Logo
×

Follow Us

ফুটবল

কে জিতবে শিরোপা

Icon

খলিলুর রহমান

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২২, ১৫:০৫

কে জিতবে শিরোপা

কাতার বিশ্বকাপ ২০২২। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিটা বিশ্বকাপের আগে ফুটবলপ্রেমীদের মনে-মাথায় এই কমন প্রশ্নটা ঘুরে বেড়ায়। কে জিতবে বিশ্বকাপ- প্রশ্নটা সবচেয়ে দামিও। সোনার ট্রফিটার জন্য মরণপণ লড়াইয়ে নামবে বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশ থেকে বাছাই করা ৩২টি দল। দীর্ঘ এক মাসের রুদ্ধশ্বাস লড়াই শেষে ট্রফিটার মালিক হবে একটা দল। ৩২ দলের মধ্য থেকে সেই একটি দল কে হবে- এটা কি আগে থেকেই বলে দেওয়া সম্ভব?

অসম্ভব হলেও সেই পথেই তো হাঁটতে হচ্ছে। ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে ‘বিশ্বকাপ সাময়িকী’র জন্য অপরিহার্য এই মূল স্টোরিটা লেখার দায়িত্বটা আমার ওপরই! বাধ্য হয়ে লিখতে বসে প্রথমেই মনে পড়ছে ফিফার সাবেক সভাপতি সেপ ব্ল্যাটারের কথা। কে জিতবে বিশ্বকাপ- এই ভবিষ্যদ্বাণীর নির্ভুল একটা এস্কেপ দিয়ে রেখেছেন তিনি! 

২০০৬ বিশ্বকাপ সামনে রেখে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন সেপ ব্ল্যাটার। স্বাভাবিকভাবেই তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- ২০০৬ বিশ্বকাপ জিতবে কে? সেপ ব্ল্যাটারের চটজলধি উত্তর, ‘৯ জুলাইয়ের ফাইনালে যারা জিতবে!’ কী দারুণ, ব্ল্যাটারের কত বুদ্ধি! সুইস ভদ্রলোক ৪ মেয়াদে ২১১ সদস্যবিশিষ্ট ফিফার সভাপতি ছিলেন দীর্ঘ ১৭ বছর (১৯৯৮ থেকে ২০১৫)। বুদ্ধি না থাকলে কি আর এতদিন ফিফার সভাপতি থাকতে পারেন। অবশ্য ব্ল্যাটারের এই বুদ্ধির প্রসঙ্গ উঠলেও মনে পড়ে যায় জার্মানির নাম না জানা ওই সাংবাদিকের কথা। নিজস্ব গবেষণায় ফুটবলের আমূল পাল্টে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন ব্ল্যাটার। খেলোয়াড় সংখ্যা কমানো, গোলপোস্ট বড় করাসহ নানা বৈপ্লবিক প্রস্তাব তুলেছিলেন তিনি। সেপ ব্ল্যাটারের গবেষণালব্ধ সেই প্রস্তাবের সমালোচনা করে ওই সাংবাদিক বলেছিলেন, ‘সেপ ব্ল্যাটারের মাথায় বুদ্ধি গিজগিজ করে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠেন ১০১টা নতুন আইডিয়া নিয়ে। দুঃখের বিষয় হলো- তার ১০২টা আইডিয়াই খারাপ!’

তবে তার আইডিয়া যেমনই হোক, কে জিতবে বিশ^কাপ প্রশ্নে তিনি যে শতভাগ নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সেটির তারিফ করতেই হয়! পুরোপুরি ঝুঁকিহীন নির্ভুল এক ভবিষ্যদ্বাণী। ব্ল্যাটারের এই এস্কেপ মেনে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়- ১৮ ডিসেম্বরের ফাইনালে বিজয়ী দলই জিতবে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ; কিন্তু সমস্যা হলো পাঠকরা কি এই উত্তর মানবে। ব্ল্যাটারের এই ভবিষ্যদ্বাণী তো ফুটবল বোঝে না এমন অজ্ঞ লোকও করতে পারেন। ফুটবলপ্রেমীরা বরং ফাইনালের আগেই সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়নের নাম জানতে চায়। শুধু জানতেই চায় না, প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রীতিমতো কাগজ-কলম নিয়ে গবেষণা, তর্ক-বিতর্কেও লিপ্ত হয়।  

