ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও করিম বেনজামা।
শুরুটা হয়েছিল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে রোনালদো যোগ দেন সৌদি আরবের আল নাসর ক্লাবে। রাতারাতি সৌদি আরবের পেশাদার লিগ কেড়ে নেয় বিশ্বের মনোযোগ। সেই সময়েই ঘোষণা আসে, ইউরোপকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ভবিষ্যতে বিশ্বসেরা খেলোয়াড়দের টানবে সৌদি ক্লাবগুলো। সৌদির ঘোষণা বাগাড়ম্বর ছিল না। ইতোমধ্যে বিশ্ব ফুটবলের একাধিক মহাতারকা পেয়ে গেছে সৌদি পেশাদার লিগ।
২০২৩-২৪ মৌসুমের সৌদি লিগে বসতে চলেছে তারকার মেলা। আল ইত্তিহাদ ক্লাবে যোগ দিয়েছেন ফ্রান্সের করিম বেঞ্জেমা এবং এন’গোলো কন্তে, পর্তুগালের দিয়াগো জোতা। ইন্টার মিলান থেকে আল নাসর ক্লাবে এসেছেন ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ডার মার্সেলো ব্রোজোভিচ। পর্তুগিজ জাতীয় দলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রুবেন নেভেস, সেনেগালের লেফট ব্যাক কালিদু কালুবেলিকে দলে নিয়ে আলোচনায় আল হিলাল। সর্বশেষ আল আহলি ক্লাবের সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি হয়েছে ব্রাজিলিয়ান ফিরমিনোর। একই দলে যোগ দিয়েছেন এডওয়ার্ড মেন্ডি। ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমার জুনিয়র, সার্জিও রমোস, আলেক্সিস সানচেজ এবং মরক্কোর হেকিম জিয়েশদের দিকেও হাত বাড়িয়ে রেখেছে সৌদি আরব।
প্রশ্ন হচ্ছে, সৌদি আরব কেন হঠাৎ করে নিজেদের ঘরোয়া ফুটবলকে বিশ্ব তারকায় ভরিয়ে দিতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে? শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল, ২০৩০ সালের ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজক হতেই সৌদির সকল প্রয়াস। অথচ অতীতে চিলি, সুইডেন, মেক্সিকো কিংবা অতি সম্প্রতি ফিফা বিশ্বকাপের আয়োজক কাতারের ঘরোয়া ফুটবল কাঠামো খুব বেশি শক্তিশালী ছিল না। তারা সকলেই বিশ্বকাপের আয়োজক হতে পেরেছে মহাদেশীয় কোটায় কিংবা অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জোরে। সৌদি আরব পেট্রো ডলারে সমৃদ্ধ। অদূর ভবিষ্যতে তারাও বিশ্বকাপের স্বাগতিক মর্যাদা পাবে, এটা নিশ্চিত। ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ স্বাগতিক নির্ধারিত হয়ে গেছে। ২০৩০ সালে ফিফা বিশ্বকাপ পা রাখবে শতবর্ষে। ১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল ল্যাটিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে। গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ খ্যাত টুর্নামেন্টটির শতবর্ষী আসরও ল্যাটিন আমেরিকায় অনুষ্ঠিত হতে পারেএমন ধারণা পোক্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা, চিলি ও প্যারাগুয়ে যৌথভাবে ২০৩০ সালের আয়োজনের দাবিনামা পেশ করেছে ফিফা বরাবর।
সৌদি আরবের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ক্লাব ফুটবলে ইউরোপকে চ্যালেঞ্জ করা। কিন্তু শুধু তারকা খেলোয়াড় দলে ভিড়িয়ে ইউরোপের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ‘অসম্ভব’। মার্কিন মুল্লুকের মেজর লিগ সকারে ‘ফুটবলের রাজা’ পেলে থেকে শুরু করে হালের ওয়েন রুনি, জøাতান ইব্রাহিমোভিচ, ডেভিড বেকহ্যামরা খেলেছেন। কিন্তু তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া ফুটবল খুব উঁচুতে উঠে গেছে, ভাবার কোনো কারণ নেই। সম্প্রতি আর্জেন্টিনার মহানায়ক লিওনেল মেসি যোগ দিয়েছেন ইন্টার মিয়ামিতে, তাতে মেজর লিগ সকারের দিকে ফুটবল ভক্তদের মনোযোগ বাড়বে; কিন্তু তারা ইউরোপের সমকক্ষ হয়ে যাবেএমন ভাবনা অবান্তর। কারণ তারকা খেলোয়াড়রা ইউরোপ ছাড়ছেন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে। যখন ইউরোপের লিগে তাদের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে, তখন।
এখানেই ইউরোপের শক্তি। ইউরোপের বিভিন্ন লিগে অংশ নেওয়া দলগুলোর আছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আর শক্তিশালী অবকাঠামো। প্রত্যেকের একাডেমি থেকে নিয়মিত উঠে আসছে তরুণ ফুটবলার। তারা দেদার অর্থ বিনিয়োগ করে তরুণ ফুটবলারদের পেছনে। কঠিন পেশাদার মানসিকতায় থাকা ইউরোপ বিশ্বকাপ জয়ের পরও মেসিকে বিদায় জানাতে দ্বিধা করে না। কারণ একটাইবয়স। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে প্রতিযোগিতা ইস্পাত-কঠিন। সেখানে আবেগ বা অতীত সুনামের কোনো স্থান নেই।
অনেকেই মনে করছেন, সৌদি ভবিষ্যতে ইউরোপকে লিগ ফুটবলে টেক্কা দেবে। কিন্তু এই বিষয়ে উয়েফা সভাপতি আলেক্সান্ডার সেফেরিন নিশ্চিত সুরে জানিয়েছেন, ‘ক্যারিয়ারের শেষে চলে আসা খেলোয়াড় কিনে কখনো কোনো দেশ ফুটবলে উন্নতি করতে পারেনি। একটি দেশের ফুটবলের উন্নতি নির্ভর করে বয়সভিত্তিক একাডেমির ওপর। চীনের মতো ভুল করছে সৌদি। তাদের উচিত একাডেমিতে বিনিয়োগ করা। তারা উঁচুমানের কোচ আনুক। নিজেদের খেলোয়াড় তৈরি করুক।’ সৌদিরও টার্গেট হওয়া উচিত এটাই। কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয়ে বুড়োদের না কিনে নিজের ফুটবলারদের যোগ্য করে তুলুক ইউরোপের লিগে খেলার। তাতেই ইউরোপের সঙ্গে পাল্লা সম্ভব হবে, নচেৎ নয়।