ইতিহাস গড়া টাঙ্গাইলের কৃষ্ণা রাণীর অজানা কথা

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৪:০৯

কৃষ্ণা রাণী সরকার
নেপালের কাঠমুন্ডুর দশরথ রঙ্গশালায় অনুষ্ঠিত সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালের মেয়েদের ৩-১ গোল ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারে মতো ট্রফি জিতে ইতিহাস গড়ল লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
দেশের পক্ষে তিন গোলের দুটোই করেছেন কৃষ্ণা রাণী সরকার। খেলার ১৩ মিনিটে একটি ও ৪১ মিনিটে আরেকটি গোল করে বাংলাদেশের জয়কে নিশ্চিত করেন কৃষ্ণা রাণী। কৃষ্ণার খেলায় একদিকে যেমন বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হয়েছে, অন্যদিকে বিশ্বে বাংলাদেশের নতুন একটি ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। এ জয়ের আনন্দে ভাসছে পুরো দেশ।
কৃষ্ণা রাণী আজ দেশে ফিরছেন। এদিকে, রাণীর রাজ্যে নেমেছে বাঁধভাঙা উল্লাস। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার নগদা শিমলা ইউনিয়নের উত্তর পাথালিয়া গ্রামে রাণীর জন্মস্থান। এ গ্রাম থেকে শুরু করে পুরো টাঙ্গাইলে চলছে উল্লাস। রাণীর গ্রামে ফেরার অপেক্ষায় আছেন স্থানীয়রা।
গত সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) নেপালের কাঠমুন্ডুতে খেলা চলাকালীন সময়ে কৃষ্ণা রাণীর গ্রামের বাড়িতে চলছিল লোডশেডিং। ফলে কৃষ্ণার মা জোড়া গোল উপভোগ করতে পারেননি। তবে বাবা বাসুদেব চন্দ্র সরকার থেমে থাকেননি। দু'মাইল বাইসাইকেল চালিয়ে পাশের গ্রামে গিয়ে টিভিতে খেলা দেখেন। গোলের সাথে সাথে টিভির সামনে থাকা দর্শকরা কৃষ্ণার বাবাকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস করেন। উল্লাস চলছে পুরো গ্রামে। ভোর থেকে কৃষ্ণার বাড়িতে অসংখ্য মানুষ ভীড় করছে। ঘরে বারান্দায় সাজিয়ে রেখেছেন কৃষ্ণার অর্জিত সব ট্রফি, খেলার ছবি ও সার্টিফিকেট। আনন্দে আত্মহারা কৃষ্ণার বাবা-মা।
উল্লাস হবেই না বা কেন। কারণ কৃষ্ণারাইতো বাংলাদেশকে নতুন করে চেনালেন। প্রমাণ করেছেন দলের অন্যতম বড় ভরসার নাম কৃষ্ণা রাণী সরকার। মফস্বলের একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা কৃষ্ণার সাফল্য দেশবাসীর কাছে সত্যিই অনেক প্রশংসনীয় এবং আনন্দের।
কৃষ্ণার বাবা জানালেন কৃষ্ণার ফুটবলপ্রেমী হওয়ার গল্প। ছোটবেলা থেকেই খেলাপাগল কৃষ্ণার ভিন্নমাত্রার আকর্ষণ ছিল ফুটবলের প্রতি। শৈশব থেকেই কৃষ্ণার অবসর কাটতো ফুটবল নিয়ে। লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগী থেকে ফুটবল নিয়ে মাতামাতি করায় একবার কৃষ্ণার মা হাত থেকে বল কেড়ে নিয়ে বলটি কেটে ফেলেন। তা দেখে কৃষ্ণার কাকা পরে একটি ফুটবল কিনে দেন তাকে। একপর্যায়ে ছেলেদের সঙ্গে মিলে ফুটবল খেলা বন্ধ হয়ে যায় কৃষ্ণার। পরে আশপাশের মেয়ে শিশুদের নিয়ে বাড়ির ছোট আঙ্গিনায় ফুটবল চর্চার সুযোগ দেয়া হয়; কিন্তু তাতেও কৃষ্ণাকে দমাতে পারেননি বাবা বাসুদেব চন্দ্র সরকার ও মা নমিতা রাণী সরকার। আজকের জয়ে সেই বাবা-মা-ই সবচেয়ে বেশি গর্বিত।
ফুটবলে কৃষ্ণার হাতেখড়ি ২০১০ সালে উপজেলা পর্যায়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুনেচ্ছা মুজিব আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবল টুর্নামেন্টে। কৃষ্ণার নেতৃত্বে তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তর পাথালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই টুর্নামেন্টে কৃষ্ণা সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ায় সূতী ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের নজরে পড়ে সে।