যে কোনো টুর্নামেন্টেই সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করাটা কঠিন। অঘটন ঘটন পটিয়সী ফুটবল বিশ্বকাপে সেটা আরও বেশি কঠিন। তবে অতীত ঘেটে ভবিষ্যদ্বাণী করার কিছু ফর্মুলা নিশ্চয় পাওয়া যায়।

ফর্মুলা নম্বর এক : আগের ২১টি আসরেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশ। এর মধ্যে ইউরোপের দেশগুলো জিতেছে ১২ বার। ইতালি ৪ বার (১৯৩৪, ১৯৩৮, ১৯৮২, ২০০৬), জার্মানি ৪ বার (১৯৫৪, ১৯৭৪, ১৯৯০, ২০১৪), দুবার ফ্রান্স (১৯৯৮, ২০১৮) এবং একবার করে ইংল্যান্ড (১৯৬৬) ও স্পেন (২০১০)। বাকি ৯ বার বিশ্বকাপ গেছে দক্ষিণ আমেরিকায়। ব্রাজিল ৫ বার (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪, ২০০২), দুবার করে উরুগুয়ে (১৯৩০, ১৯৫০) ও আর্জেন্টিনা (১৯৭৮, ১৯৮৬)।

এই দুই মহাদেশের বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা বা অন্য কোনো অঞ্চলের কোনো দেশই ফুটবল বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। ফিফা কোটার ভিত্তিতে এসব অঞ্চলের দেশগুলো শুধু অংশ নেওয়ার জন্যই অংশগ্রহণ করে! কাজেই অনেকটা ঝুঁকিহীনভাবেই বলে দেওয়া যায়- কাতারেও বিশ্বকাপ জিতবে ইউরোপ বা দক্ষিণ আমেরিকার কোনো না কোনো দেশ। এর বাইরের কোনো দেশ চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে না।

ফর্মুলা নম্বর দুই : এ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিতেছে মোট ৮টি দেশ। তার মধ্যে ৪ বারের চ্যাম্পিয়ন ইতালি এবার বিশ্বকাপেই নেই। বিশ্বকাপজয়ী বাকি ৭ দলই আছে কাতার বিশ্বকাপে। এবারও এই ৭ দলের কারও হাতেই ট্রফি ওঠার সম্ভাবনা বেশি। এর বাইরে শিরোপা দাবিদারের তালিকায় আর আছে নেদারল্যান্ডস। ঝুঁকি এড়াতে সম্ভাবনার তালিকায় গত আসরের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালের নামটাও যোগ করা যায়। তবে এদের সম্ভাবনা ক্ষীণই। কারণ, শুধু তারকাখচিত দল হলেই বিশ্বকাপ জেতা যায় না। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে হলে ফুটবল ঐতিহ্য থাকাটাও খুব জরুরি।

