতার রাজ্যের রূপ দিয়েছে।
কনডর (বলিভিয়া) ৪,৭৮৬ মিটার
বলিভিয়ার রুক্ষ অ্যান্ডিয়ান মালভূমিতে অবস্থিত কনডর স্টেশন যেন একাকী প্রহরী। ঝোড়ো হাওয়া আর নিম্ন তাপমাত্রা এখানে প্রতিদিনের সঙ্গী। পাহাড়ের ঢালে ছুটে আসা রেলগাড়ি যখন হঠাৎ থামে এই নির্জন স্টেশনে, তখন মনে হয় সময়ই থমকে গেছে। পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে উঁচু স্টেশন হওয়ায় এর চারপাশে বাতাস আরো পাতলা, নীরবতাও গভীর। যাত্রী নেই বললেই চলে, তবু এটি বছরের পর বছর দূরবর্তী গ্রামের মানুষ ও মালবাহী ট্রেনকে পথ দেখিয়ে এসেছে। এমন পরিবেশে দাঁড়িয়ে কনডর শব্দের অর্থ নতুন করে অনুভব হয়-যেন সত্যিই কোনো রাজসিক শিকারি পাখির ডানায় এসে পড়েছি আমরা।
লা-রায়া (পেরু) ৪,৩১৩ মিটার
কুসকো থেকে পুনো-আন্দিজ পর্বতমালার বুক চিরে যে রূপকথার রেলপথ চলে, তার মাঝেই লা-রায়া স্টেশন। এখানে পৌঁছামাত্রই মনে হয় যেন দিগন্ত হঠাৎ আরো দূরে সরে গেছে। চারদিকে নীলাভ পর্বতশিরা, তাদের মাঝে জমাট বাতাসে বিছানো এক স্তব্ধ নীরবতা। উচ্চতার কারণে হাওয়া ঠান্ডা ও শুকনো আর সূর্যের আলো যেন রূপ নেয় তীক্ষ্ম কাচে। যাত্রীরা একটু নেমে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে তুষার ছাওয়া শৃঙ্গ, লামার পাল আর ধুলোমাখা পর্বতভূমি। মনে হবে পৃথিবীর ছাদে দাঁড়িয়ে আছেন! আর রেলপথের লম্বা বাঁকগুলো যেন পাহাড়ের শিরায় জড়িয়ে থাকা রুপালি সাপের মতো, আর লা-রায়া সেই সাপের হৃদস্পন্দন।
জুং-ফ্রাউ-জখ (সুইজারল্যান্ড) ৩,৪৫৪ মিটার
ইউরোপের ছাদ-এই নামটি শুধু প্রচার নয়, জুং-ফ্রাউ-জখ সত্যিই তা প্রমাণ করে। আল্পস পর্বতের রুক্ষ বরফের গায়ে খোদাই করা একটি টানেলের ভেতরে লুকিয়ে আছে স্টেশনটি। ট্রেন থেকে নামলেই চোখে পড়ে অন্তহীন বরফের সমুদ্র। অ্যালেটশ হিমবাহের বিশাল সাদা বিস্তার। বাতাস পরিষ্কার, কাঁপন ধরানো ঠান্ডা আর আকাশ এত নীল যে মনে হয় রং ছুঁয়ে দেখা যায়। স্টেশনটি একটি বিস্ময়-পাহাড়ের বুক কাটতে কাটতে এখানে পৌঁছানো রেলপথ যেন মানব ইচ্ছাশক্তির সবচেয়ে উজ্জ্বল দাগ।
সূত্র : উইকিপিডিয়া, রেলওয়ে-টেকনোলজি ডটকম