ফুটবলে কৃষ্ণার অসাধারণ ক্রীড়া নৈপূণ্য দেখে ওই শরীরচর্চা শিক্ষক অনেকটাই নিজের আগ্রহে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে কৃষ্ণার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর কৃষ্ণাকে সূতী ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুলে বিনাবেতনে ভর্তি করানো হয়। আর এ স্কুলে ভর্তি হয়েই ফুটবল চর্চার অবাধ সুযোগও পেয়ে যায় কৃতী এই ফুটবল কন্যা।
বাবার পরেই কৃষ্ণার ফুটবলার হওয়ার পেছনে তার কাকার অবদান। সকালে ঘুম থেকে তুলে বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন তার কাকা নিতাই চন্দ্র সরকার। আসা-যাওয়ার ভাড়াটাও ওই কাকাই দিতেন। এরপর উপজেলা পরিষদ থেকে সাইকেল দেওয়ার পর অনুশীলনে যেতে তেমন একটা সমস্যা হয়নি।
এক সময় দরজির দোকান ছিল কৃষ্ণার বাবার বাসুদেব সরকারের। টাকার অভাবে অনেক আগেই দোকানটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন কৃষ্ণার বাবা। বর্তমানে কৃষিকাজ করে দিনাতিপাত করছেন তিনি।
পরে গোলপুরের সূতী ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুল কৃষ্ণার ফুটবল নৈপূণ্য আর বিশেষ ভূমিকায় জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে পর পর তিনবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পরবর্তীতে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দল গঠন করা হলে কৃষ্ণাসহ একই স্কুল থেকে আরো দুই কিশোরী ফুটবলার বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দলেও জায়গা করে নেন।
২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক ফুটবলে কৃষ্ণার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। পরের বছর একই টুর্নামেন্টেও শিরোপা ঘরে তোলে বাংলাদেশ। তবে সেই দলে বয়সের কারণে ছিলেন না কৃষ্ণা; কিন্তু একই বছর ঢাকায় হওয়া এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই দলের গর্বিত অধিনায়কও ছিলেন কৃষ্ণা রাণী সরকার। একই সঙ্গে সেই আসরে ৮ গোল করে দলকে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন এ ফুটবল বিস্ময়কন্যা। ২০১৭ সালে কৃষ্ণার নেতৃত্বেই থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের মূল পর্বে খেলার গৌরব অর্জন করেছে লাল-সবুজের দল। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ভারতে হওয়া সাফ ফুটবলে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ। যে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন কৃষ্ণা।
সূতি ভিএম মডেল পাইলট হাইস্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপন বলেন, কৃষ্ণা খুব দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কঠোর পরিশ্রম এবং ইচ্ছাশক্তি থাকার ফলে কৃষ্ণা আজ দেশসেরা ফুটবলার হতে পেরেছে। যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তাকে দেখে স্কুল এবং উপজেলার অনেক ক্ষুদে ছেলে মেয়েরা খেলাধুলায় আগ্রহী হচ্ছে। ভবিষ্যতেও কৃষ্ণা এমন সাফল্য ধরে রাখবে এমনটিই প্রত্যাশা গোলাম রায়হানের।
কৃষ্ণা রানীর বাবা বাসুদেব চন্দ্র জানান, কৃষ্ণা শত বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে আজ দেশের সম্মান রক্ষা করেছে। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে গর্বিত। তবে নারী-পুরুষ খেলোয়াড়দের বেতন বৈষম্য দূরিকরণের জোর দাবি জানান তিনি।
গোপালপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুছ ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু জানান, একটি মেয়ে আমাদের টাঙ্গাইলের সুনাম বয়ে এনেছে। আমরা কৃষ্ণাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃষ্ণাকে খেলাধুলায় উৎসাহ দিয়েছি। ছোটবেলাতেই বল উপহার দিয়েছি। আজ সে একজন তারকা। কৃষ্ণা এখন শুধু টাঙ্গাইলের গর্ব না পুরো দেশের গর্ব।