যাই হোক, ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম, পর্তুগালের মতোই সম্ভাবনা ক্ষীণ ‘৭ চ্যাম্পিয়ন’ তালিকার অন্যতম উরুগুয়ের। অনেক আগেই নিজেদের সোনালি সময়কে পেছনে ফেলে আসা উরুগুইয়ানরা নিজেরাও এবার শিরোপা স্বপ্নের মালা বুনেছে কিনা সন্দেহ! ‘চ্যাম্পিয়ন’ তালিকার আরেক দল ইংল্যান্ড এবার নিজেরাই নিজেদের একটা ‘রহস্যের জালে’ বেঁধে ফেলেছে। ফুটবলের জন্মদাতা দেশটি বরাবরই বিশ্বকাপ নিয়ে খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষায় থাকে। প্রতিটা বিশ্বকাপের আগে ইংলিশ গণমাধ্যম নিজেদের দল নিয়ে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে বাহারি সব গল্প লেখা শুরু করে, বোনে স্বপ্নের মালা। তাদের ভাবটা থাকে এমন- যেন ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিতবেই; কিন্তু ইংলিশ গণমাধ্যমের এই মাত্রাতিরিক্ত আগাম লাফালাফি সফলতার মুখ দেখেছে মাত্র একবার। ১৯৬৬ সালে জেতা ইংলিশদের সেই সবেধন নীলমণির বিশ্বকাপের গায়েও বিতর্ক-কলঙ্কের দাগ আছে। রহস্যজনক হলেও সত্যি, বরাবরের সেই নিজস্ব রীতিকে কবর দিয়ে ইংলিশ গণমাধ্যম এবার বিস্ময়কর রকমের নিশ্চুপ! 

আগাম চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দেওয়া তো দূরের কথা, হ্যারি কেনদের দল কাতারে চ্যাম্পিয়ন হতে পারে- এমন আশার ছবিও এবার আঁকেনি ইংলিশ গণমাধ্যম। অঘটনের ২০১৮ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে উঠেছিল গ্যারেথ সাউথগেটের ইংল্যান্ড। এবারও সেই সাউথগেটই ইংল্যান্ডের কোচ। সেই হ্যারি কেনই অধিনায়ক। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ও আছে এবারের দলে। তার পরও নিজেদের দলকে নিয়ে ইংলিশ গণমাধ্যমের এতটা মৌনব্রত পালন বড় রহস্যই!

ইংলিশরা নিজেদের নিয়ে কেন এমন নীরব, কারণটা তারাই ভালো জানে। কে জানে, বরাবর অতিআশার ফোলানো বেলুন শেষ পর্যন্ত চুপসে যাওয়ায় এবার হয়তো মুখে কুলুপ আঁটার কৌশলে দান মারতে চাইছে। তা শিরোপা জেতার সামর্থ্যও দলটির আছে। শিরোপার দাবি নিয়েই কাতারে এসেছে তারা; কিন্তু শিরোপার দাবিদার আর হট ফেভারিট এক কথা নয়। ইংল্যান্ডও কাতার বিশ্বকাপের ‘হট ফেভারিট’ তালিকায় নেই।

‘হট ফেভারিট’- প্রাক-বিশ্বকাপ আলোচনায় এই শব্দ যুগলই ফুটবলপ্রেমীদের পছন্দের। আগ্রহ-কৌতূহল উচ্চমাত্রা ছোঁয় এই তালিকা নিয়েই। বর্তমান পারফরম্যান্সের সঙ্গে অতীত ঐতিহ্য-সফলতা মিলিয়ে কাতার বিশ্বকাপের ‘হট ফেভারিট’ তালিকায় আছে ৫টি দল। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, স্পেন ও জার্মানি। এই হট ফেভারিটদের হট ফেভারিট আবার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স। কেউ কেউ তো বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকেও ডিলিট করে শুধু ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার নামই বলছে। তাদের জোর দাবি- কাতারে ট্রফি উঁচিয়ে ধরবে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যকার যে কোনো এক দল! বিশেষ করে বাংলাদেশের দর্শকদের অঙ্কিত চিত্র এটাই।

ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা-দক্ষিণ আমেরিকার দেশ দুটি ফুটবল বিশ্বকাপের বরাবরের ফেভারিট। আমদর্শক থেকে শুরু করে ফুটবলবোদ্ধা- সবার রায়েই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা শিরোপা দৌড়ে এগিয়ে। এমনকি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা এগিয়ে বাজি ধরেও। দুই দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সও তাদের হয়েই কথা বলছে।

২০১৮ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া ব্রাজিল এবার সত্যিই ভারসাম্যপূর্ণ দল। রক্ষণ, মাঝমাঠ, আক্রমণভাগ, এমনকি গোলপোস্ট- সব বিভাগেই বিশ্বমানের খেলোয়াড়দের মিলনমেলা। সেই ২০১৬ সাল থেকে কোচের দায়িত্বে থাকা তিতে দলটাকে নিপূণ হাতে এক সুতোয় গেঁথেছেন। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করায় খেলোয়াড়দের সম্পর্কে তার জানা-শোনাটা ভালো। সম্পর্কটাও দারুণ, বন্ধুর মতো। এই বন্ধুত্বের সুতো দিয়েই দলকে একাট্টা করেছেন তিতে; কিন্তু কোচ তিতের সেই বন্ধন ছিঁড়ে বাইরে ছিটকে পড়েছেন ফিলিপে কুতিনহো। ইংলিশ ক্লাব অ্যাস্টন ভিলায় খেলা কুতিনহোর বিশ্বকাপ-স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে চোট। কুতিনহোর ছিটকে পড়াটা ব্রাজিলের জন্য একটা ধাক্কাই। তবে তাকে ছাড়াও দলটিতে তারকার অভাব নেই। ব্রাজিল দলে তা কখনো হয়ও না। নেইমার, ভিনিসিউয়াস জুনিয়র, রদ্রিগো, রিচার্লিসন, কাসেমিরো, রাফিনহা, ফাবিনহোরা তৈরি ২০ বছরের শিরোপা-খরা ঘুচিয়ে দেশবাসীকে ‘হেক্সা’র স্বাদ দেওয়ার। সত্যিকার অর্থেই আগামী ১৮ ডিসেম্বর ‘হেক্সা’র আনন্দে কাঁপতে পারে কোপাকাবানার সমুদ্রসৈকত।

কিন্তু এটাও সত্যি, ফেভারিট হলেই সব সময় শিরোপা জেতা যায় না। তা যে যায় না, তার নজির ফুটবল বিশ্বকাপের আগের আসরগুলোতেই মিলেছে। তা ছাড়া ব্রাজিলই এই কথার সবচেয়ে বড় সাক্ষী। যদি ফেভারিট হলেই শিরোপা জেতা যেত তা হলে ১৯৫০, ১৯৮২, ১৯৯৮ ও ২০০৬- এই ৪টি বিশ্বকাপই থাকত ব্রাজিলের ঘরে। কারণ এই ৪টি আসরেই ব্রাজিল ছিল টপ ফেভারিট। প্রাক-টুর্নামেন্ট আলোচনাটা এমন ছিল- ব্রাজিলের হাতে ট্রফি দিতে পারলেই বাঁচে; কিন্তু ওই ৪ বারের একবারও ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।

শুধু ব্রাজিল নয়, হট হলেই চ্যাম্পিয়ন- বিশ্বকাপ এই রীতি মেনে চললে বিশ্বকাপজয়ী দলের তালিকায় অবশ্য অবশ্যই হাঙ্গেরি এবং নেদারল্যান্ডসের নাম থাকত। ১৯৫৪ বিশ্বকাপ থাকত হাঙ্গেরির নামের পাশে, ১৯৭৪ বিশ্বকাপ লেখা হতো নেদারল্যান্ডসের নামে। কারণ ১৯৫৪ আসরে ফেরেঙ্ক পুসকাস, সান্দর ককসিসদের হাঙ্গেরি এতটাই দুর্দমনীয় ছিল যে, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে, এমনকি টুর্নামেন্ট চলাকালেও কেউ কল্পনা করেননি হাঙ্গেরি ছাড়া অন্য কেউ শিরোপা জিতবে। ঠিক একই চিত্র ছিল ১৯৭৪ বিশ্বকাপে। ইয়োহান ক্রুইফদের নেদারল্যান্ডসের বাইরে কেউ শিরোপা জিততে পারে- এমনটা কারো ধারণাতেও ছিল না; কিন্তু দুবারই সেই ধারণা-তত্ত্ব মিথ্যে প্রমাণ হয়েছে। হাঙ্গেরি ও  নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে ওই দুবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জার্মানি।

মুদ্রার উল্টো পিঠে দেখুন, টপ ফেভারিট না হয়েও যে শিরোপা জেতা যায়, তারও সবচেয়ে বড় সাক্ষী ব্রাজিল। ১৯৭০ ও ১৯৯৪- এই দুই আসরে প্রাক-টুর্নামেন্ট আলোচনায় ব্রাজিলের নামটাই সেভাবে উচ্চার হয়নি। খোদ ব্রাজিলিয়ানরাও নিজেদের দল নিয়ে উচ্চাবিলাসী স্বপ্নের জাল বোনেনি। অথচ সবাইকে চমক দিয়ে ওই দুবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ব্রাজিল। চাইলে এমন উদাহরণ আরও পেয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়। পশ্চিম জার্মানি যেমন ফেভারিট না হয়েও ১৯৫৪ ও ১৯৭৪ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে। একইভাবে ১৯৭৮ আসরে ফেভারিট তালিকায় না থেকেও আর্জেন্টিনা স্বাগতিক ফায়দা তুলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ইতিহাস বলছে, আর্জেন্টিনার মাটির ওই বিশ্বকাপেও হট ফেভারিট ছিল নেদারল্যান্ডস। কিন্তু সেবারও তাদের কপাল পোড়ে ফাইনালে গিয়ে। ১৯৩৪ ও ১৯৮২ আসরে ইতালির চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাও ছিল বড় চমক।

তার পরও ফেভারিট তত্ত্ব বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। সেজন্যই এ নিয়ে এত আলোচনা-পর্যালোচনা। আর সেই পর্যালোচনায় কাতার বিশ্বকাপের টপ ফেভারিট তালিকায় ব্রাজিলের পরই লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। বলা যায়- সম্ভাবনার দৌড়ে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল একই সমান্তরালে। ফুটবলপ্রেমীদের অনেকে শুধু মেসির কারণেই আর্জেন্টিনাকে বিজয়ী দেখতে চাইছে। ডিয়েগো ম্যারাডোনা জাদুতে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের পর আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব গায়ে মাখতে পারেনি আর্জেন্টিনা। ২০১৪ সালে ফাইনালে উঠেও সোনার ট্রফিটা ছুঁতে পারেনি। এবার সেই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার ভালো সুযোগ তাদের সামনে। কোচ লিওনেল স্কালোনি দলটাও গুছিয়ে নিয়েছেন। ব্রাজিলের মতো আর্জেন্টিনাও সব সময়ই তারকাখচিত দল নিয়েই যায় বিশ্বকাপে। তবে আর্জেন্টিনার চিরকালীন দুর্বলতার নাম রক্ষণ। সহজেই ফাঁক-ফোকর বেরিয়ে পড়ে। মজা করে এমনও বলা হয়- আর্জেন্টিনার রক্ষণ মানেই ‘বজ্র আঁটুনির ফসকা গেড়ো।’ কোচ স্কালোনি আর্জেন্টিনার সেই ‘বজ্রআঁটুনির ফসকা গেড়োর রক্ষণ’ মেরামত করে জমাট রূপ দিয়েছেন। দীর্ঘ ২৮ বছরের খরা কাটিয়ে ২০২১ সালে কোপার শিরোপা জিতেছে, সেটি রক্ষণ জমাট থাকার কারণেই। শুধু রক্ষণই নয়, আর্জেন্টিনার মাঝমাঠ, আক্রমণভাগ আরও বেশি শক্তিশালী। গোলপোস্টের নিচেও এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, ফ্রাঙ্কো আরমানিরাও আস্থার প্রতীক। সব মিলে মেসিদের হাত ধরে আর্জেন্টিনা পেয়ে যেতে পারে তৃতীয় বিশ্বকাপ।

সম্ভাবনার দৌড়ে পরের নামটি আসে ফ্রান্সের। দিদিয়ের দেশমের দলটিতেও তারকার মেলা। যদিও ইতিহাস বলছে অন্য কথা। এ পর্যন্ত মাত্র দুটি দেশ পর পর দুবার চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে। প্রথমবার এই কীর্তি গড়েছে ইতালি। ১৯৩৪ সালে প্রথম বিশ্বকাপ জেতা ইতালি ১৯৩৮ সালেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তাদের এই কীর্তি পরে ছুঁয়েছে ব্রাজিল। ১৯৫৮ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ জেতা ব্রাজিল ১৯৬২ আসরেও শিরোপা ধরে রেখেছিল। এর পর গত ৬০ বছরে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন কোনো দলই শিরোপা জিততে পারেনি। এই ফর্মুলা অনুযায়ী কাতারে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের শিরোপা জেতার সম্ভাবনা থাকে না। 

ফরাসিদের জন্য হতাশার রীতি চালু হয়েছে আরও একটি। ২০১০ বিশ্বকাপ থেকে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে! ২০০৬-এর চ্যাম্পিয়ন ইতালি ২০১০ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয়। ২০১০-এর চ্যাম্পিয়ন স্পেন বিদায় নেয় ২০১৪ বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব থেকে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের চ্যাম্পিয়ন জার্মানিও ২০১৮ বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেয়। এই ধারায় এবার ফ্রান্সের পালা গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেওয়ার। তা ছাড়া এই ফ্রান্সই তো ১৯৯৮ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ২০০২ বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল! এবারও সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গী হবে ফ্রান্স?

এসবই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি একটা জুজুর জাল। তবে পেছনের এই জুজুর সঙ্গে কাতার বিশ্বকাপের আগে বড় একটা ধাক্কাও খেয়েছে ফ্রান্স। চোটের কারণে কোচ দিদিয়ের দেশমের বিশ্বকাপ দলে নেই মাঝমাঠের বড় দুই অস্ত্র এনগোলো কন্তে ও পল পগবা! কন্তে-পগবা না থাকায় দেশমের ফ্রান্সের মাঝমাঠ যথেষ্টই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার পরও দলে তারকার অভাব নেই। পেছনের কথিত ওই জুজুর ভয় কাটিয়ে কাতারে বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরার সামর্থ্য এবং সম্ভাবনা, দুটোই খুব ভালো মতো আছে ফ্রান্সের।

এবার আসি জার্মানির কথায়। এমনিতে হানসি ফ্লিকের দলটিকে নিয়ে এবার আলোচনাটা কম; কিন্তু জার্মানি বিশ্বকাপের চিরকালীন ফেভারিট। বছর জুড়ে পারফরম্যান্স যেমনই হোক, বিশ্বকাপে গেলেই সমহিমায় জ্বলে ওঠে জার্মানরা। তাই তো বিগত ২১ আসরের মধ্যে ১৩ বারই সেমিফাইনালে উঠেছে তারা। ফুটবল এবং জার্মানি, দুটি প্রসঙ্গ একসঙ্গে উঠলেই মনে পড়ে ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক গ্যারি লিনেকারের সেই উক্তিটি। বর্তমানে ফুটবল ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করা লিনেকার একবার ফুটবলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ফুটবল হলো এমন একটি খেলা, যেখানে ২২ জন (১১-১১) লোক মাঠে ৯০ মিনিট খেটে মরে, শেষে জার্মানি জেতে।’ ১৩ বার সেমিফাইনাল, ৯ বার ফাইনাল, ৪ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়া জার্মানিকে শিরোপার দৌড় থেকে দূরে রাখার সুযোগ নেই।

সুযোগ নেই ২০১০-এর চ্যাম্পিয়ন স্পেনকেও হালকা করে দেখার। হয়তো স্প্যানিয়ার্ডদের সেই ‘টিকি-টাকার’ জোয়ারে খানিকটা ভাটা পড়েছে; কিন্তু বার্সেলোনার সাবেক কোচ লুইস এনরিকে তারুণ্যনির্ভর দলকে আবার গুছিয়ে নিয়েছেন, চেষ্টা করছেন আবার টিকি-টাকার নতুন ঢেউ তোলার। কে জানে, হয়তো কাতারেই আবার দেখা যাবে স্প্যানিয়ার্ডদের ‘টিকি-টাকার’ মায়াবী জাদু। এনরিকে কিন্তু ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন- ‘কাতারে নতুন এক স্পেনকে দেখবে বিশ্ব।’ এনরিকের এই ‘অন্য স্পেন’-এর হাতে বিশ্বকাপ উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে হতভাগা দলের নাম নেদারল্যান্ডস (হল্যান্ড)। ডাচরা তিনবার ফাইনালে উঠলেও একবারও সোনার ট্রফিটায় হাত ছোঁয়াতে পারেনি। কাতারে ডাচদের সেই আজন্ম হতাশা মুছে যাবে কিনা, বলবে সময়। তবে লুই ফন গলের দলটির সামর্থ্য আছে চ্যাম্পিয়ন মুকুট মাথায় তোলার। ফন গলের নেদারল্যান্ডস দলটি নবীন-প্রবীণের মিলনমেলা। ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, মাথিয়াস ডি লিখত মতো তরুণদের সঙ্গে দলে আছেন বিশ্বসেরা ডিফেন্ডার ভিরগিল ফন ডিক, ডালে ব্লাইন্ড, মেম্ফিস ডিপাইদের মতো অভিজ্ঞরা। আলোচনার বাইরে থাকা ডাচদের সুযোগ এবং সামর্থ্য আছে কাতারেও কিছু একটা করে দেখানোর।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল দলটিও খারাপ না। অধিনায়ক রোনালদোর সঙ্গে ব্রুনো ফার্নান্দেজ, বার্নার্ডো সিলভা, হুয়াও ফেলিক্স- প্রত্যেকেরই রয়েছে তারকাখ্যাতি। সেই ২০১৪ থেকে দায়িত্বে থাকা কোচ ফার্নান্দো সান্তোস দলটিকে নিজের পরিকল্পনা মতোই গড়ে তুলেছেন। খুব ক্ষীণ হলেও রোনালদোদের সম্ভাবনা আছে ট্রফি উঁচি ধরার। 

একই কথা প্রযোজ্য ক্রোয়েশিয়া এবং বেলজিয়ামের ক্ষেত্রেও। ক্রোয়েশিয়া ২০১৮ সালে ফাইনালে উঠে চমকে দিয়েছিল বিশ্বকে। লুকা মড্রিচ-ইভান রাকিতিচদের ক্রোয়েশিয়া জয় করে নিয়েছিল ফুটবলপ্রেমীদের মন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরতে পারেনি। ফাইনালে হেরে যায় ফ্রান্সের কাছে। আগের আসরের রানার্সআপ হিসেবে ক্রোয়েশিয়াকে সম্ভাবনার খাতায় রাখতে হচ্ছে। তবে এবার মড্রিচদের সম্ভাবনা দূর আকাশের তারকার মতোই মিটিমিটি জ্বলছে।

বাকি রইল বেলজিয়ামের কথা। এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রুইনা, রোমেলু লুকাকু, থিবো কুর্তোয়াদের দল যথেষ্টই শক্তিশালী। ‘সোনালি প্রজন্ম’ খেতাব পাওয়া দলটির সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সও ভালো। যার প্রমাণ ফিফা র‌্যাংকিংয়ে দুই নম্বরে থাকা। ২০১৮ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিল। এবার নিশ্চয় লক্ষ্যটা আরও বড়। 

উল্লেখিত দলগুলোর বাইরে যদি কোনো দল শিরোপা জেতে, সেটি হবে মহাঅঘটন! সপ্তম আশ্চার্যের চেয়েও বেশি কিছু! 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